২৩ মে, ২০২১। সুইজারল্যান্ডের লুজানে রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈতের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারাতে পারলেই মিলত সোনার হাসি। যদিও তা হয়নি, কিন্তু আন্তর্জাতিক আঙিনায় রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী জুটির ওই রুপাই বছরের সেরা সাফল্য। তবে আর্চারিকে ছাপিয়ে বছরের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ছিল অ্যাথলেটিক্স। দেশের দ্রুততম মানব হয়েও টোকিও অলিম্পিকসে মোহাম্মদ ইসমাইলকে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়নি ফেডারেশন। যাকে সুযোগ দিয়েছিল, সেই জহির রায়হান পারেননি ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং পেছনে ফেলতে; উল্টো বছরের শেষ দিকে এসে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে হয়েছেন নিষিদ্ধ!
Published : 30 Dec 2021, 07:13 AM
ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরের খেলাধুলায় হকিতে প্রিমিয়ার লিগ, ক্লাব কাপের শিরোপা জিতেছে মেরিনার ইয়াংস। বঙ্গবন্ধু এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন মেনস ভলিবল চ্যালেঞ্জ কাপে রানার্সআপ হয়েছে বাংলাদেশ। এ বছরই প্রায় আট হাজার ক্রীড়াবিদের অংশগ্রহণে হয়েছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস। ২০২১ সালে আছে বৃত্ত ভাঙার দারুণ গল্প, যেটি লিখেছেন বডিবিল্ডার মাকসুদা আক্তার।
রুপার হাসি রোমান-রুবেল-দিয়ার
আগে থেকেই আর্চারির বিজ্ঞাপন ছিলেন রোমান। এছর তার সঙ্গে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন দিয়া। এই জুটির হাত ধরে লুজানের আর্চারি বিশ্বকাপ স্টেজ-২-এর রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈতের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হেরে যায় ৫-১ সেট পয়েন্টে। অথচ
ফাইনালের আগ পর্যন্ত রোমান-দিয়া জুটির এই ইভেন্টে ছিল দাপুটে পথচলা। ইরানকে ৫-৩ সেট পয়েন্টে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠেন, এরপর জার্মানিকে উড়িয়ে দেন তারা; ৫-১ সেট পয়েন্টে। কোয়ার্টার-ফাইনালে স্পেনকে হারান ৫-৪ ব্যবধানে। সেমি-ফাইনালে দুজনে কানাডাকে হারান অনায়াসে, ৫-৩ সেট পয়েন্টে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি ঢাকায় বসে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপস। মোহাম্মদ হাকিম আহমেদ রুবেল ও দিয়ার হাত ধরে এই আসরে প্রথম সোনা জয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু রিকার্ভ মিশ্র দ্বৈতের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার জুটির কাছে ৫-১ সেট পয়েন্টে হারেন তারা। এ আসরেই রিকার্ভ দলগত ইভেন্টে ভিয়েতনামকে ৫-৩ সেটে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জেতে দিয়া, নাসরিন ও বিউটিতে গড়া বাংলাদেশ দল। ছেলেদের দলগত রিকার্ভে কাজাখস্তানকে ৬-২ সেটে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পায় বাংলাদেশ; দলের হয়ে খেলেন রোমান, রুবেল ও রামকৃষ্ণ সাহা।
এ আসরে সোনা জয়ের স্বপ্ন পূরণ না হলেও এ আসরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কম ছিল না। সেই ২০০৩ সাল থেকে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপসে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এ বছরই প্রথম মিলেছে পদকের দেখা। সব মিলিয়ে দলগত দুটি ব্রোঞ্জ ও রিকার্ভ মিশ্রর রুপা জমা পড়ে বাংলাদেশের অর্জনের শোকেসে।
টোকিওর আসরে এবার অংশ নেয় বাংলাদেশের ছয় অ্যাথলেট। ছয় জনের মধ্যে কেবল রোমানই সরাসরি অর্জন করেছিলেন অলিম্পিকের টিকেট। বাকি পাঁচ জন জহির (অ্যাথলেটিক্স), আব্দুল্লাহ হেল বাকি (শুটিং), আরিফুল ইসলাম ও জুনাইনা আহমেদ (সাঁতার) পেয়েছিলেন ওয়াইল্ড কার্ড।
৬ অ্যাথলেটের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন বাকি। রিও দে জেনেইরোর পর দ্বিতীয় অলিম্পিকসে অংশ নেন এই শুটার। কিন্তু বিবর্ণ পারফরম্যান্সে সবার আগে ছিটকে যান তিনি। এমনকি পারেননি রিওর স্কোরকেও ছাপিয়ে যেতে! ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের বাছাইয়ে ৬১৯.৮ স্কোর গড়ে ৪৭ প্রতিযোগীর মধ্যে ৪১তম হন বাকি। ২০১৬ সালে রিওতে ৬২১ দশমিক ২ স্কোর গড়ে বাছাইয়ে ২৫তম হয়েছিলেন কমনওয়েথ গেমসে দুটি রুপা জেতা এই শুটার। এ ইভেন্টে বাকি পারেননি নিজের ব্যক্তিগত সেরা স্কোরকেও পেছনে ফেলতে। ২০১৬ সালে দিল্লীর শুটিং বিশ্বকাপে ৬২৪.৮ স্কোর গড়েছিলেন।
আর্চারির র্যাঙ্কিং রাউন্ডে রোমান ছাড়াতে পারেননি ব্যক্তিগত সেরা স্কোর। ৬৬২ স্কোর গড়ে ৬৪ প্রতিযোগীর মধ্যে ১৭তম হয়েছিলেন। ওয়ার্ল্ড আর্চারি স্বীকৃত প্রতিযোগিতার বাছাইয়ে তার সেরা স্কোর ৬৮১; থাইল্যান্ডে ২০১৯ সালে এশিয়া কাপ স্টেজ-১-এ গড়েছিলেন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সেরা স্কোর ৬৮৬; গত এসএ গেমসে পোখারায় গড়া। ৬৩৫ স্কোর গড়ে মেয়েদের র্যাঙ্কিং রাউন্ডে ৬৪ প্রতিযোগীর মধ্যে ৩৬তম হয়েছিলেন দিয়া।
দুই সাঁতারুর মধ্যে আরিফুল ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ২৪ দশমিক ৮১ সেকেন্ডে সাঁতার শেষ করে ছাপিয়ে যান নিজের সেরাকে। এ ইভেন্টে ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফিনা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন্সশিপ্সে ২৪ দশমিক ৯২ সেকেন্ড টাইমিং ছিল তার আগের সেরা। লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশের সাঁতারু জুনাইনা ২৯ দশমিক ৭৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজের হিটে আট প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হন। হিটে সব মিলিয়ে ৮১জনের মধ্যে ৬৮তম। ২০১৯ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন্সশিপ্সে গড়া আগের সেরা টাইমিং ৩০ দশমিক ৯৬ সেকেন্ড টোকিওতে পেছনে ফেলেন তিনিও। জুনাইনা একই সঙ্গে রিওতে সোনিয়া আক্তারের গড়া টাইমিংকেও ছাড়িয়ে যান। ২৯ দশমিক ৯৯ সেকেন্ড নিয়ে ৮৮ জনের মধ্যে ৬৯তম হয়েছিলেন সোনিয়া।
কেনিয়ার নাইরোবির ওয়ার্ল্ড-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের পারফরম্যান্সে নজর কাড়া জহির ৪০০ মিটারে ৪৮ দশমিক ২৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে দৌড় শেষ করেন। ব্যক্তিগত সেরা টাইমিংয়ের চেয়ে বেশি সময় নেন তিনি। ২০১৯ সালে ভারতে অন্ধ্র প্রদেশে জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের ৪০০ মিটারে ৪৭ দশমিক ৩৪ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এটাই তার সেরা টাইমিং। ঘরোয়াতে সেরা টাইমিং ২০১৯ সালে গড়া ৪৬ দশমিক ৮৬ সেকেন্ড।
৬০ রেকর্ডের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমস
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বরাবরের মতো সারাদেশ ব্যাপী এই আয়োজন হয়নি। প্রায় আট হাজার অ্যাথলেটের কলরবে তাই মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার ভেন্যুগুলো। ৩১টি ডিসিপ্লিনে সব মিলিয়ে ৬০টি নতুন জাতীয় রেকর্ড হয়। রেকর্ডে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ভারোত্তোলকরা; তারা রেকর্ড গড়েন ৩৪টি। এছাড়া সাইক্লিংয়ে ১৩টি, সাঁতারে ১১টি, ১টি করে রেকর্ড হয় অ্যাথলেটিক্স ও আর্চারিতে। ভারোত্তোলনে তিনটি রেকর্ড গড়েন শিলং-গুয়াহাটি ও কাঠমাণ্ডু-পোখারার এসএ গেমসে দুটি সোনা জেতা মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে ১৩২টি সোনা, ৮০টি রুপা ও ৫৭টি ব্রোঞ্জ মিলিয়ে ২৬৯টি পদক নিয়ে দলগত সেরার মুকুট পায় বাংলাদেশ আনসার। ১১৫টি সোনা, ৯৯টি রুপা ও ৮৩টি ব্রোঞ্জসহ ২৯৭টি পদক রানার্সআপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
দেশের শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করেছেন নারী বডিবিল্ডার মাকসুদা। গত বছর হয়েছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এ বছর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে সোনার পদক জিতেছেন। বাংলাদেশের কোনো নারী বডিবিল্ডার হিসেবে এবারই প্রথমবার অংশ নেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।
বডিবিল্ডার মাকসুদার সাফল্য
বছরের বৃত্ত ভাঙার সেরা গল্পটি লিখেছেন এই বডিবিল্ডার। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুম্বাইয়ে আইএইচএফএফ অলিম্পিয়া অ্যামেচার বডিবিল্ডিংয়ে উইম্যান ফিজিক ক্যাটাগরিতে পদক জিতেছেন; বিশ্বের ৩০ জন বডিবিল্ডারের মধ্যে তৃতীয় রানার্সআপ হয়েছেন তিনি।
২০১৯ সালে বডিবিল্ডিং শুরুর পর দুটো জাতীয় প্রতিযোগিতা ও বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের আসরে পান দেশের বাইরে প্রথম স্বাফল্যের স্বাদ। বডিবিল্ডিংয়ের আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রথম সাফল নারী বডিবিল্ডারও তিনি।
হকির তিন বছর ধরে চলা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির অবসান হয় অক্টোবরে ক্লাব কাপ টার্ফে গড়ানো দিয়ে। আবাহনীকে হারিয়ে শিরোপা জেতে মেরিনার ইয়াংস। ঘরোয়া হকিতে দলটির সফল যাত্রা অব্যহত থাকে প্রিমিয়ার লিগেও। সেখানেও বাজিমাত করে মেরিনার্স।
কিন্তু আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশ ছিল বড্ড মলিন। প্রথমবারের মতো এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আয়োজন করে চার ম্যাচের সবগুলোতেই হারে জাতীয় দল। ভারতের কাছে ৯-০ গোলে হেরে প্রতিযোগিতা শুরুর পর দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৩-২ এবং জাপানের কাছে ৫-০ গোলে হারেন জিমি-আশরাফুলরা। শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও দল হারে ৬-২ গোলে। এই প্রতিযোগিতা শুরুর আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচের মধ্যে একটি পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার পর ৩-১ গোলে হেরেছিল দল। সব মিলিয়ে এশিয়ার শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে খেলা আর এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজনের তৃপ্তিটুকুই সঙ্গী হয় বাংলাদেশের।
ভলিবলে সোনার হাসি দিয়ে শেষ হতে পারত বছরটা। কিন্তু হয়নি। বঙ্গবন্ধু এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন মেনস ভলিবল চ্যালেঞ্জ কাপে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে রানার্সআপ হয়ে বাংলাদেশ। মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে গত ২৮ ডিসেম্বরের ফাইনালে ৩-০ সেটে হেরে যায় দল। প্রথমবারের মতো এই আসরে খেলতে এসেই বাজিমাত করে শ্রীলঙ্কা।
বঙ্গমাতা এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন উইমেন্স ভলিবল চ্যালেঞ্জ কাপের মুকুট ধরে রাখে নেপাল। রোমাঞ্চকর ফাইনালে উজবেকিস্তানকে ৩-২ সেটে হারায় তারা। এ ইভেন্টে বাংলাদেশের মেয়েরা ছিল বড্ড মলিন। টানা চার হারের পর মালদ্বীপকে ৩-২ সেটে হারিয়ে প্রথম জয়ের স্বাদ পায়। এ জয়ের সুবাদে ছয় দলের মধ্যে হয় পঞ্চম।
দেশের দ্রুততম মানব মোহাম্মদ ইসমাইলকে বাদ দিয়ে টোকিও অলিম্পিকসে জহিরকে পাঠিয়ে সমালোচিত হয় অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন। জহির পরে যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ হন। ফেডারেশনের সমালোচনা করে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন ইসমাইলও, পরে ক্ষমা চেয়ে পার পান।
বিতর্কের জন্ম দেয় হকিও। বিজয় দিবস ১৬ই ডিসেম্বরে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ম্যাচ ছিল ভারত ও পাকিস্তানের। দেশের বিজয়ের দিনে এই ম্যাচ সমালোচনার খোরাক জোগায় যথেষ্টই। পরে এশিয়ান হকি ফেডারেশনকে পরিস্থিতির উত্তাপ বুঝিয়ে সূচিতে বদল আনে হকি ফেডারেশন।