ফিরে দেখা ২০১৯: বছরের শুরুতে আগুন, শেষেও; মাঝে ঝড়ের চোখ রাঙানি

বছরের শুরুতে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড নয় বছর আগের নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছিল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই বনানীর এফআর টাওয়ার পোড়ে আগুনে। বছরের শেষে কেরানীগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডেও ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2019, 11:25 AM
Updated : 28 Dec 2019, 11:27 AM

২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর ভবিষ্যতে পুরান ঢাকায় এই ধরনের দুর্যোগ এড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে দিল, সেসবের কিছুই হয়নি।

বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রকাশ পেল দুর্নীতির চিত্র; কীভাবে নকশা জালিয়াতি করে এই ভবনটি অননুমোদিতভাবে ১৮ তলা পর্যন্ত উঁচু করা হয়েছিল, তা প্রকাশ পাওয়ার পর দুদক মামলাও করেছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নৈমত্তিক ঘটনা হিসেবেই দেখে বাংলাদেশের মানুষ; তবে এবছর কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে, যা রেখাপাত করেছে সবার মনে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা এবার হলেও তার মাত্রা ব্যাপক হয়নি। তবে সামুদ্রিক ঝড় ফণী ও বুলবুল প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ালেও দুটিই ভারত উপকূলে আগে আঘাত হানায় অনেকটাই বেঁচে গেছে বাংলাদেশ।

ঢাকার বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারে গত ২৮ মার্চ আগুন লাগে।

অগ্নিকাণ্ড

গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এই আগুন পুরোপুরি নেভাতে ১৫ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এতে ৭১ জন প্রাণ হারান।

আগুনে চকবাজার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি ছিল রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রসাধন সামগ্রীর গুদাম। দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিকাণ্ডের উৎপত্তিস্থল হিসেবে যে ওয়াহেদ ম্যানশন চিহ্নিত হয়েছে, সেখানে প্লাস্টিক দানার গুদাম ছিল, ছিল রাসায়নিকও। অন্য যে চারটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলোর কোনো কোনোটিতেও ছিল দাহ্য পদার্থ।

নিমতলীর ঘটনার পর যে ১৭ দফা সুপারিশ এসেছিল, তার বাস্তবায়ন না করায় চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি উঠেছে। এজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলাকেই দায়ী করছে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন।

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার সব রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা অপসারণের কাজ ফের শুরু করে সিটি করপোরেশন। তবে কিছু দিন যেতে না যেতেই সে কাজে নেমে আসে ভাটা।

চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩৬ দিনের মাথায় ২৮ মার্চ বড় ধরনের আগুনে পুড়ে বনানীর বহুতল ভবন ফারুক-রূপায়ন (এফআর) টাওয়ার।

এ  ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে, ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে; শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয় বাঁচার চেষ্টায় লাফিয়ে পড়ে।

টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকার।

বছরের শেষ মাসে গত ১১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে মোট ২২ জনের মৃত্যু হয়।

কসবার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে।

ট্রেন দুর্ঘটনা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষ ঘটে ১১ নভেম্বর। রাত পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন ১৬ জন। এ হতাহতের ঘটনায় তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের চালককসহ তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুর্ঘটনা নিয়ে সংসদে বিবৃতি দিয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, ভবিষ্যতে রেল দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্ক থাকবে তার মন্ত্রণালয়।

তবে তার কয়েকদিনের মধ্যে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার পর ট্রেনের পাওয়ার কার ও ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। এতে কেউ হতাহত হয়নি।

বছরের বড় রেল দুর্ঘটনার অন্যটি ঘটে ২৪ জুন। সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস মৌলভীবাজারে দুর্ঘটনায় পড়ে চারজন নিহত এবং শতাধিক আরোহী আহত হন।

সিলেট ছেড়ে আসা ট্রেনটি ভাটেরা ও বরমচাল স্টেশন পার হয়ে মোটামুটি ২০০ মিটার যাওয়ার পর পাঁচটি বগি লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। একটি বগি কালভার্ট ভেঙে নিচে ছড়ায় পড়ে যায়। আর দুটি বগি উল্টে পড়ে লাইনের পাশের ক্ষেতের মধ্যে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ভেঙে পড়ে মাদারীপুরের এই স্কুল।

ফনী-বুলবুল

মে মোসের শুরুতে ছিল ঘূর্ণিঝড় ফনীর ছোবল। এতে অন্তত ৯ জনের প্রাণহানি ঘটে; বিধ্বস্ত হয় সহস্রাধিক ঘরবাড়ি।

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ উপকূলে আসায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়। তারপরও ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বলে সরকারের হিসাব।

ফণীর সময় বিপদ সঙ্কেত ৭ জারি করা হলেও নভেম্বর মাসে বুলবুল আঘাত হানার আগে দেওয়া হয়েছিল মহাবিপদ সঙ্কেত। ফলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও ছিল বেশি।

তবে বারবার দিক বদলানো অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড়টি ৯ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি ছিল আশঙ্কার চেয়ে কম।

ঘুর্ণিঝড় বুলবুলে প্রাণহানি ঘটে ২৪ জনের। এতে ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনেরও।

ফনী ও বুলবুলের সময় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবপেইজে দেখা দিয়েছিল সমস্যা; ফলে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রাট ঘটে।

বুলবুল বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসায় সতর্ক সংকেত বাড়ালেও কারিগরি জটিলতায়’ ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ওয়েবসাইটে হালনাগাদ কোনো তথ্য দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বিদায়ী বছর জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে দুই সপ্তাহ ধরে বন্যায় কবলিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। মধ্য মেয়াদী বন্যায় প্লাবিত হয় কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ি, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। এসময়   পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে বা পানিবাহিত রোগে শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে।

এ বন্যায় দেশের ২৮ জেলায় ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান।

জলবায়ুর পরিবর্তনে বিদায়ী বছরে গরমের তীব্রতা ছিল বেশি। গত ৫ বছরের মধ্যে এ বছর জুন মাসে তাপপ্রবাহ হয়  সবচেয়ে বেশি দিন।

এরমধ্যে ১৭ জুন মাসের সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোরে। অবশ্য ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছিল।

চলতি বছর একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয় টেকনাফে। ৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের এ উপজেলায় ৪২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।