ফিরে দেখা ২০১৯: দলগুলোর সময় পার ঘর সামলাতেই

অনেকটাই নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক অঙ্গনে বছরজুড়ে ঘর সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2019, 06:16 PM
Updated : 29 Dec 2019, 06:16 PM

রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলগুলোর কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলেছে সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড। সেই সঙ্গে দলে অনুপ্রবেশ নিয়েও অস্বস্তিতে থাকতে হয়েছে দলটির নেতাদের।

দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আশায়ই ঘুরপাক খেয়েছে বিএনপির রাজনীতি; বড় কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারেনি দলটি। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর সংসদে যোগ দেওয়া নিয়ে বিএনপির ভেতরেই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। এর মধ্যে নেতাদেরও হারাতে শুরু করেছে বিএনপি।

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তাদের কাণ্ডারি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর অন্তর্দ্বন্দ্বে নাকাল। দলটির নেতৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির কোন্দল ছিল রাজনৈতিক মহলে আলোচিত।

ঘর গোছানোর অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল সম্মেলন করেছে। আবার সম্মেলন করতে গিয়ে দল ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে।

বিদায়ী বছরের অন্য দলগুলোর অবস্থাও ছিল একই রকম; ভাঙন ধরেছে প্রধান দুই জোটের দলের মধ্যেই। মহাজোটের ওয়ার্কার্স পার্টি যেমন ভেঙেছে; ভেঙেছে ২০ দলের এলডিপি, জাগপাও। নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামীও ছেড়েছে একটি অংশ।

আওয়ামী লীগকে পিছে টানছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ

টানা ১০ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ; রাজপথে বিরোধী দলের শক্ত চ্যালেঞ্জও নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগকে পেছনে টানছে তাদেরই সহযোগী সংগঠনগুলো। পাশাপাশি দলে অনুপ্রবেশকারীদের হঠাতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ও চালাতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে নানা সময়েই বিব্রত হতে হয়েছে দলটিকে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠার পর পুরো সংগঠনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ছাত্রলীগের সঙ্গে রাজনীতিকেও দাঁড় করায় কাঠগড়ায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এনিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে হস্তক্ষেপ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সেপ্টেম্বরে তিনি সরিয়ে দেন শোভন ও রাব্বানী উভয়কে। তারপর থেকে ভারপ্রাপ্তদের নেতৃত্বে চলছে ছাত্রলীগ।

তার রেশ না কাটতেই অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জন্য আরও বড় সমস্যা তৈরি করে দেয় বুয়েট ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর পিটুনিতে বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।

আন্দোলনে উত্তাল বুয়েট শিক্ষার্থীর দাবির মুখে ছাত্রলীগের ওই নেতাদের বহিষ্কার করতে হয় বুয়েট কর্তৃপক্ষকে। মামলায় আসামি হওয়ার পর গ্রেপ্তারও করা হয় ছাত্রলীগের বুয়েটের নেতাদের।

বছরের শেষে এসে আবারও ছাত্রলীগ সমালোচনায় পড়ে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরের উপর হামলার ঘটনায়। ডাকসু ভবনে নূরের উপর হামলার এই ঘটনার সমালোচনায় মুখর হন আওয়ামী লীগের নেতারাও।

ছাত্রলীগ হামলার দায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের উপর দিলেও ওই সংগঠনটির ব্যানারে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সক্রিয় থাকার বিষয়টি অনেকটাই প্রকাশ্য।

তার আগে নুরের উপর একাধিকবার হামলার জন্যও ছাত্রলীগকে সমালোচনায় পড়তে হয়েছে।

ঢাকার মতো জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডও সৃষ্টি করেছে বিতর্কের।

ছাত্রলীগের পর যুবলীগ আলোচনায় উঠে আসে ক্যাসিনো অভিযানে। এই সংগঠনটির নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে এক সভায় শেখ হাসিনার বিরক্তি প্রকাশের পর র‌্যাব ঢাকার ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে অভিযান চালালে সেখানে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগের নানা নেতার নাম প্রকাশ পায়।

পরে গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ কয়েকজনকে। তাদের বহিষ্কারও করা হয় সংগঠন থেকে। এই ঘটনায় নেতৃত্ব হারান যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীও।

বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডে অনুপ্রবেশকারীদের কথাই বছরজুড়েই বলে আসেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরির কথাও জানানো হয় দলের পক্ষ থেকে, কিন্তু তা নিয়ে আর অগ্রগতি দেখা যায়নি। বছর শেষে সম্মেলনেও অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দেওয়ার কথাই বলেন কাউন্সিলররাও।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনা। ছবি: ইয়াসিন কবির জয়

ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সম্মেলন করেছে, যদিও নেতৃত্ব অপরিবর্তিতই রয়েছে। দল ও সরকার আলাদা করা এবং নতুনদের নেতৃত্বে আনার আলোচনা থাকলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি নতুন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে।

শেখ হাসিনার সভাপতি পদে থাকাটা প্রত্যাশিত হলেও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের আলোচনা ছিল; কিন্তু শেষে দেখা গেছে, ওবায়দুল কাদেরেই ভরসা রেখেছেন শেখ হাসিনা।

অসুস্থতার কারণে ওবায়দুল কাদের বাদ পড়তে পারেন বলে গুঞ্জন ছিল। ৩ মার্চ আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। সেখানে চিকিৎসা দিতে দিতেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়। তাকে দেখতে তখন ভারত থেকে উড়িয়ে আনা হয় প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠীকে। কিছুটা উন্নতি হলে তাকে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। দুই মাস ১০ দিন পর দেশে ফিরে আসেন তিনি।

মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফেরা ওবায়দুল কাদের নিজেও সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমার জীবন ছিল চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। বাঁচব কি-না এ নিয়ে সংশয় ছিল।”

দিক খুঁজতে হয়রান বিএনপি

আগের বছরের মতোই দিশাহীন ছিল বিএনপি; বরং লক্ষ্যহীন রাজনীতিতে নিজের দলে ও জোটে সঙ্কট আরও প্রকট হয়েছে।

দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল বিএনপি; কিন্তু কীভাবে তা হবে, আইনি পথে না কি রাজপথের আন্দোলনে; তা নিয়ে দ্বিধার অবসান ঘটেনি তাদের।

আইনি পথে খালেদা জিয়ার মুক্তির আশা যারা করেছিলেন, সেই মওদুদ আহমদের মতো নেতারা হাল ছেড়ে এখন বলছেন, এই দাবি আদায়ের পথ এখন রাজপথ।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো যারা আগে থেকেই মনে করেছিলেন, রাজপথের আন্দোলনই কেবল খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু সেই ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি তারা।

খালেদার মুক্তিতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির আপসের গুঞ্জনও ছড়িয়েছে দলের মধ্যেই। এমনকি দলের সংসদ সদস্যদের একটি উদ্যোগের সমালোচনা এসেছে দলের নীতি-নির্ধারকদের মধ্য থেকেই।  

কারাবন্দি খালেদা জিয়ার চলাচল এখন হুইল চেয়ারে।

খালেদা জিয়ার মুক্তির মতোই সংসদে যোগদান প্রশ্নেও বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল দলের মধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ।

গত বছরের শেষ লগ্নে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে অংশ নেওয়ার পর ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে সংসদে শপথ নেওয়া থেকে বিরত ছিল বিএনপি।

কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে হঠাৎ করেই শপথ নিয়ে ফেলেন বিএনপি থেকে ভোটে নির্বাচিতরা। তার আগে বিএনপির জোটসঙ্গী গণফোরাম থেকে নির্বাচিতরাও শপথ নেন।

হঠাৎ কেন শপথ- প্রশ্নে বিএনপি নেতারা লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের কথা জানালেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটে জিতেও কেন শপথ নিলেন না, সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মেলেনি।

নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেওয়ার পর সংরক্ষিত আসনও নিয়েছে বিএনপি; আর মনোনীত সেই রুমিন ফারহানা প্লটের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে পড়েছেন বিতর্কের মধ্যে।

ভোটের আগে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ার পর ভোটের পরও নানা সন্দেহের মধ্যে এই জোট নিয়েই এগোতে চেয়েছে বিএনপি; কিন্তু শক্ত কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারেনি। উল্টো সংসদে যোগদান প্রশ্নে জোট ছেড়েছেন কাদের সিদ্দিকী।

অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভাঙন ধরেছে পুরনো জোট ২০ দলে। অলি আহমদ তার এলডিপি নিয়ে আলাদা প্ল্যাটফর্ম নিয়ে এগোতে চাইছেন। কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীমের পর বছর শেষে জামায়াতে ইসলামীকেও দেখা গেছে অলির সঙ্গে; অথচ এই জামায়াতের সঙ্গই কোনোভাবে ছাড়তে চাইছিল না বিএনপি।

সাংগঠনিকভাবে দলকেও সক্রিয় করতে পারেনি বিএনপি; সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের কাউন্সিল করতে গিয়ে উল্টো বিরোধ দেখা দেয়, যা নিয়ে ভাংচুর হয় বিএনপির কার্যালয়ও।

বিএনপির সঙ্কট আরও গভীর হওয়ার মধ্যে দলত্যাগ কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতার সংখ্যা বাড়ছে। এবছর দল ছেড়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তিনি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের দল পরিচালনা নিয়ে।

কমিটির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও এখন কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি; তবে দলটির নেতারা এজন্য রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশকেই দায়ী করছেন। 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা একটা প্রচণ্ড বৈরী ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে রাজনীতি করছি। আমাদের রাজনীতির যে স্পেস আমরা এখানে সেটা পাচ্ছি না। যার ফলে আমাদের যে স্বাভাবিক কার্যক্রম, তা আমরা পরিচালনা করতে পারি না।

“বেশিরভাগ জায়গায় আমাদের কাউন্সিল করতে দেওয়া হয় না। কোনো সভা কিংবা ঘরোয়া বৈঠক করলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।”

এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর-ভাবির কাজিয়া

প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু এবং তারপর দলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেবর জি এম কাদেরের সঙ্গে ভাবি রওশন এরশাদের কোন্দল, এরশাদপুত্র সাদ-এরিককে নিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল জাতীয় পার্টি।

বিএনপিবিহীন দশম সংসদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে একাদশ সংসদে বিএনপি ছাপিয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে।

সামরিক শাসক এরশাদের গড়া দল জাতীয় পার্টি এরশাদের দল হিসেবেই রাজনীতিতে পরিচিত। নানা সমালোচনার মধ্যেও দল পরিচালনায় তার ছিল নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। তিনি তার ইচ্ছেমতোই এই দল চালাতেন।

রওশন সমর্থকদের হুঁশিয়ার করে সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য রওশন ও কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, যা সামাল দিয়ে আসছিলেন এরশাদ।

রক্তে হিমোগ্লোবিন ও যকৃতের সমস্যা নিয়ে এরশাদ গত বছর থেকে হাসপাতাল আর বাড়িতেই সময় কাটাচ্ছিলেন। গত ১৪ জুলাই তার মৃত্যু হয়।

এরশাদের মৃত্যুর পর তার কবর কোথায় হবে, তা নিয়ে দলের নেতারা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। ঢাকায় দাফনের সিদ্ধান্ত হলেও লাশ রংপুরে নেওয়া হলে সেখানকার নেতাকর্মীরা তার মরদেহ রংপুরে রেখে দেন। পরে কবর সেখানেই হয়।

এরশাদের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তায় জমে উঠে জাতীয় পার্টির রাজনীতি।

তার মৃত্যুর তিন দিন পরে ঢাকায় ফিরে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিচ্ছেন জি এম কাদের।

সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হতে জি এম কাদের স্পিকারকে চিঠি দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রওশন এরশাদও পাল্টা চিঠি দেন স্পিকারের দপ্তরে।

চিঠি পাঠানোর পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন রওশন এরশাদ। সেদিন রওশন সমর্থকরা তাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।

নাটকীয়তা আরও চরম আকার ধারণ করে এরশাদের আসনে প্রার্থিতা নিয়ে।

রওশনের ছেলে রাহাগির আল মাহি সাদ এরশাদ ছাড়াও রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার। দলের মনোনয়ন না পেয়ে শাহরিয়ার পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সাদকে প্রত্যাখ্যান করেন রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা।

এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টি যখন স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত, তখন ৭ সেপ্টেম্বর রওশন ও কাদের শিবিরের নেতারা বসেন সমঝোতা সভায়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় আগামী কেন্দ্রীয় কাউন্সিল পর্যন্ত জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যানের পদে থাকবেন। রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধী দল নেতা হিসেবে থাকবেন, জি এম কাদের হবেন উপনেতা। আর রংপুরের এরশাদের আসনে প্রার্থী হবেন তার ছেলে সাদ।

জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রওশনের সঙ্গে সমঝোতার পর কাদেরের জন্য সমস্যা নিয়ে আসে তার আরেক ভাবি বিদিশা। এরশাদের সাবেক এই স্ত্রী জোর করে উঠে পড়েন প্রেসিডেন্ট পার্কে, যেখানে তার ছেলে এরিক থাকেন।

বিদিশার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে এরিকের কর্তৃত্ব পাওয়া এরশাদ তার সম্পদের অনেকটাই দিয়ে গেছেন তার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই ছেলেকে। সেই সম্পদ যেন কেউ না নিতে পারে, সেজন্য ট্রাস্টও তৈরি করে গেছেন তিনি।

নভেম্বরে এরিকের বাড়িতে ওঠার পর বিদিশা অভিযোগ তোলেন দেবর জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে; যদিও এক সময় রওশন-কাদের দ্বন্দ্বে দেবরের পক্ষেই দেখা গিয়েছিল বিদিশাকে।

বিদিশা বাড়িতে ওঠার পর ছেলে এরিক নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন চাচা জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে। থানায় জিডি করে তিনি জানান, মায়ের সঙ্গেই থাকতে চান তিনি।

তবে জি এম কাদের বলেন, “এরিককে দিয়ে এসব করানো হচ্ছে।”

বছরের শেষভাগে এসেও এ বিষয়টির কোনো মীমাংসা না হওয়ায় এরিক তার মা বিদিশাকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট পার্কেই থাকছেন।

এরমধ্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে এক অনুষ্ঠানে ‘মাদকাসক্ত’ বলে জাতীয় পার্টিকে বিপাকে ফেলে দেন দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। তাকে নিয়ে রুষ্ট হন জাতীয় পার্টির নেতারাও। পরে ক্ষমা চেয়ে পার পান তিনি।

প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর বছর শেষে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করে জাতীয় পার্টি। তাতে রওশন এরশাদকে সম্মানীয় একটি পদ দিলেও দল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জিএম কাদের নিজের হাতেই রেখেছেন।

আলোচনায় নেই অন্যরা

দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্তে বছরজুড়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান করতে পারেনি; উল্টো ভাঙনের মুখে পড়েছে কয়েকটি দল।

মহজোটের দলগুলো আওয়ামী লীগের ছায়া হয়েই থেকেছে, এরমধ্যে কংগ্রেস করতে গিয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিতে।

ক্যাসিনোকাণ্ডে মেননের নামও আলোচনায় আসার পর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জোটে থাকা নিয়ে বিরোধে বেরিয়ে গেছেন বিমল বিশ্বাসসহ পলিট ব্যুরোর সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ।

অলি আহমদ গড়েছেন নতুন প্ল্যাটফর্ম

বিএনপি জোটে টানাপড়েনের মধ্যে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি এবং প্রয়াত শফিউল আলম প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা ভেঙেছে। আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিম আলাদা এলডিপি গড়েছেন। আলাদা জাগপা গড়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান।

জামায়াতে ইসলামী থেকে বহিষ্কৃত মজিবুর রহমান মঞ্জু আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাতে দলটির সংস্কারপন্থি নেতারা জড়ো হচ্ছেন বলেও খবর এসেছে। এর আগে বিদেশে থাকা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুর রাজ্জাক দলত্যাগের ঘোষণা দেন।

আওয়ামী লীগ বিএনপির বলয়ের বাইরে থাকা বাম দলগুলো নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা চালালেও রাজনীতিতে এখনও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেনি।

বিতর্কের বিষয় গণতন্ত্র

পুরো বছরজুড়ে আওয়ামী লীগ শাসনে গণতন্ত্রই ছিল আলোচনার মূল বিষয়।

বিরোধীরা ক্রমাগত অভিযোগ করে গেছে, দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। মত প্রকাশের কোনো স্বাধানতা নেই।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি, গণতন্ত্র এখন নির্বাসনে। ছবি: সুমন বাবু

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কখনোই ছিল না। বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে ঠিক, তবে আজকের মতো এরকম পরিস্থিতি কখনোই আমরা দেখেনি। গত এক দশক ধরে এক ব্যক্তি ও এক দলের শাসন ব্যবস্থায় দেশ চালানো হচ্ছে।”

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, “নির্বাচনের আগের দিন রাতে ভোট ডাকাতি করে যে সরকারটি এখন ক্ষমতা দখল করে বসেছে, তারা নিজেরাই গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ওরা দলবাজেই পরিণত করা হয়েছে।”

একই রকম বক্তব্য বাম দল কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমেরও।

তিনি আরেকটু বাড়িয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমানে রাজনীতি কলুষিত হয়ে গেছে, রাজনীতিতে সুস্থ ধারা নেই।”

“রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ। যতদিন আমাদের এখানে লুটপাটের অর্থনীতি বজায় থাকবে, আপনি সুস্থ ধারার রাজনীতিও পাবেন না, সুস্থ ধারার পরিবেশও পাবেন না,“ বলেন তিনি।

তবে তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “আমরা আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে এক চাকার বাইসাইকেল মনে করি না, আমরা মনে করি দুই চাকার বাইসাইকেল। গণতন্ত্রকে আমরা শক্তিশালী করতে চাই।”

কাউন্সিলে শেখ হাসিনার সঙ্গে ওবায়দুল কাদের। ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

বিরোধীদের কথার জবাবে কাদের বলেন, “বিরোধী দলের প্রতি আমাদের টলারেন্স আছে। আমরা কখনও তাদের কোনো সভা-সমাবেশে প্রতিরোধ করি না। আমাদের পার্টি অফিসের সামনে আমাদের নেতাকর্মীরা আক্রান্ত করেছিল, সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়, তারপরেও আমরা পাল্টা আঘাত করিনি। আমরা সহিষ্ণুতা দেখিয়েছি।”

বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণুতা রয়েছে দাবি করলেও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সস্প্রীতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যে অভাব রয়েছে, তা ফুটে উঠেছে ওবায়দুল কাদেরের কথায়।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক জীবনে, সামাজিক জীবনে এবং পারিবারিক জীবনে আরও অনেক সেতু দরকার। আমাদের ওয়াল হচ্ছে, ব্রিজ তৈরি হচ্ছে না। আমি সকলের কাছে অনুরোধ করব, আসুন পোলারাইজড পলিটিক্স থেকে ফিরে আসি। আর ওয়াল নয়, আমাদের সেতু নির্মাণ করা দরকার।”

বিষোদগার চললে যে দূরত্ব আরও বাড়বে, সেকথাও বলেন ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক।

“আমাদের অনেকের মুখে মুখে ফরমালিনের মত বিষ। এই অবস্থা থাকলে ওয়ালই উঠবে, ওয়াল আরও উঁচুতে উঠবে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সাজিদুল হক, জয়ন্ত সাহা ও কাজী মোবারক হোসেন]