কিন্তু যাদের নামে পানশালা, স্টাম্প ওড়ানোর চেষ্টা তাদের খুব একটা ছিল না; বরং তারা চাইতেন ব্যাটসম্যানকেই উড়িয়ে দিতে!
হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোস। নিয়মিত যারা ক্রিকেটের খোঁজ খবর রাখেন, এ দুটো নাম শুনলে বাকিটা তাদের বুঝে যাওয়ার কথা।
অস্ট্রেলিয়ায় তারা ছিলেন খলনায়ক। তবে ইংল্যান্ডে ছিলেন নায়ক। আর নিজেদের কাউন্টি নটিংহ্যামে তারা দুজন কিংবদন্তি।
যে পানশালার কথা বলছি, সেটা নটিংহ্যাম কাউন্টি ক্লাবের মাঠ ট্রেন্ট ব্রিজ স্টেডিয়ামের একেবারে লাগোয়া। নাম লারউড অ্যান্ড ভোস। নিজেদের আঙিনায় লারউড-ভোস কতটা সম্মানিত ও জনপ্রিয়, এই পাব যেন তারই সাক্ষী।
নটিংহ্যামে বাংলাদেশ দল ছিল কেবল দুই দিন। ম্যাচের আগের দিন ও ম্যাচের দিনের ব্যস্ততায় অন্য কোনো দিকে তাকানোর ফুরসত ছিল না। ম্যাচের পরদিন সাউথ্যাম্পটন যাওয়ার আগে তাই ঢু মারলাম লারউড-ভোস পানশালায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নামের কারণেই ওই পাব আমাকে টেনেছে প্রবলভাবে। নামকরণের পেছনে গল্প আছে কিনা, লারউড-ভোসের কোনো স্মৃতিচিহ্ন, কোনো ছাপ বা নিদর্শন টিকে আছে কিনা, এসব জানার আগ্রহও ছিল।
আরেকটি ছবি আছে দুজনের খেলোয়াড়ি জীবনের। হয়তো বোলিং গোলায় প্রতিপক্ষকে ছারখার করে দুজন মাত্রই বেরিয়ে আসছেন মাঠ থেকে।
স্মৃতিচিহ্নের আক্ষেপ পাশে সরিয়ে রাখলে, স্রেফ পানশালা হিসেবে এটি দারুণ। পরিপাটি, সাজানো-গোছোনো। যে ক’টি খাবার পরখ করে দেখলাম, দারুণ সুস্বাদু।
লারউড-ভোসের স্মৃতির ছোঁয়া পানশালায় না থাকলেও এখানে বসে স্মৃতির সাগরে নিশ্চয়ই ডুব দেওয়া যায়! এরকমই কোনো একটি পাবে, ১৯৩২ সালের কোনো একদিন লারউড ও ভোসকে নিয়ে বসেছিলেন সেই সময়ের ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন। সঙ্গে ছিলেন তখনকার নটিংহ্যাম অধিনায়ক আর্থার কার। পরিকল্পনা চলছিল কাউন্টিতে সফল এক কৌশল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খাটিয়ে অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনায়।
সেই যুগে বাউন্সার দেওয়া বা এক পাশে বেশি ফিল্ডার রাখা, এসব নিয়ে কোনো নিয়মের বালাই ছিল না। ব্যাটসম্যানদের চরম পরীক্ষা নিয়ে ওই কৌশলে কাউন্টি ক্রিকেটে বেশ সফল হচ্ছিল নটিংহ্যামশায়ার।
ইংল্যান্ড অধিনায়ক জার্ডিন সেই কৌশল কাজে লাগাতে চাইলেন অ্যাশেজে। আগের অ্যাশেজেই (১৯৩০ সালে) ইংল্যান্ডে এসে এক সিরিজে ৯৭৪ রানের অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ে ইংলিশ বোলারদের তুলোধুনো করেন ডন ব্র্যাডম্যান। অস্ট্রেলিয়া সেবার সিরিজ জিতে নেয় ৪-১ ব্যবধানে।
নিজেদের মাটিতে ব্র্যাডম্যান ও অস্ট্রেলিয়া হয়ে ওঠার কথা আরও অপ্রতিরোধ্য। তাদের প্রতিরোধের উপায় খুঁজছিলেন জার্ডিন ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজের আগে। নটিংহ্যাম অধিনায়ক কারের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন, কাউন্টির ওই কৌশল অ্যাশেজে কীভাবে কাজে লাগানো যায়।
দুজনই ছিলেন বেশ গতিময়। পরিকল্পনা ছিল সহজ। লেগ সাইডে ছাতার মতো ফিল্ডিং সাজিয়ে ব্যাটসম্যানের মাথা, বুক, শরীর তাক করে একের পর এক গতিময় বাউন্সার ছুঁড়তে থাকো।
সেই যুগে হেলমেটের ভাবনাও আসেনি। এখনকার মতো পাঁজরের গার্ড, থাই প্যাড, আর্ম গার্ড ছিল না। কেবল অ্যাবডোমেন গার্ড, পাতলা প্যাড আর গ্লাভসই ছিল ভরসা। নিজেকে বাঁচাতে তাই এক পর্যায়ে বাটসম্যান ফাঁদে পা দেবেন, এই ছিল জার্ডিনের পরিকল্পনা।
সফরের শুরুর দিকে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ততটা দেখা যায়নি। পুরোদমে শুরু হয় অ্যাডিলেইডে তৃতীয় টেস্ট থেকে। শরীর বরাবর একের পর এক ডেলিভারিতে বুকে বল লেগে আহত হন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক বিল উডফুল, মাথায় আঘাত পান ওল্ডফিল্ড।
বিপজ্জনক ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানদের আহত করার পালা চলতে থাকে সিরিজ জুড়ে। শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। জার্ডিনের কৌশলও চলতে থাকে। সফলতাও ধরা দেয়।
ব্র্যাডম্যান এসবের মধ্যেও খারাপ করেননি। তবে আগের সিরিজে অতিমানবীয় ১৩৮ ব্যাটিং গড় এই সিরিজে নেমে আসে ৫৬.৬৭-এ। ইংল্যান্ড অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে ৪-১ ব্যবধানে জিতে।
অস্ট্রেলিয়ায় শুধু সমালোচিত নয়, ব্যাপক ঘৃণিত হয়েছিল সেই কৌশল। লারউডের বলেই ব্যাটসম্যানরা আহত হয়েছিলেন, ভুগেছিলেন বেশি। ক্রিকেটীয় চেতনাকে হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছিল জার্ডিস ও লারউডকে।
ব্র্যাডম্যান বলেছিলেন, “ব্যাটসম্যানদের দাপট কমানোর একটি পথ এটি বটে, তবে পথটা ভুল। রোগীকে মেরে ফেলা তো আর রোগ সারানোর উপায় হতে পারে না!”
বডিলাইন নিয়ে সমালোচনার ঝড় এতটাই ছিল যে ক্রিকেট ছাড়িয়ে দুই দেশে কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রবল টানাপড়েন চলে কিছুদিন। জার্ডিন-লারউড দেশে ফিরে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন অনেক সাক্ষাতকারে, কলামে, বইয়ে।
বডিলাইন সিরিজের পর ইংল্যান্ডেও তাদের কিছু সমালোচনা হয়েছিল। তবে নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে দুজনেই খেলে গেছেন। আগুন ঝরানো বোলিংয়ে ক্লাবকে এনে দেন অনেক সাফল্য।
বডিলাইন সিরিজের বিতর্কিত দুই চরিত্র তাই শেষ পর্যন্ত নটিংহ্যামের বড় নায়ক। লারউড-ভোস পানশালা যেন তাদের স্মৃতির প্রতি অর্ঘ্য।
সেই লারউড তার ৯০ বছরের জীবনের অর্ধেকই কাটান অস্ট্রেলিয়ায়, যেখানে তিনি ছিলেন প্রায় গণশত্রু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ব্যবসার প্রয়োজনে ১৯৫০ সালে তিনি পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৯৫ সালে মারা যান সেখানেই।
এই ছোট্ট পরিসরে বডিলাইন আখ্যানের সামান্যই তুলে ধরা যায়। লারউড-ভোস পানাশালায় কাটানো অল্প সময়টুকুও স্মৃতির সাগরে সাঁতার কাটার জন্য যথেষ্ট নয়। তখন যে আমার ফেরার তাড়া।