টনটনের রত্নভাণ্ডারে

টনটন কাউন্টি গ্রাউন্ডে ঢুকে প্রথম দিনই নজরে পড়েছিল ঘরটি। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ আমার প্রবল। তাই প্রেসবক্সের চেয়ে বেশি টানলো সেই ঘর।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2019, 06:09 AM
Updated : 19 June 2019, 04:04 PM

কিন্তু প্রবেশ দুয়ার যে বন্ধ! প্রতিদিন মাঠে ঢুকেই আগে ছুটে যাই সেই ঘরের কাছে। প্রতিবারই ফিরতে হয় দুয়ার থেকে।

অবশেষে সেই জাদুর ঘরের দুয়ার খুলল বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের মাঝ বিরতিতে। ‘সমারসেট ক্রিকেট মিউজিয়াম’ এই তৃষ্ণার্ত দর্শনার্থীকে স্বাগত জানাল ক্রিকেট ইতিহাসের পাঠ নিতে।

ঢুকতেই বা পাশে অভ্যর্থনা টেবিল। তার ঠিক পাশেই জোয়েল গার্নার। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি এখনই যেন ছুড়বেন তার বিষাক্ত ইয়র্কার!

সত্তর-আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত পেস ব্যাটারির অপরিহার্য জ্বালানি, ভয়ঙ্কর এই ফাস্ট বোলার নয় মৌসুম খেলেছেন সমারসেট কাউন্টি ক্লাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতো এই কাউন্টিতেও তিনি কিংবদন্তি। তাই জাদুঘরের মধ্যমণি হয়ে আছে তার বোলিং অ্যাকশনের প্রতিকৃতি।

৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার গার্নার ক্রিকেট ভুবনে পরিচিত ‘বিগ বার্ড’ নামে। কতটা ‘বিগ’ তিনি, তার প্রমাণ হিসেবেই যেন প্রতিকৃতির পাশে কাচের বাক্সে রাখা আছে তার একটি বুট। তার আকার অনুমান করতে পারেন?

আমাদের বোলার মুস্তাফিজুর রহমান ১২ সাইজের বুট পরেন, এ নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। আর বিগ বার্ডের জুতোর সাইজ ১৫!

পরম আন্তরিকতায় সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন জাদুঘরের কিউরেটর ডেভিড উড। তিনি বললেন, ‘ক্রিকেট ইতিহাসের কথা জানি না, তবে সমারসেটের ইতিহাসে এত বড় বুট পরে আর কেউ কখনো খেলেননি।”

চেনা রূপে ভিভ, মাত্রই যেন সীমানায় পাঠালেন বল

'বিগ বার্ড' গার্নার ছুঁড়ছেন বিষাক্ত ইয়র্কার

অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের সেই হেলমেট

ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফসহ নানা যুগের নানা ম্যাচের ব্যাট

 

গার্নারের ঠিক পেছনেই দেখা গেল এক পাশে আরেক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসকে। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শেষ কথা মানা হয় তাকে।

তার প্রতিকৃতিও ঠিক তেমনই! দারুণ এক স্কয়ার ড্রাইভে এই মাত্র যেন বাউন্ডারিতে পাঠালেন বল। ভক্তরা তাকে ডাকেন ‘কিং ভিভ’ নামে।

মাঠে তার চলনবলন ছিল রাজার মতোই। একেকটি শটে যেমন, তেমনি শরীরী ভাষাতেও যেন গুঁড়িয়ে দিতেন বোলারদের।

চুইংগাম চিবুতে চিবুতে যখন মাঠে ঢুকতেন, প্রতিপক্ষ নাকি প্রমাদ গুণতে শুরু করত। ২২ গজে গিয়ে যখন স্ট্যান্স নিতেন, বোলারদের শিড়দাঁড়ায় নাকি বয়ে যেত শীতল স্রোত, তীব্র গতির শট থেকে বাঁচতে ফিল্ডাররা গুটি গুটি পায়ে পেছাতে থাকতেন।

সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন রাঙিয়েছেন সমারসেটের ক্রিকেটও। টনটন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি গেটও আছে ভিভের নামে।

গার্নার, ভিভ ও আরেক ভয়ডরহীন ক্রিকেটার, ইংলিশ কিংবদন্তি ইয়ান বোথাম মিলে একসময় দাপটে খেলেছেন সমারেসেটে। এই ত্রয়ীর সময়েই ইতিহাসের সেরা সময়টা পার করেছে এই কাউন্টি ক্লাব।

সমারসেটের নেতৃত্বের মালা পেয়েছিলেন যারা

এমন ক্যাপ, গ্লাভস পরেই একসময় খেলতেন ক্রিকেটাররা

কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকা বল

প্যাড, ব্যাটিং গ্লাভম, কিপিং গ্লাভসের বিবর্তন

 

১৯৭৩ থেকে ১৯৮৭ সময়টাকে বলা হয় সমারসেটের ‘গ্লোরি ইয়ার্স।’ ওই সময়টায় তারা জিতেছে দুটি ওয়ানডে কাপ, দুটি বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ, একটি ন্যাশনাল লিগ।

কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ এই ক্লাব কখনো জেতেনি। কিন্তু মাঝারি একটি কাউন্টি দলকে সমীহ জাগানিয়া শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গার্নার, ভিভ, বোথাম।

গ্লোরি ইয়ার্সের তিন নায়কের পাশাপাশি জাদুঘরটি ধারণ করে আছে ক্রিকেটের আরও অনেক গৌরবময় স্মারক। ঘরটি নিজেই অবশ্য একটি ইতিহাস, বয়স ৫০০ বছর!

কালের সাক্ষী হয়ে থাকা ঘরটিকে ক্রিকেট জাদুঘরের রূপ দেওয়া হয় ১৯৮৯ সালে। ২০১২ সালে সংস্কারের পর বর্তমান নান্দনিক চেহারা পায় জাদুঘর।

কক্ষটিকে জাদুঘরে পরিণত করার সময় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল শত শত বছরের পুরোনো পশুপাখির হাড় ও কিছু নিদর্শন। ক্রিকেট সরঞ্জামের পাশাপাশি সেসব নির্দশনের কিছু জায়গা পেয়েছে একটি কোণায়।

নিশ্চিত তথ্য যেটুকু পাওয়া গেছে, সমারসেটে সবচেয়ে পুরোনো ক্রিকেট ম্যাচটি হয়েছিল ১৭৫১ সালে। প্রথম ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২৫ সালে। আর এখনকার এই সমারসেট কাউন্টি ক্লাব যাত্রা শুরু করে ১৮৭৫ সালে।

জন্ম থেকে শুরু করে ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলা, মাইনর কাউন্টি থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা, সব ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে জাদুঘরে লেখায় ও কিছু দুর্লভ ছবিতে।

শুধু সমারসেট ক্রিকেটের নয়, জাদুঘরে আছে যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে পাওয়া অনেক ক্রিকেট স্মারক।

কিউরেটর উড গর্বিত কণ্ঠে বললেন, “যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারো, কিংবা গুগলে গিয়ে দেখো, আমাদের জাদুঘরকে বলা হয় গোটা ইংল্যান্ডের অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর।”

৫০০ বছর পুরোনো ঘর জাদুঘরে রূপ দেওয়ার সময় মাটি খুড়ে পাওয়া পশুর হাড় ও অন্যান্য নির্দশন

জাদুঘরের কিউরেটর ডেভিড উড

৮০ বছর পুরো প্রেস, একসময় মাঠেই ছাপানো হতো স্কোরকার্ড

মেয়েদের ক্রিকেটের বিবর্তনের গল্প

 

এ জাদুঘরে ক্রিকেট নিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোটি হল ১৮৭৭ সালে ক্লাব ম্যাচে ব্যবহৃত একটি বল। সেই শতকে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ব্যবহৃত আরও কিছু বল আছে কাচবন্দি হয়ে।

আলাদা করে নজর কাড়ল ফ্রাঙ্ক উলির স্মৃতি জড়ানো একটি বল। কেন্টের এই অলরাউন্ডার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে উইকেট নিয়েছেন ২ হাজারের বেশি। ১৪৫টি সেঞ্চুরিতে রান করেছেন প্রায় ৫৯ হাজার। শততম সেঞ্চুরির সময় যে বলটি খেলেছিলেন, সেটি সংরক্ষিত আছে এখানে।

পাশেই রাখা আরেকটি বল, যেটি দিয়ে ১৯০৩ সালে হ্যাটট্রিক করেছিলেন সমারসেট গ্রেট, বাঁহাতি স্পিনার বিউমন্ট ক্র্যানফিল্ড।

নানা সময়ে সমারেসেটে আসা বিভিন্ন ক্রিকেট দলের ব্যাট আছে অনেক। প্রায় প্রতিটিতেই আছে ম্যাচে খেলা দুই দলের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ।

যাদের কীর্তিতে রাঙানো ক্রিকেটের ইতিহাস, যাদের নামই আনন্দের অনুরণন তোলে মনে, তেমন অনেকের সই দেখলাম জাদুঘরে সংরক্ষিত ব্যাটে।

থমকে গেলাম একটি ব্যাটের সামনে। ওই তো, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের অটোগ্রাফ!

১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে আসা বিল উডফুলের অস্ট্রেলিয়া দলের ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর রয়েছে ওই ব্যাট।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের প্রতি দুর্বলতা আমার পুরোনো, ডালিমকুমার পড়ার দিনগুলি শেষ হওয়ার পর থেকেই আমার কাছে রূপকথার সবচেয়ে বড় নায়ক ডন ব্র্যাডম্যান। তারই হাতের লেখা!

১৯৩৪ সালের সেই সফরে ৫ টেস্টে ৯৪.৭৫ গড়ে ৭৫৮ রান করেছিলেন ব্র্যাডম্যান। প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগল ব্যাটের ওপর তার হাতের ছোঁয়া একটু ছুঁয়ে দেখার। কিউরেটরকে অনুরোধ করতেই অসহায় হাসিতে বুঝিয়ে দিলেন, উপায় নেই।

সেই খেদ পরমুহূর্তেই ভুলিয়ে দিল পাশে থাকা আরেকটি নিদর্শন। একটি প্রেস মেশিন!

বিস্ময় ভরা চাহনি দেখে কিউরেটর সহাস্যে বললেন, এটাও ক্রিকেট ইতিহাসের সাক্ষী। একসময় খেলার স্কোরকার্ড ছাপা হতো মাঠেই, আর সেই কাজটি হত এই প্রেস মেশিনে। ৮০ বছর বয়সে এখন সে অবসর কাটাচ্ছে জাদুঘরে।

সফলদের স্বীকৃতি

সমারসেটের প্রতিষ্ঠা ও এগিয়ে চলা

ক্লাবের সাফল্যের নানা স্মারক

জাদুঘরের এক প্রান্তে লাইব্রেরি

১৯৯৮ সালে প্রিসেন্স ডায়নার স্মরণে লর্ডসে আয়োজিত এমসিসি বনাম রেস্ট অব দা ওয়ার্ল্ড ম্যাচের দুই দলের ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর করা ব্যাটও সমৃদ্ধ করেছে সংগ্রহশালাকে। সেই ম্যাচে রেস্ট অব দা ওয়ার্ল্ডের হয়ে খেলেছিলেন শচিন টেন্ডুলকার, সনাৎ জয়াসুরিয়া, অরবিন্দ ডি সিলভা, ওয়াসিম আকরাম, সাঈদ আনোয়ারের মতো তারকারা।

চোখ ধাঁধানো সেঞ্চুরি করেছিলেন টেন্ডুলকার। এমসিসির হয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন শিবনারায়ণ চন্দরপল, দলে খেলেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি, গ্লেন ম্যাকগ্রা, অ্যালান ডোনাল্ড, অনিল কুম্বলে, ইয়ান হিলিরা। সবার অটোগ্রাফই আছে ব্যাটে।

শত বছরের পুরোনো থেকে আধুনিক যুগের অনেক ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, হেলমেট, ক্যাপ, হ্যাট, স্টাম্পস, বুট ও পোশাক রাখা আছে সাজিয়ে। তাতে যুগে যুগে ক্রিকেট সরঞ্জামের বিবর্তনের চিত্রটাও স্পষ্ট হচ্ছে চোখের সামনে। পুরোনো বলগুলোর সিম বরাবর বাঁধা আছে ইস্পাতের পাত, যাতে টিকিয়ে রাখা যায়।

দোতলায় একটি প্রান্ত জুড়ে কেবল মেয়েদের ক্রিকেটের স্মারক। আছে পুরোনো থেকে নতুন অনেক নজীর। দোতলার একটি পাশে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সমারসেটের সব অধিনায়কদের ছবি। এক প্রান্তে আছে ছোট্ট একটি লাইব্রেরি। পাশেই টেবিল-চেয়ার, বই পড়ার আয়োজন।

ক্রিকেট ইতিহাসের অলি-গলিতে আনন্দময় বিচরণে কাটছিল সময়। হঠাৎ পাশেই মাঠ থেকে ভেসে এলো দর্শেকের গর্জন। নিশ্চয়ই ছক্কা! তামিম ইকবাল নাকি সৌম্য সরকার? মন না চাইলেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকা আনন্দ ঘর থেকে বের হতেই হলো। আবেগকে পাশে রেখে ছুটতে হলো পেশার তাগিদে। মনে লেগে থাকল অদ্ভুত ভালো লাগার রেশ।

পুরোনো একটা হাহাকারও মনের গভীরে নাড়া দিল নতুন করে। বাংলাদেশে এমন কিছু আদৌ কখনও হবে?