হয়ত পায়ে একটু টান কিংবা হাতে ব্যথা, পিঠে আড়ষ্টতা নয়ত পেশীতে হালকা খিঁচুনি, ক্রীড়া ইনজুরির পরিভাষায় এসবকে বলা হয় ‘নিগলস।’ আক্ষরিক বাংলা করা কঠিন। টুকটাক চোট বা ছোটোখাটো আঘাত বলা যেতে পারে। নিগলস অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু অনিবার্য। কিছু না কিছু প্রায় সবসময়ই থাকে।
ড্রেসিং রুমে সেদিনের আলোচনা ছিল এই বাস্তবতা নিয়েই। আয়ারল্যান্ড থেকে শুরু করে বিশ্বকাপের শেষ পর্যন্ত প্রায় আড়াই মাসের সফরে বেরিয়েছে বাংলাদেশ। অপ্রিয় সঙ্গী নিগলস এই লম্বা পথচলায় সঙ্গ দেবে জোর করেই। এগিয়ে যেতে হবে এসবকে পাত্তা না দিয়ে। জয় করতে হবে কষ্ট স্বীকার করে। শরীরের ফিটনেস সেজন্য যতটা জরুরি, তার চেয়েও ভালো হতে হয় মনের ফিটনেস।
তরুণদের নিয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদের আলোচনায় মূল এজেণ্ডা ছিল মনের জোর বাড়ানো।
গোলমালটা পাকিয়েছে এবার আয়ারল্যান্ড সফর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ছেলেরা প্রথম ট্রফি জিতেছে এই টুর্নামেন্টে। তবে আইরিশ আবহাওয়ার ছোবল দাগ রেখে গেছে প্রবলভাবেই। সেখানে খেলার আগে গা-গরম করলেও থাকত না বেশিক্ষণ। ফিল্ডিংয়ের সময় কিছুক্ষণ বল না এলেই তীব্র ঠাণ্ডা ও বাতাসে জমে যেত শরীর। এরপর হুট করে বল এলে ছুটতে গেলেই অনেক সময় হয়ে গেছে বিপত্তি। লেগে গেছে টান বা চোট। অনেকেই ছিলেন ফিজিওর রুমের নিয়মিত বাসিন্দা! সেই ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেশ কজন ক্রিকেটার। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো আসরে নিগলসের কাছে তো অসহায় হলে চলবে না!
একসময় এসব ঘটা করে আলোচনার প্রয়োজন পড়ত না। নিগলসই ছিল নিয়তি, প্রায় সব ক্রিকেটারই এসব নিয়ে খেলেছেন। ম্যাকেঞ্জির মতো ব্যাটসম্যানরাই শুধু নয়, নিগলস বেশি থাকত ফাস্ট বোলারদের, সেসব নিয়েই তারা খেলতেন ম্যাচের পর ম্যাচ।
একটি উদাহরণ দিতে চাইলেও সবার আগে বলতে হবে কপিল দেবের কথা। ১৩১টি টেস্ট খেলেছেন প্রায় ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, চোটের কারণে মিস করেননি একটি টেস্টও! পেস বোলিং অলরাউন্ডার ছিলেন, নিগলস নিশ্চয়ই লেগেই থাকত। তার শৌর্য্যের কাছে পাত্তা পায়নি নিগলস।
কপিলের মতোই লম্বা দৌড়ের ঘোড়া ছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। কপিলের গড়া টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড ভেঙেছিলেন তিনিই। খেলেছেন ১৩২ টেস্ট। অনেকের মতে, ক্রিকেট ইতিহাসে আর কেউ এমন গতিময় বোলিং এতটা লম্বা স্পেলে করতে পারেননি। ক্যারিবিয়ান পেস কিংবদন্তি গত প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা তাকে ডাকেন ‘মাস্টার’ বলে। মাস্টার তার ছাত্রদের অসংখ্যবার শুনিয়েছেন, প্রায় ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে কতশত নিগলসকে পাত্তা না দিয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে গেছেন। উদাহরণ দিয়েছেন তার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সতীর্থদের টেনে, কাউন্টি দলের সতীর্থদের গল্প শুনিয়ে।
এখনকার তরুণ ক্রিকেটারদের অনেকের কাছে সেসব গল্প মনে হয় রূপকথা। অনুশীলন, জিম, ট্রেনিং এখন যে কোনো সময়ে চেয়ে বেশি আধুনিক। এসব নিয়ে গবেষণা চলে বিস্তর। সচেতনতা বাড়ছে ক্রমেই। অথচ আধুনিক ক্রিকেটাররাই হয়তো অল্পতে কাবু হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। নিগলসের কারণে বোলিংয়ের কোটা পূরণ না করা, ব্যাটিং শেষ না করা, এমনকি ম্যাচ না খেলা, এখন নিত্য দিনের ঘটনা।
সবাই অবশ্যই নয়। ব্যাটিংয়ের মতো ফিটনেস দিয়েও বিশ্ব ক্রিকেটকে নাড়া দেওয়া বিরাট কোহলি এখানেও হতে পারেন আদর্শ উদাহরণ। এই বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়া সফরে একটি ইনিংসে তার ব্যাটিংয়ে খানিকটা অস্বস্তির ছোঁয়া দেখে পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন হলো কোনো নিগল আছে কিনা। কোহলি সহাস্যে বলেছিলেন, “এটা তো নতুন কিছু না। গত ৮ বছর ধরেই আমি নানারকম নিগলস নিয়ে খেলছি। আমি সামলে নিতে পারি, কারণ প্র্যাকটিসে সেই পরিশ্রম আমি করি। আরও নতুন সমস্যা হলে সেটাকে সামলানোর পথও বের করে ফেলব। কারণ নিগলস ছাড়া থাকা অসম্ভব। টুকটাক কিছু না কিছু থাকবেই। স্রেফ সামলাতে জানতে হবে।”
বিশেষ করে এই দফায় অধিনায়ক হওয়ার পর গত সাড়ে চার বছরে, কোনো ধরনের চোটের কারণেই কোনো ম্যাচ মিস করেননি মাশরাফি।
চোট জর্জর ক্যারিয়ারের আরেক ক্রিকেটার অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফের কথাটি খুব মানিয়ে যায় মাশরাফির প্রসঙ্গে। ২০০৯ অ্যাশেজের আগে আক্ষেপ করে এই ইংলিশ অলরাউন্ডার বলেছিলেন, “আমার ক্যারিয়ারে নিগলস বলে কিছু নেই, ছিল না। সবই জেনুইন ইনজুরি।” মাশরাফিও বড় ইনজুরির সঙ্গে এত যুদ্ধ করেছেন, ছোট চোট-আঘাত পাত্তাই পায়নি।
এই যে টানা চার-পাঁচ বছরে কোনো ম্যাচই বাইরে রাখতে পারেনি চোট, একেবারেই কি হানা দেয়নি এই সময়ে? অনেকবারই দিয়েছে। হ্যামস্ট্রিং বা কুঁচকিতে টান ছিল প্রায় প্রতি সিরিজেই। কখনও সমস্যা ছিল পিঠে, কখনও অ্যাঙ্কেলে। তীব্র জ্বর, ডেঙ্গু পরবর্তী শারীরিক দুর্বলতাসহ নানা অসুস্থতা ছিল নানা সময়ে। বেশ কবারই মাঠে নামা ছিল সংশয়ে, ম্যাচের সকাল পর্যন্ত ছিল অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত সব সামলে খেলেছেনই।
অনেকবার ম্যাচের সকালেও খুঁড়িয়ে হেঁটেছেন। দেখে কল্পনাও করা ছিল কঠিন যে একটু পর ম্যাচ খেলতে নেমে যাবেন। মাঠে নেমে ঠিকই দাপুটে পদচারণায় লড়াই করেছেন। ম্যাচ শেষে হয়ত আবার ভেঙে পড়েছেন, ব্যথায় চিৎকার করেছেন, অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁচকে গেছে চোখমুখ। পরের ম্যাচে আবার ঠিকই মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।
এই লেখা যখন লিখছি, তখনও চোখে ভাসছে দিন তিনেক আগের দৃশ্য। মঙ্গলবার কার্ডিফে ভারতের বিপেক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ শেষে যখন হোটেলে ফিরলেন, মাশরাফি হাঁটছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাম হ্যামস্ট্রিংয়ে টান ছিল আগে থেকেই, ওই ম্যাচে টান লেগেছে ডান হ্যামস্ট্রিংয়েও। ব্যথার তীব্রতায় তার শরীর কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। ফিজিও তিহান চন্দ্রমোহন পরীক্ষা করে বললেন, অন্তত ৫-৬ দিনের বিশ্রাম লাগবে। মাশরাফি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘পাগল নাকি? চার দিন পর ম্যাচ না!”
নিজেকে তিনি চেনেন, মনের জোর জানেন। একেবারেই খেলার মতো অবস্থায় না থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু এসব নিগলস তার সঙ্গে জিততে পারবে না। শরীরের ঘাটতি কিছুটা থাকলেও সেটি পুষিয়ে দেবেন মনের শক্তি আর অভিজ্ঞতা দিয়ে। তরুণদের অতটা অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু মনের জোরে আরও এগিয়ে থাকার কথা। তারুণ্যেই তো স্পর্ধারা নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি!
রোববার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন ও মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে দুর্ভাবনা আছে খানিকটা। বিশ্বকাপের দীর্ঘ পথচলায় এই বাস্তবতা আসতে পারে রুবেল হোসেন বা আবু জায়েদ, বা যে কারও সামনে। সত্যিই ঝুঁকির হলে বা আনফিট থাকলে অবশ্যই ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি হয় এসব টুকটাক নিগলস, সেখানে একটি কথাই হতে পারে প্রযোজ্য, “শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে, তাই সয়!”