সৌদি আরবের ডেইরি ফার্ম ‘আলমারাই’ ভ্রমণ

সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে আল খারজ এলাকার মরুভূমিতে অবস্থিত ‘আলমারাই’ কোম্পানির ডেইরি ফার্ম। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধজাত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এটি।

মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, রিয়াদ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2022, 09:38 AM
Updated : 22 June 2022, 09:38 AM

সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে এ কোম্পানির আরও কয়েকটি ডেইরি ও পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। কোম্পানির আমন্ত্রণে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৮ জুন আমরা রওনা দেই ফার্মটি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে যারা থাকেন তারা প্রায় সবাই এ কোম্পানির পণ্য সম্পর্কে কমবেশি জানেন। কারণ আলমারাই কোম্পানির দুধ, দই, লাবানসহ অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য সৌদি আরবে অনেক জনপ্রিয়। এছাড়া এ কোম্পানির বিভিন্ন প্রকার জুস বাজারে রয়েছে। প্রতিবছর হজ ও ওমরা পালনের জন্য যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি সৌদি আরব আসেন তারাও সবাই কমবেশি আলমারাই কোম্পানির পণ্যের সঙ্গে পরিচিত।

ফার্ম পরিদর্শন করছেন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী

আমরা রিয়াদের ডিপ্লোম্যাটিক কোয়ার্টারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সকাল ৮টার দিকে রওনা দিয়ে প্রায় ১০টার দিকে আলমারাই ফার্মের গেটে এসে পৌঁছলাম। এখানে আসার পর কোম্পানির কর্মকর্তারা আমাদের স্বাগত জানান। কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ফার্ম ম্যানেজার লি আমাদের স্বাগত জানান। আমাদের গায়ে অ্যাপ্রোন পরিয়ে স্যানিটাইজ করে একটি মিনিবাসে তুলে ফার্মের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় পঞ্চাশোর্ধ ফিলিপাইনি লিকে দেখলে মনে হয় ত্রিশ বছরের যুবক। অ্যানিমেল সাইন্সে স্নাতক লি সৌদি আরবে কাজ করছেন প্রায় ত্রিশ বছর। তিনি জানান, আলমারাই কোম্পানির বেশ কয়েকটি ডেইরি ফার্ম সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে, তার মধ্যে আল খারজের এ ফার্মে গরুর সংখ্যা ৩৫ হাজার। যেখান থেকে প্রায় ১৯ হাজার গরু প্রতিদিন গড়ে ৪২ লিটার দুধ দেয়, দিনশেষে প্রায় ৭ লাখ ৮২ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয় এ ফার্ম থেকে।

আলমারাই কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দূতাবাসের কর্মকর্তারা

এ ফার্মে আমেরিকার হলস্টেইন জাতের গরু রয়েছে, যাদের আর্টিফিশিয়াল ইনসিমনেসনের মাধ্যমে গর্ভধারণ করানো হয় ১৪ মাস বয়সে। তারপর বাছুর আসার পর শুরু হয় দুধ দেওয়া, প্রতিদিন চারবার দুধ সংগ্রহ করা হয়। দুধ দেওয়া শুরু হলে গরুগুলো প্রায় ৬-৮ বছর একটানা দুধ দিতে থাকে। বাছুরগুলো সেভাবে মায়ের দুধ খাবার সুযোগই পায় না, কারণ জন্মের কিছু সময় পরই তাদের আলাদা করে ফেলা হয় এবং তাদের দেওয়া হয় নিউ জিল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ গুড়ো দুধ, যাতে তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে। এসময় বাছুরদের শিং তুলে ফেলা হয়, যাতে বড় হয়ে শিং-এর আঘাতে অন্যান্য গরু আহত না হয়।

ফার্মের ভেতরে আমি

দুধ দেওয়া গরুগুলোকে আলাদা করে রাখা হয়, যেন প্রতিদিন খুব সহজেই চারবার দুধ সংগ্রহ করা যায়। তাদের শেডের নিচে থাকে বিশেষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যাতে বাইরে তাপমাত্রা বাড়লেও ভেতরের তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রির মধ্যেই থাকে। তাদের খেতে দেওয়া হয় বিশেষভাবে তৈরি খাবারের মিশ্রণ যাতে পর্যাপ্ত খাদ্যমান বজায় থাকে। এছাড়া প্রচুর পানিও দেওয়া হয় যেন দুধের উৎপাদন অব্যাহত থাকে। প্রতিদিন চারবার নির্দিষ্ট সময়ে দুধ সংগ্রহ করা হয়, এক্ষেত্রে সময় খুব যথাযথ মেনে চলা হয়। কারণ দুধ সংগ্রহে দেরি হলে গরুগুলো যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে।

প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ ফার্মের ৩৫ হাজার গরুর জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হয় কয়েক টন খাবার। সৌদি আরবের হাইলে আলমারাই কোম্পানির গরুর জন্য ঘাস উৎপাদনের ফার্ম রয়েছে। এসব গরুদের দেওয়া হয় আলফা জাতের ঘাস। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসসহ কয়েক জায়গায় কোম্পানির জমি কেনা রয়েছে, যেখানে ঘাস উৎপাদন করে সৌদি আরব পাঠানো হয়।

গরুর দুধ সংগ্রহ ও তা ধাপে ধাপে বিশুদ্ধ করে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেয় পাশেই স্থাপিত সম্পূর্ণ অটোম্যাটিক কারখানায়। ডেইরি ফার্ম পরিদর্শন শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় এ অত্যাধুনিক কারখানায়। এখানে কারখানার প্রশাসনের প্রধান আলী আল কাহতানি আমাদের স্বাগত জানান। বাইরে তখন তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই। গলা শুকিয়ে কাঠ। আমাদের আলমারাইর বিভিন্ন প্রকার জুস ও দুগ্ধজাত খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, যা অনেকটা অমৃতের মতই লাগছিল খেতে।

এ কারখানায় স্বয়ংক্রিয় মেশিনে পাস্তুরিত করে বোতলজাত করা হয় দুধ, এছাড়া দুধ থেকে উৎপাদন করা হয় দই ও লাবান। দুগ্ধজাত অন্যান্য পণ্য যেমন পনির, ক্রিম, বিভিন্ন প্রকার ফ্ল্যাভারড দুধ, ফ্ল্যাভারড লাবান ও দই তৈরি করে এ কোম্পানি। সৌদি আরব ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান ও মিশরে রয়েছে আলমারাই কোম্পানির ফ্যাক্টরি। যেখানে তাদের বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি হয়। এ কোম্পানির রয়েছে বিশাল সরবরাহ ব্যবস্থা, যার জন্য রয়েছে প্রায় ৮ হাজার রেফ্রিজারেটেড ট্রাক, যাতে সারা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ও তাদের পণ্য দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। কারণ এসব পণ্য দ্রুত পচনশীল, তাই গ্রাহকদের কাছে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়।

প্রিন্স সুলতান বিন মোহাম্মদ বিন সউদ আল কবিরের উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে মাত্র তিনশ ৫০টি গরু দিয়ে শুরু হওয়া এ কোম্পানির বিভিন্ন ফার্মে এখন গরুর সংখ্যা প্রায় এক লাখ নব্বই হাজার। যেখান থেকে প্রায় প্রতিদিন ৪ মিলিয়ন লিটারের বেশি দুধ সংগ্রহ করা হয়। আলমারাই কোম্পানি বছরে ১২ বিলিয়নেরও বেশি পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া তাদের পোলট্রি বিভাগের রয়েছে ২০০ মিলিয়ন চিকেন উৎপাদনের ক্ষমতা। এ কোম্পানিতে বর্তমানে প্রায় এক হাজার একশ বাংলাদেশি কাজ করেন।

রিয়াদে ফিরে আসার সময় তীব্র গরমের তাপ টের পেলাম, বাইরে তখনও প্রায় ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রা, শুধু গাড়িতে উঠার সময় যেটুকু রোদ গায়ে লেগেছিল তাতেই কিছুক্ষণ মাথা ঝিমঝিম করছিল। শনিবার দিনটি সবার বেশ ভালো কাটল। মরুর দেশে একটি সফল ডেইরি ফার্মের ব্যবস্থাপনা ও এর সফলতা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম।

মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম: প্রথম সচিব (প্রেস), বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ, সৌদি আরব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!