গত কয়েক মাস ধরে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন কারণে একাধিকবার বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছি। অটাম সেমিস্টারে আমার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ছিল একেবারে ভয়াবহ। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফিজিক্সের ওপর থেকে পুরোপুরিভাবে আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছিল।
আমার জীবনে প্রেম এসেছে ঠিকই কিন্তু কখনও সফলতার মুখ দেখে নি। এখন পর্যন্ত অনেক মেয়েকে সরাসরি ভালো লাগার কথা জানিয়েছি, কিন্তু সকলের কাছ থেকে নেতিবাচক উত্তর এসেছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাদু নামের এক ডেটিং অ্যাপের কল্যাণে আমার সাথে আলেনা নামক এক তরুণীর পরিচয় হয়। আলেনার জন্ম রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। বর্তমানে সে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভাতে বসবাস করছে।
বয়সে আমার চেয়ে আলেনা ছয় বছরের ছোট। রাশিয়াকে ঘিরে পশ্চিমা দুনিয়ায় বিভিন্ন ধরণের প্রোপাগান্ডার প্রচলন রয়েছে। পশ্চিমের লোকেরা রুশদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। বাস্তবে রুশরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত স্মার্ট ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তারা অনেকাংশে উষ্ণ হৃদয়ের এক জাতি। আলেনার বয়স ১৯ হলেও জ্ঞান-গরিমা ও বিচক্ষণতায় সে ৩০ বছরের একজন মানুষকে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
প্রেমে পড়লে মানুষের ব্যক্তিত্বের পুনর্জাগরণ ঘটে, মানুষ নিজেকে নতুন করে গড়তে শিখে। মানুষের মাঝে আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন আসে। যেমন- আপনার বাবা-মা আপনাকে শত চেষ্টা করেও সিগারেট কিংবা অ্যালকোহলের নেশা থেকে মুক্ত করতে পারবে না, কিন্তু আপনার গার্লফ্রেন্ড চোখের পলকে সেটা পারবে।
আবার কোনও কাজে আপনার মনোযোগ নেই, আপনার গার্লফ্রেন্ডের মোটিভেশনে চোখের পলকে আপনি দেখবেন ওই কাজে আপনার আগ্রহ ফিরে এসেছে।
আলেনার সাহচর্যে নতুন উদ্যোমে পুনরায় পড়াশোনা করতে শুরু করি। যার ফলাফলও এসেছে ইতোমধ্যে। এখন আর ফিজিক্সকে ভয় করি না। আলেনার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করেছি, তবে ঈদের ঠিক আগের দিন আলেনা আমাকে হতাশ করেছে।
আগামী এক বছর সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখতে চায়, এ সকল দেশের মাটি ও মানুষকে কাছ থেকে জানতে চায়।
আলেনার এ সিদ্ধান্তের ফলে আমি মানসিকভাবে আবারও ভেঙে পড়েছি। গত দুই রাত বিছানায় শুয়ে একা একা কেঁদেছি।
আমার জীবনে আশার প্রদীপ হয়ে যার আবির্ভাব, আচমকা সে প্রদীপ নিভে যাবে সেটা মানতে পারি নি। এবারের ঈদে তাই একসাথে বসনিয়া যাওয়া হলো না। যখন মন খারাপ থাকে, ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। ব্যাটম্যান বিগিন্স, ডার্ক নাইট এবং দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস এ তিনটি সিনেমা আমার মনে সব সময় আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি করে। ব্যাটম্যান আমার প্রিয় সুপার হিরো।
যখন চরম হতাশার মধ্যে ডুবে থাকি, তখন এ তিনটি সিনেমা থেকে মোটিভেশন খোঁজার চেষ্টা করি। কোনো ধরনের সুপার পাওয়ার না থাকলেও ব্যাটম্যান কেবলমাত্র তার অদম্য অধ্যবসায় আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে একজন সুপার হিরো।
খ্রিস্টান ধর্মের পরেই স্লোভেনিয়াতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ধর্ম ইসলাম। স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ বসনিয়া ও আলবেনিয়ার বংশোদ্ভূত। যুগোস্লাভিয়া শাসনামলে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, কসোভো ও মেসিডোনিয়া থেকে অসংখ্য অধিবাসী স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের অনেকে এ দেশে স্থায়ী হয়ে গিয়েছেন। বলকানের অধিবাসীদের নিয়ে আমার মাঝে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। এটা ঠিক যে, বলকানের অধিবাসীরা বেশ অতিথিপরায়ণ এবং আমাদের মতো তারা আবেগপ্রবণ। তবে তাদের মানসিকতার সাথে আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের মানসিকতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় যেটা অনেক সময় বেশ বিরক্তিকর।
ঈদের দিন ভোর পাঁচটার দিকে মসজিদে ছুটে গেলাম। ইউরোপের দেশগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করা হয়। যদিও এটা সরকারের স্বীকৃত কোনো মসজিদ নয়, স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা ফ্ল্যাট কিনে সেটাকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করলাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব সূুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করলেন। এরপর বসনিয়ান ভাষায় সূরা ইয়াসিনের তর্জমা সকলকে পড়ে শোনালেন। আনুমানিক সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঈদের জামাত শুরু হলো।
কোভিড মহামারীর কারণে দীর্ঘ দুই বছর ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ জামাতে পড়া সম্ভব হয়নি। তাই এবারের নামাজকে ঘিরে মুসল্লিদের মাঝে আলাদা এক উদ্দীপনা লক্ষ্য করলাম।
নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বসনিয়ার ভাষায় খুতবা দিলেন। বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে ওসমানী সাম্রাজ্যের হাত ধরে। এ সব দেশের মুসলিমরা শরীয়তের পরিভাষাকে ইঙ্গিত করতে আরবির পরিবর্তে বেশিরভাগ সময় তুর্কি শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন- অপরের প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে আমরা 'ঈদ মোবরক' ব্যবহার করি। কিন্তু আর এরা ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে 'বায়রাম শেরিফ মোবারেক ওলসুুন' শব্দগুলো ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তুরস্কের ভাষায় ঈদকে 'বায়রাম' বলা হয়।
ঈদ উপলক্ষে ছোট বাচ্চাদের ঈদ সেলামি দেওয়াটা মনে হয় গোটা পৃথিবীর মুসলিমদের একটি সাধারণ সংস্কৃতি। বলকান দেশগুলোতে এ ধরনের সংস্কৃতিকে বলা হয় 'বায়রাম বাংকা', যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে 'ঈদ ব্যাংক'। ছোট বাচ্চারা ঈদের দিন দলবেঁধে আশপাশের মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মুরব্বিরা তাদের নগদ অর্থের পাশাপাশি চকলেটসহ বিভিন্ন ধরনের উপহার দেন। বিনিময়ে শিশুরা বড়দের ডান হাতে চুমু দেয়।
এ বয়সে সেলামি নিতে বেশ লজ্জা লাগছিল, তাকে নোটটি ফেরত দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি সেটা ফেরত নেন নি। এ ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কোনওদিন এর আগে তাকে দেখিওনি। তারপরেও তিনি আমাকে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আবদ্ধ করেছেন।
‘'বাকলাভা' ও 'চেভাপি' ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে ঈদকে কল্পনা করা যায় না। ঈদ উপলক্ষে মসজিদের পক্ষ থেকে মুসল্লিদের জন্য ‘বাকলাভা’ পরিবেশন করা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের এ ডেজার্ট আইটেমটি অটোমানদের হাত ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর 'চেভাপি' হচ্ছে এক ধরনের কাবাব আইটেম।
নামাজ শেষে অন্যান্য মুসল্লিদের সাথে কোলাকুলি করলাম। বাসায় ফেরার পথে মুহাম্মার নামক এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো। মুহাম্মারের আদি নিবাস বসনিয়ার বিহাচ শহরে। মুহাম্মার আমাকে নিয়ে কাছের একটি কফিবারে গেলেন। আমরা একসাথে কফি খেলাম, সেই সাথে স্মৃতি হিসেবে সকলকে সাথে নিয়ে ছবি তুললাম।
মুহাম্মারের সাথে আরও অনেক মুসল্লি ছিলেন। সকলে বসনিয়া থেকে স্লোভেনিয়াতে আসা ইমিগ্র্যান্ট। বিল দিতে গিয়ে দেখি আগেই মুহাম্মার তা পরিশোধ করে দিয়েছেন। লেখালেখির সুবাদে আমার সাথে মোস্তাফিজুর রহমান নামক এক পুলিশ অফিসারের পরিচয় হয়েছিল। শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখন তিনি মিরপুরে তার বাসায় আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তার আতিথিয়েতা কোনোভাবে ভোলার নয়।
বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে, দাঁত থাকতে মানুষ তার দাঁতের মর্ম বোঝে না। বাস্তব জীবনে এ প্রবাদ বাক্যটিকে সবচেয়ে কাছ থেকে অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছি প্রবাস জীবনে পা রাখার পর। জীবন থেকে অনেক অনুভূতি কিংবা অনেক অভিজ্ঞতা আজ হারিয়ে গিয়েছে। বছর ঘুরে তাই ঈদ আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়লেও, ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে ঈদ খুব একটি আনন্দের কিংবা উদ্দীপনার বার্তা নিয়ে আসে না। ঈদ উপলক্ষে এখন আর কেউ নতুন জামা কিনে দেয় না। দেশে থাকতে বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এখন এ সব অতীত। ঈদ উপলক্ষে মা আজও জর্দা, ফিরনি ও লাচ্ছা সেমাই থেকে শুরু করে পোলাও, মুরগির রোস্ট ও ঝাল ঝাল গরুর মাংসসহ বিভিন্ন পদের রান্না করেন। কিন্তু তার ছেলে এসব খাবার আর চেখে দেখার সুযোগ পায় না।
ঈদের দিন মা খাবারের টেবিলে বসে তার কল্পনায় আজও আমাকে খুঁজে বেড়ান, তাই যখন তার সাথে কথা হয় তাঁর মাঝে এক ধরনের বেদনা খুঁজে পাই, যদিও সেটিকে তিনি সেভাবে প্রকাশ করেন না। ছোট বোন ও নানী থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের কথা এদিন ভীষণভাবে মনে পড়ে।
অতীতের ওই সব দিন আর ফিরে আসবে না, শুধু স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে আমার মস্তিষ্কে। দূর প্রবাসে ঈদের আনন্দ প্রস্ফুটিত হয় না, তারপরেও চেষ্টা করি একেবারে আশাহত না হতে। আলেনার আচমকা সিদ্ধান্তে একেবারে মুষড়ে পড়েছি। তবুও সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক!
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |