ইউক্রেইন যুদ্ধ: ছোট্ট জুনাইরা কোলে, আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশি এক ‘সিঙ্গেল মাদার’

মাত্র চার মাস বয়স ছোট্ট জুনাইরার। এখনো মুখের ভাষা ফোটেনি। দু-চারটা ধ্বনি কেবল উচ্চারণ করতে পারে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিজের বাড়ির বাইরে। ৭২ ঘণ্টা রাস্তায় থাকার কারণে অস্থির। মাকে যেন জিজ্ঞাসা করছে বাড়ি ফিরছে না কেন?

তন্ময় ইমরানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2022, 06:47 PM
Updated : 27 Feb 2022, 07:23 PM

জুনাইরার মা ৩৩ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি নারী তাকে একাই নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ ৭০০-৮০০ কিলোমিটার। তারপর আশ্রয় নিয়েছেন লিভভ শহরের সীমান্তবর্তী এলাকায় সোফিসকা এলাকায়। এখানে দুইদিনের জন্য একটি ইউক্রেনিয়ান পরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন।

প্রশ্ন করতে পারেন, মায়ের গল্পই কেন বলছি, বাবা কোথায়? আসলে জুনাইরার মা একজন ‘সিঙ্গেল মাদার’। বাংলাদেশি এই নারী ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভে প্রেমে পড়েছিলেন ভারতের কেরালার এক তরুণের।

মহামারীর মধ্যে মাত্র দুই মাসের প্রেম থেকেই জুনাইরার আগমনের পূর্বাভাস। যদিও ততোদিনে ভারতীয় সেই যুবক ফিরে গেছেন নিজের দেশে। আর ফিরে আসেননি ইউক্রেইনে। ঠিক সে পরিস্থিতিতে জুনাইরার বাংলাদেশি মা জানতে পারেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা।

এ বিষয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যখন জানতে পারি জুনাইরা আমার পেটে, তখন অনেক সময় গড়িয়ে গিয়েছে। আমি কেরালায় ফোন দিয়ে ওর বাবাকে জানাই। ও বলে, কোনওভাবেই এর দায়িত্ব নেবে না। বরং তার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে ভয় পেয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেই একলা পথ চলার। জুনাইরার জন্ম ২০২১ সালের অক্টোবরে।”

“আমি ওকে পেটে নিয়েই অফিস করেছি ৯ মাস পর্যন্ত। অফিসের কলিগরা থেকে শুরু করে ডাক্তাররা পর্যন্ত খুব হেল্প করেছে আমাকে গত কয়েক বছর।”

তবে এসব নিয়ে ভারতীয় প্রেমিকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগের আঙুল তোলেননি জুনাইরার মা। বরং বারবার নিশ্চিত করতে চাইলেন, যেন কেরালার ওই যুবকের পরিচয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না পায়।

রাজধানী ঢাকার পাশেই জুনাইরার বাবা-মার বাড়ি। গণমাধ্যমে পুরোপুরি পরিচয় প্রকাশ করতে পারলেন না বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা বিবেচনায়। বললেন, মেয়ে ভারতীয় ছেলে বিয়ে করেছে, এখন আবার সিঙ্গেল মাদার- এটা বাংলাদেশে প্রকাশ হলে এখানে তার বাবা-মা সামাজিক সংকটে পড়তে পারেন।

তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে মাত্র মাকে জানিয়েছি জুনাইরার কথা। তারপর থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাবা এখনো জানেন না। ইউ নো, বাংলাদেশের কালচারে এটাকে কী দৃষ্টিতে দেখা হবে।”

ঠিক এ কারণেই আরেকটি ভয় ঢুকে গেছে জুনাইরার মায়ের মধ্যে- “কোনও কারণে যদি আমাকে জুনাইরাকে নিয়ে দেশে ফিরতে হয়, তাহলে আমাদের দুইজনেরই মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আমি এখনো ইউক্রেইনের নাগরিক নই। জুনাইরার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। মানে আমরা আসলে সময়ই পাইনি।”           

খোলাখুলিভাবে সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বললেন, “ইউক্রেইনে আমি ভালো চাকরি করি। কাজেই জুনাইরাকে নিয়ে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যত ছিল। এখানকার নিয়ম অনুযায়ী শিশু জন্ম দিলে কিংবা বিয়ের সূত্রে নাগরিক হওয়া যায়।"

“ইউক্রেইনের বাইরের কোনও দেশের নাগরিকের শিশু জন্মের এক মাসের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন এবং তিন-চার মাসের মধ্যে ওই শিশুর পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বা পাসপোর্ট মিলে। এরপর শিশুর বাবা-মা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন। জুনাইরার জন্ম নিবন্ধন আমি করিয়েছি। ওর নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট তুলতে যাই ২২ ফেব্রুয়ারি। ওরা আমার কাছে ১০ দিন সময় চায়। তারপর... ইউ নো- যুদ্ধ লেগে গেল।” 

শঙ্কার নিয়ে জুনাইরার মা বলেন, “পোল্যান্ডে তো আমরা অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারবো না। আমার ভয় হচ্ছে- যুদ্ধ যদি না থামে, আমাকে আর জুনাইরাকে হয়তো আশ্রয় নেওয়া তৃতীয় কোনও দেশের সরকার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবে!”

যে ইউক্রেনিয়ান পরিবারে দুইদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সম্পর্কে জুনাইরার মা বলেন, “এরা মাটির মানুষ। এই পরিবারের কর্ত্রী একজন পেডিট্রিশিয়ান এবং শিক্ষক, কর্তা নিজেদের ফ্যামিলি বিজনেস চালায়। এ দম্পতির দুইটি সন্তান। মেয়েটি তাদের নিজের এবং ছেলেটি পালক সন্তান।”

পোল্যান্ডেও জুনাইরাকে জন্ম দেওয়ার সুযোগ ছিল জানিয়ে তার মা বলেন, “ইউক্রেনিয়দের ভদ্রতায় আমি মুগ্ধ। এখানে জুনাইরাকে জন্ম দেওয়ার সময় টাকা-পয়সা তো লাগেইনি, বরং সবার কাছ থেকে পেয়েছি আন্তরিক সহযোগিতা।”

যুদ্ধ যদি না থামে তাহলে কোথায় যাবেন- সেটি এখনও পরিকল্পনা করতে পারেননি জুনাইরার মা। বললেন, “ভাবিনি, মাথা কাজ করছে না। মেয়েটার হাসি মুখ দেখে বারবার মনে হচ্ছে ওর তো কোনও দেশ হলো না! ওকি দেশ পাবে, বাড়ি পাবে?”

“আমার সঙ্গে আফ্রিকান এক বান্ধবী আছে। আমরা খুবই কাছের, একই সঙ্গে আছি আমরা । ওর জার্মানিতে পরিচিত আছে অনেক। পোল্যান্ড থেকে চেষ্টা করবো সেখানে যেতে। ওখানে আমারও বেশকিছু বন্ধু আছে।”

জুনাইরার মা বললেন, “আরবি ‘জুনাইরা’ শব্দের অর্থ ‘গাইডেন্স লাইট’। কী আজব দেখেন ওর বাবা ইন্ডিয়ান, মা বাংলাদেশি আর ওর কোনও দেশই নেই এখন।”

জুনাইরার কিছু ছবি মেসেঞ্জারে দিলেন তিনি। বললেন, “দেশ পাবে আমার মেয়ে। হতে পারবে সত্যিকারের গাইডেন্স লাইট!”