বাবা রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পাওয়ায় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের ক্ষোভ প্রকাশ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, গীতিকার এবং কণ্ঠযোদ্ধা হরলাল রায়ের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার সন্তান ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2022, 03:38 PM
Updated : 12 Feb 2022, 03:38 PM

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সপরিবারের বসবাসরত রথীন্দ্রনাথ রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো অনশনের হুমকি দিতে পারছি না বলেই কি স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা সত্ত্বেও আমার বাবা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-গীতিকার-কণ্ঠশিল্পী হরলাল রায় জাতীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।”

নিজে ভাওয়াইয়া গানে ১৯৯৫ সালে একুশে পদক পেলেও তার বাবা হরলাল রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও সাহসী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও বিস্মৃত হতে চলেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

হরলাল রায় চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া সত্ত্বেও পেশা হিসেবে বেছে নেন সংগীত এবং অভিনয়কে।

অবিভক্ত ভারতের নীলফামারীর সুবর্ণখুলী গ্রামে ১৯৩২ সালে জন্ম হরলাল রায়ের। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদারদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর তৎপরতার খবর ছড়িয়ে পড়লে হরলাল রায় রচনা করেন গান- ‘কারবা বিচার কাঁইবা করে রে…’। গানটি তিনি নিজেই সুর দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে পরিবেশন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণাদানকারী ‘ফাঁন্দে পড়িয়া ইয়াহিয়া কান্দে রে', 'আজি কান্দেরে ওই পরাণ', 'জ্বলছে জ্বলছে দেশ আমার জ্বলছে', ‘পাঠান মিয়া ইয়াহিয়া খান জয় বাংলা করিলো শ্মশান-নরনারী হত্যা করে হাজার হাজার শিশু-সন্তান’, ‘জয় বাংলার শুনরে খবর এমন সোনার বাংলা ধ্বংস করলো নূরল আর টিক্কা মীরজাফর’ ইত্যাদি গান ছিল হরলাল রায়ের লেখা।

শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন, “বাবা পরলোক গমন করেছেন ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর। জীবিত অবস্থায় রাষ্ট্রীয় কোনও সম্মানই তার ভাগ্যে জোটেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণতাপূর্ণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরায় আশায় বুক বেঁধে রয়েছি বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবো বলে। অনেকেই মরণোত্তর সম্মান লাভে সক্ষম হলেও হরলাল রায়ের মত একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের নাম এখন পর্যন্ত একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকের মনোনয়ন তালিকায় ওঠেনি।”

হরলাল রায় (বামে) এবং রথীন্দ্রনাথ রায় (ডানে)।

তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, “কী হলো যে ৫০ বছরেও হরলাল রায়ের মতো অসাধারণ একজন সাহসী যোদ্ধার নাম আসেনি রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য?” রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার যে যোগ্যতা তার মাপকাঠি কী? যারা রয়েছেন তালিকা করার দায়িত্বে তাদের গোচরে কী হরলাল রায় নেই?”

সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের পর বগুড়া মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন হরলাল রায়। এই স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে তিনি চিকিৎসক হিসেবে সনদপত্র পান।

ওই বছরেই রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় তুলসীদাস লাহিড়ির ‘দুঃখীর ইমাম' নামের একটি নাটক শিশিরকুমার ভাদুরী মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নেন। তুলসীদাস এ নাটকের জন্য রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করে দেন। এ নাটককে কেন্দ্র করে হরলাল রায় কানন বালা, প্রমথেশ বড়ুয়াসহ অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে রংপুরের আঞ্চলিক উচ্চারণের প্রশিক্ষণ দেন।

পরে তুলসীদাস লাহিড়ির সহায়তায় মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে হরলাল রায়ের দুইটি ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভাজনের সময় তিনি রংপুরের নিজগ্রামে ফিরে আসেন। ১৯৫৪ সালে তিনি তৎকালীন 'রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা' কেন্দ্রে ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী হিসেবে যোগ দেন।

এ বছর থেকেই তিনি ঢাকায় বসবাস করা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে 'পাকিস্তান পাইলট টেলিভিশন সার্ভিস' শুরু হলে, তিনি টেলিভিশনের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্রের গান গাওয়া শুরু করেন। এর ভিতরে 'জোয়ার এলো', 'নদী ও নারী', 'কাচ কাটা হীরে', 'ধারাপাত' ছবিতে গান গেয়ে প্রশংসা অর্জন করেন।

বাবা সম্পর্কে রথীন্দ্রনাথ রায় জানান, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুত্র রথীন্দ্রনাথ রায়কে নিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগ দেন। এই সময় তিনি বেশ কিছু গান লেখেন এবং তাতে সুর দেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন।

এছাড়া তিনি ভারতীয় পরিচালক রাজেন তরফদারের 'পালঙ্ক' এবং ঋত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা পান হরলাল রায়।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ হরলাল রায়ের ১০টি গানের রেকর্ড প্রকাশ করেছিল।