ভ্রমণ কাহিনি: মৃত্যু উপত্যকায় দুটি দিন
মোহাম্মদ ইশতিয়াক রহমান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 13 Jan 2022 11:30 AM BdST Updated: 13 Jan 2022 11:30 AM BdST
-
-
ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে আমি ও আমার স্ত্রী
-
-
-
পাগলাটে এক শহর থেকে যাত্রা শুরু। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের এক বছর ছুঁইছুঁই, বেড়াতে বেরিয়েছি খানিকটা পড়াশোনার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে, আর খানিকটা সহধর্মিনীর চাপাচাপিতে।
যে পাগলাটে শহরের কথা বলছিলাম তার নাম লাস ভেগাস। নানা সিনেমা-বই পত্রে কতোই না দেখছি পড়েছি এ শহরের কথা। সারা দুনিয়ার বিনোদন রাজধানী, পাপের শহর (সিন সিটি) লাস ভেগাস। জুয়ার এ শহরে বিনোদন কেনার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই এ ভ্রমণকারী দম্পতির নেই। দুইদিন মনভরে লাস ভেগাসের চোখ ধাঁধানো আলো আর জুয়ার নেশায় মশগুল মানুষ দেখলাম, সে গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। সময় হলো মূল গন্তব্যে যাত্রা করার। জায়গার নামটা ভয়াল আর জাঁদরেল - ডেথ ভ্যালি।
যুক্তরাষ্ট্রে রেন্ট-এ-কার পরিসেবা বিশ্বমানের। গাড়ি নিজেকেই চালাতে হবে, কোনো ড্রাইভার সেবা নেই। যে কোন এয়ারপোর্টের সঙ্গে সমস্ত রেন্ট-এ-কার কোম্পানিগুলোর যৌথ একটা সেন্টারের মতো থাকে। রেন্ট-এ-কার আগে থেকে বুক করা ছিল। মিনিট পাঁচেকের ভেতর সব কাগজপত্র দেখিয়ে পেয়ে গেলাম গাড়ি। বুক করা ছিল ছোট সেডান গাড়ি, রিসেপসনিস্ট ভদ্রমহিলা সহাস্যে জানালেন, মাত্র দশ ডলার বেশি দিলেই পেতে পারি এসইউভি। নিয়ে ফেললাম এসইউভি দুইদিনের জন্য। আগেই জেনেছিলাম যে ডেথ ভ্যালিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না, তাই অফলাইন গুগল ম্যাপ নামানো ছিল। খাবার দোকানও ডেথ ভ্যালিতে অপ্রতুল, তাই পর্যাপ্ত পানি-খাবার কিনে যাত্রা করলাম।
রোমাঞ্চকর এ যাত্রা। পার্থিব এ সৌন্দর্য রূঢ় এক ভূপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, মনে এক ভীতির সঞ্চার করে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এ অপরূপ-মনোমুগ্ধকর-বিচিত্র সৃষ্টি মানুষের মনকে আদ্র করে, আর বেশি ঈশ্বর বিশ্বাসী করে। লাস ভেগাস শহরটা মাহাভে মরুভূমির ভেতর, আর ডেথ ভ্যালিও তাই। শহর পেছনে রেখে যখন প্রথম ডেথ ভ্যালির লাল লাল পাহাড়ের দিকে চোখ পড়লো তখন চোখ ফেরানো দায়। আপন মনে গেয়ে উঠলাম, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার পরে।’ মখমলের মতো রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি তরতর করে ডেথ ভ্যালির ভেতরে এগিয়ে চলেছে ততক্ষণে মনে মনে মেনে নিয়েছি যে, এমন চমৎকার রাস্তা আর পাহাড়ের ভেতর কখনও গাড়ি চালাইনি নিজে।

ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে আমি ও আমার স্ত্রী
ডেথ ভ্যালির পাহাড়গুলোতে যেন নানা জাতের রঙের খেলা। মূলত লাল-গোলাপি-হলুদ আর সামান্য বেগুনি-সবুজ-নীল। বিভিন্ন সময়ে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে এ এলাকায় নানা জাতের লোহা এবং ম্যাঙ্গানিজের লবণ জমা হয়। এসব লবণের রংই আসলে আমাদের চোখে ধরা পড়ে।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে ডেথ ভ্যালির দিকে আর দোকানপাট ঘরবাড়ির ঘনত্ব কমে আসছে। দেখতে দেখতে ডেথ ভ্যালির লাল পাহাড়গুলোর ভেতর ঢুকে পড়লাম। সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি শীত গরম কোনোটাই বেশি হওয়ার কথা না। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে, উদ্দেশ্য ছবি তোলা। যে দিকে তাকাই সেদিকেই যেন নতুন কিছু দেখছি। যে অ্যাঙ্গেল যে ভঙ্গিমায় ছবি তুলি না কেন ক্যামেরার কি সাধ্য এ সৌন্দর্যকে বন্দি করার!
অনেক কসরত করার পর ফটোগ্রাফ-পিপাসু সহধর্মিনীও রণে ভঙ্গ দিলো, অসম্ভব এ ছবি তোলার চেষ্টা। জানি দুইদিনের এ ভ্রমণ পরিকল্পনা ডেথ ভ্যালির জন্য নিতান্ত অপ্রতুল, কিন্তু অনেকগুলো স্পট কভার করার বাকি, তাই গাড়ি ছুটলো ডেথ ভ্যালির পথে।
ডেথ ভ্যালি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শুকনো, গরম ও সর্বনিম্ন বিন্দু। এ ভয়ানক শুষ্ক আর গরম আবহাওয়ার জন্য মাটিও তৈরি হতে পারে না এখানে। এমন চরম পরিবেশ মূলত আদি মার্কিন সোসান জনগোষ্ঠীর নিবাস ছিল। ১৯৪৮ সালে মার্কিন মুলুকের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে স্বর্ণখনি আবিষ্কার হতে থাকে আর দলে দলে মানুষ ভিড় করতে থাকে সোনার খনির সন্ধানে। এসময়ের পোশাকি নাম ‘গোল্ডরাস’। সেইসময় একদল উৎসুক স্বর্ণসন্ধানী ক্যালিফর্নিয়ার স্বর্ণখনিগুলোতে পৌঁছানোর পথ হিসেবে এ মাহাভে মরুভূমির ভেতরের এমন শুকনো ও গরম পথ বেছে নেয়।

জ্যাবরিস্কি পয়েন্টে থামলাম আমরা । ডেথ ভ্যালির অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান এটি। বোরাক্স আহরণকারী কোম্পানির এক কর্তার নামে এ জায়গার নাম। রাস্তায় অল্পস্বল্প গাড়ি চোখে পড়লেও এখানে অনেক মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ল। দেখলাম যে শুধু আমরাই না, সবাই এ সৌন্দর্যে মোহিত আর আপ্লুত। জ্যাবরিস্কি পয়েন্ট আসলে ফারনেস ক্রিক লেকের একটা অংশ। তবে এ লেকে পানি ছিল ৯ মিলিয়ন বছর আগে আর সেই সময় এর নিচে নানা জাতের পলিমাটি জমা হতে থাকে। এরপর এ এলাকার আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে থাকে আর জলাভূমি শুকিয়ে যায় ৫ মিলিয়ন বছর আগে। ভাবতে অবাক লাগে ৫ মিলিয়ন বছর আগের শুকিয়ে যাওয়া পলিমাটি চোখের সামনে। ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে রওনা হলাম, পরের গন্তব্য ‘ব্যাড ওয়াটার বেসিন’।
ব্যাড ওয়াটার বেসিন পুরো আমেরিকার ভেতর অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নিচে অনেকগুলো পাহাড়ের মাঝে একটা সমতল ভূমি যা আদতে একটা বেসিনের মতো জায়গা তৈরি করেছে। এটা উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে নিচু জায়গা। এখানে পৌঁছাতে প্রায় বেলা তিনটা বেজে গেছে। পার্কিং লটে পৌঁছে দেখলাম অনেক গাড়ি - একটা জমজমাট অবস্থা। গাড়ি থেকে নেমে চোখে পড়লো সতর্কবাণী, গরমকালে সকাল দশটার পর এখানে প্রবেশ নিষেধ। সময়টা শীতকাল, তাই সমস্যা হওয়ার কথা না। প্রায় মাইল পাঁচেক জায়গাজুড়ে এ জায়গা। এতো হাঁটা সম্ভব না, তবে কিছুদূর তো যাওয়া যেতেই পারে। দূরের পাহাড়ে চোখে পড়লো সমুদ্রপৃষ্ঠ কোথায় আছে তার চিহ্ন দেয়া আছে। এবার বুঝলাম যে কতটা নিচে আছি আমরা – প্রায় একটা ফুটবল মাঠের দৈঘ্যের সমান নিচে আছি। জায়গাটা আসলে লবণের ডিপো। দূর থেকে দেখলে তুষার বলে ভ্রম হয়। এ লবণের সমতলে প্রকৃতি মৌচাকের মতো বড়ো বড়ো ষড়ভুজ তৈরি করেছে যা দৃষ্টিনন্দন আর হাঁটার সময় এ শুকনো লবণে এক অদ্ভুত মচমচে আওয়াজ তৈরি হয়। চারদিকে মানুষের ছবি তোলার হিড়িকে শামিল হলাম আমরাও।

সারাদিনের ক্লান্তি ভর করেছে পুরো শরীরে। এক কাপ কফিও খেতে পারিনি সারাদিনে। এখনকার মতো গন্তব্য রাতের নিবাস একটা অখ্যাত মোটেলে। হোটেল-মোটেলগুলো আসলে ডেথ ভ্যালির বিভিন্ন গেস্ট টাউনে ছড়ানো ছিটানো। বালারাট, পানামিন্ট সিটি, গ্রিন ওয়াটার, ক্লোরাইড সিটি ইত্যাদি গেস্ট টাউন রয়েছে ডেথ ভ্যালির ভেতর। শহরগুলোকে গোস্টটাউনের মতো বিটকেল নাম দেওয়া হয়েছে, তার কারণ হলো গোল্ডরাস পরবর্তী সময়ে এ শহরগুলো মানুষ ছেড়ে দিতে থাকলে এগুলো পরিত্যাক্ত ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হতে থাকে। আমাদের মোটেলটা পানামিন্ট সিটির কাছাকাছি। সামান্য খেয়ে-দেয়ে এ ভুতুড়ে নগরীতে মোটেলের বাইরে পা না দেওয়াই শ্রেয় মনে হলো।
পরের দিনের প্রথম গন্তব্য ‘আর্টিস্টস ড্রাইভ’। এটা একটা ৯ মাইল লম্বা সাপের মতো আঁকাবাঁকা একমুখী রাস্তা। বহু বছর আগের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বেরিয়ে আসা লাভাগুলো লাল-হলুদ-কমলা-বাদামি-নীল-সবুজ নানা জাতের রং তৈরি করেছে – ঠিক যেন শিল্পীর হাতে রঙের প্যালেট। এ অনন্য ভূপ্রকৃতির অদ্ভুত রূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও অন্যায়। অনেকে দেখলাম এ রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছে বা হাইকিং করছে। রাস্তার মাঝে মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি ভিডিও ধারণের নিষ্ফল চেষ্টা করা হলো বারবার।
দান্তেস ভিউ ডেথ ভ্যালি পর্যবেক্ষণের একটি চমৎকার আউটলুক পয়েন্ট এবং ফাটোগ্রাফারদের খুব পছন্দের স্থান। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু থেকে ব্যান্ড ওয়াটার বেসিন দেখলাম। চোখে পড়লো বিখ্যাত ব্ল্যাক মাউন্টেন। শুনেছি এ দান্তেস ভিউ রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য এক চমৎকার জায়গা। কিন্তু সে উপায় তো নেই আমাদের। দান্তেস ভিউ থেকে নেমে এলাম ডেভিলস গলফ কোর্সে। ডেথ ভ্যালির সব জায়গার নামই শয়তান, ভূত নামের সঙ্গে জড়িত স্বাভাবিকভাবেই। এর নাম ‘ডেভিলস গলফ কোর্স’, কারণ এমন মারাত্মক একবোখেবড়ো পাথুরে জায়গা যে, একমাত্র শতানের পক্ষেই এখানে গলফ খেলা সম্ভব।

আগেই বলেছি ডেথ ভ্যালির মতো জায়গাকে দেখার জন্য দুইদিন একেবারে নগন্য। যা কিছু দেখা হলো না তার ফিরিস্তি দিয়ে লাভ নেই। মার্কিনদের ভেতর হাইকিং-ক্যাম্পিং এর প্রবণতা লক্ষ্য করেছি আগে। অনেকে রাস্তায় দেখলাম নানা জাতের অফরোড কাজকর্মে লিপ্ত রয়েছে। প্রাকৃতিক সান্নিধ্যকে প্রাণভরে উপভোগ করছে। সময়ের বিপরীত দিকে এক অদ্ভুত যাত্রা তাদের, হোক না তা কয়েক দিন বা সপ্তাহের জন্য। এ দম্পতির আপাতত এ ফুসরত নেই। ফিরে যাচ্ছি জীবনের তাগিদে। যথা সময়ে গাড়ি জমা করে দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। সৃষ্টিকর্তার যে অপরূপ আর রূঢ় ভূ-প্রাকৃতিক সৃষ্টি দেখলাম তাতে ভয় হয় যে, জীবনধারণ কতোই না কঠিন হতে পারে এমন জায়গায়। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে এ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে মনের ভেতর এক অদ্ভুত কোমলতা এনে দিলো, মনকে প্রশান্ত করলো।
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেম, যুক্তরাষ্ট্র, সহকারী অধ্যাপক, আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |
-
ভ্রমণ কাহিনি: পোল্যান্ডের বড় দুটি শহর দেখা
-
বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার নতুন কমিটি
-
ফ্রাঙ্কফুটে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা
-
জেনিভায় বাংলাদেশ দূতাবাসে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন
-
জেনিভায় সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের আনন্দ উৎসব
-
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপনে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা
-
কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৮: 'এক্সপ্রেস এন্ট্রি' মানে কি বর্ধিত ফি'তে এক্সপ্রেস সার্ভিস?
-
আমিরাতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন
সর্বাধিক পঠিত
- শিক্ষককে পিটিয়ে খুন: মামলায় জিতুর বয়স ১৬, র্যাব বলছে ১৯
- সিরাজগঞ্জে অস্ত্র হাতে ‘ভাইরাল’ সেই বায়েজিদ পিস্তলসহ গ্রেপ্তার
- বাঘাইড় বিক্রি করায় সুপার শপকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা
- পদ্মা সেতু: যশোর তাকিয়ে কালনা সেতুর দিকে
- বান্ধবীর সামনে ‘হিরো হতে’ শিক্ষককে পেটান জিতু
- জর্দার পোটলা নিয়ে হজে, ভোগালেন সহযাত্রীদেরও
- ‘ইউভেন্তুসে বেনজেমা-মদ্রিচের মতোই খেলবে দি মারিয়া’
- পদ্মা সেতুর নাট খুলে গ্রেপ্তার ‘সাবেক শিবিরকর্মী’
- পদ্মা সেতুতে আবেগাপ্লুত ভারতের পর্যটক
- ‘হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে’ শিক্ষক খুনের আসামি জিতু রিমান্ডে