গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অ্যাঙ্গেলা নামের এক তরুণীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। অ্যাঙ্গেলার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়েতে। আমি ও সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের শিক্ষার্থী। পরিচিত হই স্লোভেনিয়ান ভাষাশিক্ষা-র ক্লাসে। রসায়ন পরীক্ষার দিন তার থেকে সাহায্য নিয়েছিলাম। আমার কলমের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন অ্যাঙ্গেলা তার কলম ধার দিয়ে সহযোগিতা করেছিল।
ধীরে ধীরে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে এসে অ্যাঙ্গেলার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি, আমার মাঝে তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অ্যাঙ্গেলার সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী না হলেও মেসিডোনিয়ার প্রতি আমার আগ্রহ বরং অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে মেসিডোনিয়া ভ্রমণের সুযোগ আসে। সবমিলিয়ে বলকান উপদ্বীপের এ দেশটিতে চার দিন কাটিয়েছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত যেকোনও দেশের বৈধ ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে কোনো ধরনের আলাদা ভিসা ছাড়াই মেসিডোনিয়া ঘুরে আসা যায়। ইমিগ্রেশন অফিসার মেসিডোনিয়াতে প্রবেশের সময় পাসপোর্টে একটি ‘অ্যারাইভাল সিল’ দেন।
চারদিন মেসিডোনিয়াতে থাকার সুবাদে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কৌচসার্ফিং ও রেডিটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে বিগত কয়েক মাসে আরও বেশ কয়েকজন মেসিডোনিয়ানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।
এটা ঠিক যে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে বসবাস করা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সাথে তুলনা করলে মেসিডোনিয়ানদেরকে রক্ষণশীল বলতে হবে। তবে জাতি হিসেবে তারা খুবই অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবাৎসল। বাইরের দেশের পর্যটকদেরকে তারা বিশেষভাবে সমাদর করে, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমার সফরের সময় দেশটির সাধারণ মানুষদের থেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে যখন নিজেকে পরিচয় দিয়েছি, তখন তাদের অনেকের কাছ থেকে আলাদা সম্মান পেয়েছি। বিদেশি পর্যটক বিশেষত বিদেশি লেখক কিংবা বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি তাদের এ আতিথেয়তা এবং বন্ধুবাৎসল্যের কারণও রয়েছে। বেশিরভাগ মেসিডোনিয়ান রাজনৈতিক সচেতন, তারা মনেপ্রাণে এমন কোনও দেশকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে চান, যে দেশ সময়ে-অসময়ে নিঃস্বার্থভাবে তাদের সাথে কাজ করবে।
ধারণা করা হয়, সিরিলিক বর্ণমালার প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল এই ওহরিডে। কেননা সেইন্ট সিরিল ও সেইন্ট মেথোডিয়াস- দুইজনই জ্ঞান সাধনার জন্য ওহরিডকে বেছে নিয়েছিলেন। আবার মেসিডোনিয়া তথা স্লাভিক জাতিসত্ত্বার ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল ওহরিডেই। এ শহরের পুরনো অংশটি ভীষণভাবে পর্যটকনন্দিত। মেসিডোনিয়াতে পা রাখার পর প্ৰথম দুই রাত আমি ওহরিডেই থাকি।
‘এআরবিএনবি’র (অস্থায়ীভাবে বাসা ভাড়া পাওয়ার জন্য ইউরোপের পরিচিত অ্যাপ) মাধ্যমে অ্যান্তোনিও নামের এক স্থানীয় ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় হয়। ওহরিডে দুই রাত থাকার জন্য আমি তার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। অ্যান্তোনিও এর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার আলাপ হয়। নিজের দেশের ইতিহাস ও বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান রাখেন ওহরিড।
১৯১২ সালে সংঘটিত প্রথম বলকান যুদ্ধের ফলাফল বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোকে উসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত করে। গ্রিস এবং সার্বিয়া এ দুইটি দেশ প্রথম বলকান যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল। আজকের দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোকে আমরা যেভাবে দেখি, তা মূলত গ্রিস এবং সার্বিয়া দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে। তাই দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছরের উসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেসিডোনিয়ার আত্মপ্রকাশের পেছনে এ দুই দেশ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯১৩ সালের ২৯ জুন মেসিডোনিয়াকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে গ্রিস ও সার্বিয়ার ওপর আক্রমণ চালায় বুলগেরিয়া। শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ। যদিও এ যুদ্ধে গ্রিস ও সার্বিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে বুলগেরিয়ানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে রোমানিয়ার দখল করে নেয় বুলগেরিয়ার কিছু অংশ।
মেসিডোনিয়ার আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে সার্বিয়ার প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। এমনকি ১৯৯২ সালে গণভোটের ফলে মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, সার্বিয়া সবসময় দেশটির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশ যেমন: স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া কিংবা বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাকে কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়েছে।
অ্যান্তোনিও জানালেন, সামরিক দিক থেকে বরাবরই দুর্বল বলেই সার্বিয়া অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে মেসিডোনিয়াকে করায়ত্ত করে রেখেছে। কিছুদিন হলো তুরস্ক, রাশিয়া ও চীন অর্থনৈতিকভাবে মেসিডোনিয়ার পাশে এগিয়ে এলেও এর বিনিময়ে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছে।
অ্যান্তোনিও বললেন, “আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তারা আমাদেরকে ব্যবহার করতে চায়।”
অ্যান্তোনিও আক্ষেপ করে জানান, করোনার মধ্যে কোনও দেশ তাদেরকে ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে সেভাবে সহায়তা করেনি। সার্বিয়া ভ্যাকসিন দিলেও তার বিনিময়ে বিপুল সুবিধা আদায় করে নিয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে অ্যান্তোনিওকে প্রশ্ন করেছিলাম। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যুগোস্লাভিয়া ছিল প্রথম দিকের রাষ্ট্র যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। যুগোস্লাভিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর একটি নীতি ছিল সদ্য স্বাধীন হওয়া সব দেশকে সাহায্য করা এবং সরাসরিভাবে এ সকল দেশ যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে প্রবেশ না করে নিরপেক্ষভাবে পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করতে পারে সেজন্য এসব দেশকে সহযোগিতা করার কৌশল নিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশকে মেসিডোনিয়া সব সময় নিজেদের বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে চেয়েছে বলেই জানালেন অ্যান্তোনিও।
১৯৯২ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সেভাবে আর জোরদার হয়নি মেসিডোনিয়ার। এ কারণে বাংলাদেশে যেমন তাদের দূতাবাস নেই, ঠিক মেসিডিনিয়াতেও আমাদের দূতাবাস নেই।
মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কুপিয়েতে এক আলবেনীয় পরিবারে জন্ম হয়েছিল মাদার তেরেসার। মেসিডোনিয়া নামটি যত অপরিচিত এখানকার মানুষের কাছে, মাদার তেরেসা ততোটাই পরিচিত ভারতীয় এবং বাংলাদেশিদের কাছে। হ্যাঁ এখানে জন্ম নেওয়া আরেকটি নামও খুব পরিচিত। সেটি হলো- আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।
সার্বিয়া থেকে মেসিডোনিয়াতে ঢোকার সময় তাবানোভচি নামক বর্ডার ক্রসিং এলাকায় আমাকে বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল। তখন মারিনা বোজিনোভস্কা এক মেসিডোনিয়ান তরুণী আমাকে বেশ সাহায্য করেছিলেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘কৌচসার্ফিং’ নামের পর্যটকদের জন্য বিশেষায়িত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এর কারণ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের গ্রিস একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে কমিউনিজমের তেমন একটা প্রভাব ছিল না। সব সময় তাদের পররাষ্ট্রনীতি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সমুখি।
মারিনার আমাকে বললো, গ্রিসের কারণে মেসিডোনিয়ার সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে জোরালো হয়নি। এমনকি ২০১৮ সালে গ্রিসের চাপে মেসিডোনিয়া তাদের নাম পরিবর্তন করে উত্তর মেসিডোনিয়া রাখতে বাধ্য হয়।
বুলগেরিয়ার সাথেও মেসিডোনিয়ার সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ নয়। বুলগেরিয়ার সাধারণ মানুষ মনে করেন, জাতিগতভাবে বুলগেরিয়ান ও মেসিডোনিয়ানরা অভিন্ন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আজকের থেকে একশ বছর আগে মেসিডোনিয়া ও বুলগেরিয়া এ দুই দেশের ভাষার মাঝে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। পরবর্তীতে সার্বিয়ার নেতৃত্বে মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনে যোগ দিলে দেশটির সাধারণ মানুষের ভাষায় সার্বিয়ান ভাষার প্রভাব পড়ে, যার প্রেক্ষিতে মেসিডোনিয়ানরা নিজেদেরকে আলাদা জাতিসত্ত্বার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে মেসিডোনিয়ানরা নিজেদের স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী।
ঐতিহাসিকদের অনেকের দাবি, মেসিডোনিয়ানদের একাংশ জনগোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষ এসেছে আফগানিস্তান কিংবা মধ্য এশিয়ার কোনও একটি দেশ থেকে। এ কারণে নাকি মেসিডোনিয়ার অনেক মানুষের চেহারায় আফগান, উজবেক, কাজাক কিংবা তাজিকদের ছাপ রয়েছে।
মারিনা জানালো, আলেকজান্ডার তার সাম্রাজ্যকে ভারতের এক অংশ পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। তাই ঐতিহাসিকভাবেই নাকি মেসিডোনিয়ানরা মেসিডোনিয়ার অনেক মানুষ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি দুর্বল, বন্ধু মনে করে!
বাংলাদেশ বিষয়ে মারিনাকেও প্রশ্ন করেছিলাম। অ্যান্তোনিও এর মতো তিনিও বাংলাদেশ এবং মেসিডোনিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী।
শুধু অ্যান্তোনিও কিংবা মারিনা নন, মেসিডোনিয়াতে আরও অনেকের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে- যাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার কথাই জানিয়েছেন।
তানিয়া ইভানোভস্কা নামক আমার এক মেসিডোনিয়ান বন্ধু একবার আলোচনার ফাঁকে আমাকে বললেন, আমার লেখার মাধ্যমে যদি মেসিডোনিয়ার সাথে বাংলাদেশের সত্যিকারের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে তবে সেটা হবে তাদের জন্য বড় প্রাপ্তি।
এ কারণে মেসিডোনিয়াভিত্তিক আমার কোনও লেখা যখন বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়, তখন তার লিংক আমার মেসিডোনিয়ার বন্ধুদের দিলে, তারা নিজ আগ্রহে ফেইসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দেযন। যদিও বাংলায় তাদের জ্ঞান একদম শূন্য।
মেসিডোনিয়ানর অতিথিপরায়ণ এবং বন্ধুবাৎসল। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও মেসিডোনিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে সে-ই প্রত্যাশা করি।
লেখক: স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগে স্নাতক করছেন।
ইমেইল: rakib.rafi786@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |