ভ্রমণ কাহিনি: পাহাড় ও পারাবারের শহর খোরফাক্কান

কাজের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। তাছাড়া মহামারীতে কারাবন্দি হয়ে বিধি নিষেধের বেড়াজালে থাকায় বেরোনো হয়নি বহুদিন। তাই সুযোগ পেতেই পাড়ি দিলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাগর আর পাহাড়ের শহর খোরফাক্কানের উদ্দেশ্যে।

ফরহাদ হোসাইন, আবুধাবি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2021, 07:03 AM
Updated : 6 Nov 2021, 07:03 AM

ওমান উপসাগরের এ শহরটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায়, তবে ফুজাইরাহ সংলগ্ন। রাজধানী আবুধাবি থেকে ২৬৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দুবাই থেকে ১২৯ কিলোমিটার উত্তরে খোরফাক্কানের অবস্থান। আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় কীভাবে ঘুমায় কিংবা আত্মার সঙ্গে সমুদ্র কীভাবে সখ্যতা গড়ে সেই সত্যতার সাক্ষাৎ পেতে আপনাকে আসতে হবে এখানে। গভীর প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর, বৈচিত্র্যময় হাজার পর্বতমালা, নয়াভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন গোরস্থান, পাথরের দ্বীপ, পাহাড় কেটে বানানোর টানেল এবং মূলত বাংলাদেশিদের দখলে থাকা 'ফ্রাইডে মার্কেট' শহরটিকে অনন্যতা দিয়েছে।

খোরফাক্কান সৈকতে আমি

খুব সকালে দুই বন্ধুকে নিয়ে উৎসবের আমেজে যাত্রা শুরু করলাম উত্তর আমিরাতের দিকে। নবীন বন্ধুটি সম্প্রতি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন, তাই দারুণ উৎসাহ নিয়ে গাড়ি ছুটালেন। দেড়শ কিলোমিটার চালিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিলেন আর তাতে নিজেকেই নিতে হল ড্রাইভিং সিট। রাজধানী শহর আবুধাবি থেকে শারজা হয়ে এমিরেটস রোড ধরে নির্দেশনা বোর্ডের চিহ্ন অনুসরণ করে খোরফাক্কান বাইপাস সড়কে মিশে গেল আমাদের গন্তব্য।

শারজা সরকার ছয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তৈরি করেছে পাহাড়ি পথের এ মসৃণ রাস্তা। এ বাইপাস সড়কটি দুবাই থেকে  খোরফাক্কানের দূরত্ব অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। ৯০ মিনিটের রাস্তা এখন পাড়ি দিতে পারেন মাত্র ৪৫ মিনিটে। রাস্তার দুধারে সারি সারি খাড়া গম্ভীর কালো পাথরের পাহাড়, মনে হবে আকাশটাকে আড়ালে রেখে আপনাকে এক রহস্যময় নগরীতে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের ঘনত্বের কারণে এখানে শব্দের প্রতিধ্বনি হয়, গাড়ির শব্দটিও পুনরায় গাড়িতে ফিরে আসে, এমনকি প্রথম বিমান ভ্রমণের মতো কানে বায়ুচাপ অনুভব হয়।

আমি ও আমার ভ্রমণসঙ্গীরা

পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম 'আলহাজয' পর্বতমালার মাঝ দিয়ে এ রাস্তাটি সম্প্রসারিত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের প্রায় সাতশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কঠিন শিলার পর্বতশ্রেণি। ভারি যানবাহনমুক্ত নিরিবিলি এ রাস্তায় আপনি দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাবেন যখন আপনার গাড়ি গভীর পাহাড়ের দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দেবে। আরব আমিরাতের দীর্ঘতম পাঁচটি স্থলভিত্তিক টানেল এখানে। পরপর পাঁচটি স্থল টানেলের বুকের ভেতর দিয়ে আপনি শহরে প্রবেশ করবেন। শহরের প্রবেশপথের ধারের 'আল রুফসা' লেক আপনার দৃষ্টিকে শীতল করে তুলবে। চারদিকে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়ের খাদে মনোমুগ্ধকর নীল জলরাশি আনন্দের উৎস হয়ে উঠল। গাড়ির উইন্ড খুলতেই নীলজল ছুয়ে দেখতে মন অস্থির হয়ে উঠল।

এখানে যান্ত্রিক বোট বা ছোট্ট নৌকা নিয়ে ছুটে যেতে পারেন পাহাড়ের বাঁকে। সৌন্দর্য উপভোগের জন্য লেকের সুউচ্চ পাড়ে নিরিবিলি বসার ব্যবস্থা আছে। গাছপালায় ঘেরা গভীর সবুজে মন জুড়িয়ে নেওয়া এবং পাহাড় ও সবুজের স্মৃতি রক্ষার জন্য তুলে নিতে পারেন চমৎকার লোকেশনের কিছু ছবি। লেকটি কিছুতে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু সমুদ্রের প্রতি টানে সৈকতের দিকে রওনা হলাম। হাতে সময় থাকলে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে পারেন এ লেকের পাড়ে।

খোরফাক্কান সৈকত নিঃসন্দেহে আরব আমিরাতের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত। গাড়ি থেকে নেমে সৈকতে পা রাখতেই মনটা অন্যরকম অনুভূতিতে ভরে গেল। পৃথিবীর দুটি জিনিস বিশালতায় ভরা; আসমান আর সমুদ্র। আসমান ছোঁয়া না গেলেও সাগরের বিশালতা ছোঁয়া যায়। আমার জীবনে এত সুন্দর সৈকত আর দেখা হয়নি। এর চেয়ে সৌন্দর্য হয়ত স্বর্গেই দেখা সম্ভব। তিন দিকে ঘেরা অসীম উচ্চ পর্বতমালা যেন আকাশে আয়েশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর সামনে অসীম সাগর নীলিমা। সেই ছায়া সাগরে পড়ে মোহময় আবছায়া তৈরি করেছে। নির্মল ও পরিচ্ছন্ন সৈকতের আকাশে তুলতুলে স্বচ্ছ মেঘ যেন ওপর থেকে তাকিয়ে আছে।

তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ মনকে অস্থির করে তুললো। নেমে পড়লাম নীল জলে। ঝাঁপাঝাঁপি দুষ্টুমিতে মেতে উঠলাম বন্ধুরা কিছুক্ষণ। বিচ পুলিশ এসে হুইসেল বাজানো শুরু করলো। ভড়কে গেলাম ভয়ে, না জানি কি আইন অমান্য করলাম। পরে বুঝলাম কিছু ভারতীয় সাঁতারের পোশাক ছাড়া নেমে পড়েছে পাশে। মজার এ সৈকতে সুবিধা আছে বই পড়ার, বারবিকিউ পার্টি কিংবা জগিং করার; আছে ক্রুজ প্যারাসেইলিং অথবা সার্ফিং করার সুযোগ। এখানে থেকে মাত্র ২০ দিরহাম দিয়ে স্পিডবোটে ঘুরে আসতে পারেন নিকটবর্তী 'শার্ক আইল্যান্ড' থেকে।

আইল্যান্ডটি আসলে সাগরের গভীর থেকে গজিয়ে ওঠা হাজর পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ। নানা প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ ও হাঙ্গরের অভয়াশ্রম এ বিচ এলাকা। সৈকতের সন্নিকটে কৃত্রিম জলপ্রপাত আরেকটি আনন্দের খোরাক জোগায়। খোরফাক্কানের অন্যতম আকর্ষণ 'ফ্রাইডে মার্কেট'। এ মার্কেটে পাওয়া যায় নানা রকম তাজা ফল, মাটির তৈরি পাত্র এবং নানা রকমের কার্পেট বিশেষ। নাম 'ফ্রাইডে মার্কেট'হলেও আসলে সপ্তাহের সব দিনই খোলা থাকে দোকানগুলো। মজার বিষয় হচ্ছে এখানে বাংলাদেশের মতো জিনিস দরদাম করে কিনতে হয়। কারণ বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত এখানকার দোকানিরা এটা উপভোগ করেন।

পাথুরে পাহাড়ে চড়া, নয়াভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন গোরস্থান, কালা পাথরের দ্বীপ, স্থল টানেল কোনটা রেখে কোনটা দেখি করে সময়ের সঙ্গে সে নিয়ে যুদ্ধ করতে করতেই সময় শেষ হয়ে গেল। এ পর্যটন নগরীতে দিন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু প্রাপ্তির পিপাসা নিবারণ হয় না। বারবার প্রকৃতি এখানে হাতছানি দেয় অতি প্রিয়জন হয়ে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাস, আবুধাবি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!