এ অন্টারিও প্রদেশের আয়তন প্রায় সাতটি বাংলাদেশের সমান। ‘ফল কালার’ দেখার জন্য এতো বড় প্রদেশ তো আর ঘুরে দেখা সম্ভব নয়, তাই সংক্ষেপ করে বললে বলা যায় মাসকুকা জেলার অ্যালগোনকুইন পার্ক হলো ‘ফল কালার’ দর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আর কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসে কানাডার ‘ফল কালার’ দেখতে।
দেশে থাকতে পত্রপত্রিকায় ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার ফল কালারের ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছি। গাছের পাতার রং এমন হয় কেমন করে! ঝরা পাতার কান্না শুনেছি রবীন্দ্রনাথের গানে- ‘ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে...’। মোনালিসার সূত্র ধরে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শিল্পকর্মের খোঁজ করতে গিয়ে অটামের উপর তার বেশ কিছু শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল। শিল্পবোদ্ধা না হলেও সেসব ছবির রস আস্বাদন করতে অসুবিধা হয়নি।
আলবেয়ার কামু বলেছিলেন, ‘অটাম ইজ অ্যা সেকন্ড স্প্রিং হোয়েন এভ্রি লিফ ইজ অ্যা ফ্লাওয়ার’। ২০১০ সালে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কানাডায় পা দিয়েই তার সত্যতা বুঝতে পেরেছিলাম। পিয়ারসন এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে আসার সময় দেখেছিলাম রাস্তার দু’ধারের গাছের পাতা লাল-হলুদ-কমলা রংয়ের ফুলের মতো ফুটে আছে। বিস্ময়ের মাত্রা চরমে নিয়ে শুরু করেছিলাম প্রবাস জীবন। সেই মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। তাই তো প্রতিবছর ‘ফল কালার’ দেখতে বেরিয়ে পড়ি পরিবার, বন্ধুবান্ধবসহ।
এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। এবার আমাদের ‘ফল সিজন’ ট্যুরে অংশগ্রহণকারী দুই পরিবারের চার বন্ধু। বাচ্চারা তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কেউ সাথী হতে পারেনি। আমরা স্থান নির্ধারণ করেছিলাম মাসকুকা। মাসকুকা প্রবেশের মুখে একটা সাইন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, -মাসকুকা, ওয়ান্স ডিডকভার্ড, নেভার ফরগটেন’। আসলেই তাই, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভুলবার নয়। একবার যে এসেছে সে বারবার এখানে আসতে চায়। সেই সৌন্দর্য বলার আগে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা একটু খোলাসা করে নিচ্ছি-
বাম থেকে রুমু, আমি, কাজল ও জহুরুল
মাসকুকার অ্যালগোনকুইন পার্ক হলো কানাডার সবচেয়ে প্রাচীন এবং অন্টারিও প্রদেশের সবচেয়ে বড় প্রভিন্সিয়াল পার্ক। দুই মিলিয়ন একর জুড়ে প্রাচীন ম্যাপল ওক, পাইন, বার্চ ট্রি সামারে দৃষ্টিসীমায় সবুজের পরশ বুলিয়ে দেয়। পার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ যে রাস্তা চলে গিয়েছে সে রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করলে নির্মল বাতাসে সবুজের ছোঁয়ায় মনে অফুরান প্রাণশক্তি এনে দেয় আর এই ফল সিজনে একই রাস্তায় ড্রাইভ করলে পুরো পার্কের লাল, হলুদ, গোলাপি রংয়ের আভায় চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। ড্রাইভকে মনে হয় স্বপ্ন জগতের বিচরণ। প্রকৃতির এমন বর্ণিল রুপ দেখে মার্কিন কবি স্টেনলে হরোওয়েজ বলেছিলেন, “শীতকাল একটি নকশা, বসন্ত একটি জলরঙ, গ্রীষ্ম একটি তৈলচিত্র এবং শরত হলো তাদের সবার একটি কারুকাজ।
এ অ্যালগোনকুইন পার্কের আশপাশের ছোট শহরগুলোতে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত হোটেলে বুকিং পাওয়া বেশ কষ্টকর। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমাদের যাওয়ার সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হলো তখন আর হোটেলের বুকিং পাওয়া যায় না। হঠাৎ করেই জহুরুল একটি হোটেলে দুটি রুম পেয়ে কোনকিছু বাছবিচার না করেই বুকিং দিয়ে দিল। প্রতিরাতের ভাড়া ২০০ ডলার হলেও রিভিউ পড়ে দেখি তার গড় রেটিং পাঁচের মধ্যে ২.৫, অর্থাৎ যারা এ হোটেলে থেকেছে তারা এদের সেবার মানকে মাঝারি মানের বলে চিহ্নিত করেছে। কানাডার প্রেক্ষাপটে যা আসলে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সবার মতামত নিয়ে জহুরুল হোটেলের বুকিং ক্যানসেল করে দেয়।
অনেক খোঁজাখুজির পর শেষে পাওয়া গেল লেক হুরণ আর জর্জিয়ান বে’র স্বচ্ছ নীল জল বিধৌত ছোট শহর ‘পেরি সাউন্ড’-এ ক্যানাডিয়ন চেইন হোটেলের দুটি রুম। এই পেরিসাউন্ড অ্যালগোনকুইন পার্ক থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে। তা হোকগে, এসময়ে দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ কোন বড় বিষয় নয়। তাছাড়া প্রকৃতি এখন এতো সুন্দর যে ড্রাইভ করতে করতেও তার রূপসুধা উপভোগ করা যায়। কাল বিলম্ব না করে জহুরুল সে দুটি রুমের বুকিং দিয়ে ফেলেছিল।
আমাদের যাত্রার তারিখ নির্ধারিত ছিল ৯ অক্টোবর, শনিবার। সোমবার থ্যাংক গিভিং-এর ছুটি বিধায় বেড়ানোর কোন তাড়া ছিল না। টরন্টো থেকে কাজল আর গুয়েল্ফ থেকে আমরা একই সময়ে রওনা দিয়ে মিলিত হয়েছিলাম বেরি’র ‘অন রুট’ নামক পথের ধারের চেইন রেস্টুরেন্টে, অনেকটা আমাদের ঢাকা-চট্রগ্রাম কিংবা ঢাকা-দিনাজপুরের হাইওয়ের পাশে যাত্রা বিরতির রেস্টুরেন্টের মতো। তবে এই চেইন রেস্টুরেন্টগুলো পুরো অন্টারিওর ব্যস্ত হাইওয়ের পাশে তেইশটি স্থানে পরিচালিত হয় যার মালিকানা একটি মাত্র কোম্পানির। এদেশে বাণিজ্য নিয়ে নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা নেই। এ প্রতিযোগিতা সরকার থেকেও নিরুৎসাহিত করা হয়। ধারণাটা পুঁজিবাদী হলেও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সহায়ক।
বেরি’র এই ‘অন রুট’-এ ফ্রেস হয়ে, হালকা নাস্তা সেরে আবার দুই পরিবারের দুই গাড়িতে যাত্রা শুরু হয়েছিল। হাইওয়ে ৪০০ ধরে ড্রাইভ করতে হবে অনেকটা সময়, কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি, পড়তে হলো যানজটে। অন্টারিওর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই হাইওয়ে চার লেনের দ্রুতগতির হলেও ‘ফল কালার’ দর্শনে ছুটে চলা পর্যটকদের ভারে তার বেহাল দশা।
পার্কের কাছাকাছি আসতেই আর এক বিপত্তি। ওয়েদার নেটওয়ার্কে দেখেছিলাম অ্যালগোনকুইন হাইল্যান্ডে বৃষ্টির সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ, ত্রিশ চল্লিশ শতাংশের পূর্বাভাসে এখানে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না, হলেও তা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আমাদের গাড়ি অ্যালগোনকুইন পার্কে ঢোকার আগেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি, তা আর থামার কোন লক্ষণই নেই। এই বৃষ্টির মাঝেও পার্কের গেটে দেখলাম পার্কের ২৬০টি লেকের ধারে কোন জায়গা খালি নেই। অগত্যা বিশাল অ্যালগোনকুইন পার্কের পূর্ব থেকে পশ্চিমে মাথার সিঁথির মতো যে হাইওয়ে ৬০ চলে গিয়েছে তা ধরে ড্রাইভ করলাম প্রায় ত্রিশ মিনিট। দু’ধারে ম্যাপল, বার্চ আর ডগউড গাছের লাল হলুদ কমলা রং পর্যটকদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে, তা তারা অনেকদিন ভুলতে পারবে না। প্রকৃতির এই রূপ দেখতে এসে গতকালই টরন্টোর কবি ফেরদৌস নাহার লিখেছেন- “বৃক্ষেরা যখন শরতের স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দেয় নানা রঙে, তখন তার নাম হয় অ্যালগোনকুইন পার্ক। সেই রং কুড়াচ্ছি প্রাণ ভরে…।”
পড়ন্তবেলায় পার্ক থেকে কান্ট্রিসাইড রোড ধরে ড্রাইভ করে একশত ত্রিশ কিলোমিটার পেরিসাউন্ড আসার পথে সেই রং কুড়োতে কুড়োতে যখন চলে আসছি তখন স্কুলে পড়া একটা তথ্যের কথা মনে পড়লো- একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পঁচিশ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব অনুযায়ী এখানে আছে আটত্রিশ শতাংশ। কিন্ত মাসকুকা জেলায় মনে হলো পুরোটাই গভীর বনাঞ্চলে ঘেরা আর পুরোটাই এখন অপরূপ রঙে বর্ণিল হয়ে আছে। সেজন্যই ফল কালার দেখার জন্য মাসকুকাকে বলা হয় ‘ফল কালার কুইন’।
প্রকৃতির এই রং বদলের ঘটনা নিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় এতো যে উন্মাদনা, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মাঝে যে আগ্রহ কিংবা আমরাই যে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিবছর সপরিবারে কিম্বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটুকু জেনে নিলে মন্দ হয় না-
সেই ছোটবেলা থেকে পড়ে এসেছি গাছের পাতায় প্রচুর পরিমানে ক্লোরোফিল থাকে। পাতার ক্লোরোফিল গাছের শিকড়ের সাহায্যে সংগৃহীত পানি আর সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এসে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন করে এবং সে খাদ্য শিরা-উপশিরার মাধ্যমে গাছের বিভিন্ন অংশে পৌঁছায়। ক্লোরোফিলের আধিক্যের কারণে গাছের পাতার রং সবুজ দেখায়।
শীতপ্রধান দেশগুলোতে ফল সিজনের শেষের দিকে যখন দিনের দৈর্ঘ্য, সূর্যের আলোর পরিমান এবং তাপমাত্রা কমতে থাকে তখন গাছের পাতা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না, একসময় এ খাদ্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাতা এবং শাখা-প্রশাখার সংযোগস্থলে গাছ পাতলা কাঠের স্তর তৈরি করে যাতে গাছের ভেতরের মজুত খাদ্য ও পানি পাতায় যেতে না পারে। যে পাতা পুরো সময়জুড়ে গাছের জন্য খাদ্য উৎপাদন করেছে সে পড়ে যায় বিপদে। একসময় পানির অভাবে পাতার ক্লোরোফিল বিবর্ণ হয়ে যায় এবং বাদামি বর্ণ ধারন করে ঝরে পড়ে। শীতের শুরুতে যে কারণে প্রতিটি গাছ পাতাশূন্য হয়ে পড়ে ।
পুরো সামার জুড়ে গাছের পাতা শর্করা জাতীয় খাদ্য উৎপাদন করে। এ খাদ্য শিরা উপশিরার মাধ্যমে গাছে সরবরাহ করে। পাতা এবং গাছের সংযোগস্থলে পাতলা কাঠের পর্দার কারণে এই চিনি জাতীয় খাদ্য আর গাছে যেতে পারে না। চিনির আধিক্যের কারণে কোন কোন গাছের পাতা রক্তলাল হয়ে ওঠে। গাছ থেকে পাতায় পানির প্রবাহ না থাকার কারণে এ পাতাও কিছুদিন পর ঝরে পড়ে।
পাতা এবং গাছের শাখা-প্রশাখার সংযোগস্থলে কাঠের পাতলা আবরণ তৈরি না হলে শীতে পানি এবং খাদ্যকণা বেরিয়ে গিয়ে গাছ শুষ্ক আর নিস্তেজ হয়ে মারা যেত। গাছের পাতা ঝরা যেন ‘বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ’। শীতপ্রধান দেশের গাছের পাতার এ বিষয়টি লক্ষ্য করে পাশ্চাত্যের কেউ একজন বলেছিলেন, “পাতাগুলো আমাদের দেখাতে যাচ্ছে যে মৃত জিনিস ছেড়ে দেওয়া কতটা সুন্দর”।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |