রকি পর্বতমালা আর ডাইনোসরের রাজ্যে

‘ভূস্বর্গ’ শব্দটি প্রকৃতির অপরূপ নান্দনিকতার বাচনিক অভিব্যক্তি। পাক-ভারত উপমহাদেশের কাশ্মীর আর ইউরোপের সুইজারল্যান্ডকে ছোটবেলা থেকেই পৃথিবীতে স্বর্গের রেপ্লিকা হিসেবে জেনে এসেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত কাশ্মীর দেখা হয়নি। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে নানা সময়ে ব্যাপক ঘোরাঘুরির সুযোগে এটুকু অন্তত বলতে পারি প্রকৃতি সত্যিকার অর্থেই এখানে উজাড় করে দিয়েছে।

শোয়েব সাঈদ, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2021, 05:06 PM
Updated : 26 Sept 2021, 05:06 PM

কাশ্মীর আর সুইজারল্যান্ডের পাশাপাশি ‘ভূস্বর্গ’ শব্দটি খুব সহজেই রকি পর্বতমালার কানাডা অংশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কানাডার অর্থাৎ পশ্চিম কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া আর আলবার্টার রকি পর্বতমালার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ‘ভূস্বর্গ’ বাচনিক অভিব্যক্তিকে ছাড়িয়ে অনেক বেশি বাস্তব আর প্রাণবন্ত, যেন নন্দনকাননের সৌর-জাগতিক সংস্করণ। 

বিশাল ভূখণ্ড কানাডাকে প্রকৃতি ভালবেসেছে উজাড় করে। মিঠা পানির বিস্তৃত লেইক, ঝর্ণা, গ্লেসিয়ার, অরোরার মত প্রাকৃতিক বিস্ময় রয়েছে দেশটিতে। ক্যালগেরির কাছে রকি পর্বতমালার পাদদেশের ছোট্ট শহর বানফ্ বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। ‘ভূস্বর্গ’ শব্দটিকে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার আঁচলে বাঁধতে হলে দর্শন যে করতেই হয়।

মন্ট্রিয়ল থেকে আলবার্টার প্রধান নগরী ক্যালগেরির দূরত্ব তিন হাজার ৬০০ কি.মি.। আর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রধান নগরী ভ্যাংকুবারে যেতে বিমানেই লাগে প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা। বিমানে উড়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে ভ্রমণ নয়, রকির নান্দনিকতাকে উপভোগ করতে হলে পাহাড়ের ভাজে ভাজে বিখ্যাত ট্রেন ভ্রমণ নতুবা গাড়ি দিয়ে যাত্রার বিকল্প নেই। কিন্তু তার জন্য ‘ভ্যাকেশন প্ল্যান’ কিংবা কোন এক উছিলার প্রয়োজন।

এরকম একটি উছিলা জুটেছিল ভাগ্যে আর সেটির সদ্ব্যবহারে ছিল না কোনও প্রকার দ্বিধা। এক ভাগ্নের বিয়ে উপলক্ষে সপরিবারে ক্যালগেরিতে যাওয়া এবং বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে রকি পর্বতমালা দেখে আসার  ইচ্ছেটুকুর যথাসাধ্য বাস্তবায়ন হয়েছিল।

ক্যালগেরিতে ছুটিতে যাওয়ার আগে আগে ২০১৭ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে  কনফারেন্সে অংশ নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কলারাডোর ডেনভারে। মজার বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এ অংশটি আবার রকি পর্বতমালাবেষ্টিত। রকি পর্বতমালা তিন হাজার মাইল দীর্ঘ। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, আলবার্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইদাহো থেকে কলারাডো হয়ে দক্ষিণে নিউ মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত।

মন্ট্রিয়ল থেকে চার ঘণ্টার ফ্লাইটে বিস্তৃত বিরানভূমির মাঝে কিছুটা মরু আবহাওয়ায় আকারের দিক থেকে উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম বিমানবন্দর হচ্ছে ডেনভার; বিশ্বে দ্বিতীয়, সৌদির কিং ফাহাদ বিমানবন্দরের পরে। মরুভূমির তাবু সংস্কৃতির ধাঁচে ও আদলে গড়ে ওঠা এ বিমানবন্দরের পাঁচটি  রানওয়ে, যার মধ্যে একটি ৪ দশমিক ৮ কি.মি., যা যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘতম। রকি পর্বতমালাবেষ্টিত আর কলারাডো নদীবিধৌত কলারাডো অঙ্গরাজের রাজধানী ডেনভার বিমানবন্দর থেকে বেশ দূরে।

সমুদ্রপৃষ্ট থেকে এক মাইল উচ্চতায় অবস্থান বলে ডেনভারকে মাইল সিটি বা এক মাইল উচ্চতার শহর বলে। ‘ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ মুভিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে ইমেইজ, কলারাডো অঙ্গরাজ্য আর ডেনভার শহর সে ইতিহাসের অংশ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজি কনফারেন্সের অবসরে ডেনভারের ঐতিহ্য এবং আধুনিক ডেনভার- দুই আঙ্গিকে একটু পরখ করে দেখার সুযোগ হয়েছে।

থাকতে হয়েছে কনফারেন্সের ভেন্যু ডাউনটাউন শেরাটন হোটেলে। বেশ কয়েক ঘণ্টার হাঁটা আর গণপরিবহণ ব্যবহারে কলারাডো বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক স্পট  দেখতে গিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতাটি ছিল টাইটানিক জাহাজডুবি থেকে বেঁচে যাওয়া তৎকালীন ধনকুবের মলি ব্রাউনের বাড়িটি দেখা। ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল আরএমএস টাইটানিক জাহাজ ডুবিতে প্রথম শ্রেণির যাত্রী মলি ব্রাউন ৬ নম্বর লাইফবোটে নিজেকে রক্ষার পাশাপাশি অন্যদের উদ্ধারেও সাহসী ভূমিকা রাখেন।

কনফারেন্স শেষে ভ্যাকেশন শুরু করতে আমি ডেনভার থেকে বিমান পথে যাত্রা করি ক্যালগেরিতে। পরিবারের সদস্যরা মন্ট্রিয়ল থেকে প্রায কাছাকাছি সময়ে বিমানে করে এসে পৌঁছায় ক্যালগেরি বিমানবন্দরে। আমাদের ভ্যাকেশন পরিকল্পনার ছিল ক্যালগেরি এয়ারপোর্ট থেকে রেন্টাল কার নিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার ড্রাইভ করে ভ্যাংকুবার বিমানবন্দরে গাড়ি জমা দিয়ে মন্ট্রিয়লে উড়ে ফেরত আসা। একটি বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে ওইখানে ফেরত না দিয়ে হাজার কিলোমিটার দূরের অন্য বিমানবন্দরে ফেরত দেওয়া অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তবে ভ্রমণের কৌশলগত কারণে অনেক সময় এ ব্যবস্থা ছাড়া উপায় থাকে না।

ক্যালগেরি বিমানবন্দরের রেন্টাল গাড়ি বুথে অনলাইন রিকিইজিশন দেওয়া ছিল গ্র্যান্ড চেরুকি। মাঝারি আকারের উচ্চ হর্স পাওয়ারের এ এসইউভি গাড়িটি যুক্তরাষ্ট্রের জিপ কোম্পানির এবং পাহাড় পর্বত পেরিয়ে হাজার কিলোমিটার ড্রাইভে শক্তিমত্তার পাশাপাশি আরামাদায়কও বটে। কিন্তু রেন্টাল কার বুথে প্রতারিত হলাম। চেরুকির বদলে গছিয়ে দিল রেংগ্লার জিপ। এটিও শক্তিশালী গাড়ি, কিন্তু এসইউভির মত আরামদায়ক ছিল না। উপায় না থাকায় এ জিপটি সাথী হল আমাদের। আমার ছেলে আসাহী ড্রাইভ শুরু করার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ক্যালগেরি শহরের ক্ল্যারিওন হোটেলে।

বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু পরিচিত মুখ থাকে ক্যালগেরিতে। ছাত্রজীবন থেকেই পরিচিত সংগঠক জাহিদ সবুজ আর মেজবাহ-অপু দম্পতি দেখা করতে এলো হোটেলে। বেশ কয়েকটি কৃষিবিদ পরিবারের (নাহিদ, শম্পা, আরিফ, মাসুক, শাহিদ, লিটন, ফায়জুল-কনক, আলম) সাথে পিকনিক করতে গিয়ে ঘুরে দেখা হল বানফ্ এর সৌন্দর্য।  ক্যালগেরির কৃষিবিদ পরিবারগুলোর আন্তরিকতা  ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ দিনগুলোতে।

বানফ্ ন্যাশনাল পার্কে ড্রাইভ করতে গিয়ে পাহাড়ের সাথে আকাশের আর সমতলের মিতালির  নৈসর্গিকতা দৃষ্টিতে নয়, গেঁথে যায় হৃদয়ে। আপনার সম্মুখ দৃষ্টিতে ওই দূরে আকাশছোঁয়া সারি সারি পাহাড়ের কাছে যাবার আকুতি, আবার একই সময় গাড়ির রিয়ার আর সাইড গ্লাসের দিকে তাকালে দেখবেন, পেছনেও নীলিমায় মিশে যাওয়া পাহাড়ের সারি ক্রমশ আপনাকে বাহারি রূপে বিদায় জানিয়ে ধীরলয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

কানাডার রকি পর্বতমালার বানফ বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। কানাডার রকি ট্রেন ভ্রমণের বিশ্বখ্যাত স্পটও বটে। আর তাই রকি ড্রাইভে পাহাড়ের খাদে ট্রেন লাইন কিংবা রেল টানেলে হারিয়ে যাওয়া  বা বেরিয়ে আসা ট্রেনের মুগ্ধতায় আবেশিত হতেই পারেন।

রকি পর্বতের ভাঁজে ভাঁজে ছোট বড় নানা আকারের জলাধারের সমাহার। পরিষ্কার আকাশে কোন কোন জলাধার হঠাৎ আপনাকে চমকে দেবে সুউচ্চ কোন এক পর্বতশৃঙ্গের প্রতিবিম্ব টলটলে পানিতে এঁকে দিয়ে। আলবার্টায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া সীমান্তের কাছে বানফ্ ন্যাশনাল পার্কের কানাডিয়ান রকির চমৎকার প্রতিবিম্বের জন্য বিখ্যাত। হিমবাহের পানিতে সৃষ্ট লেইক লুইস যেন ভূস্বর্গের প্রাণকেন্দ্র। এর চারপাশের জনবসতিকে বলা হয় লেক লুইস হ্যামলেট।  আর এ হ্যামলেট একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া সীমান্ত পেরিয়ে গেলে দেখা মিলবে ইয়োহো ন্যাশনাল পার্কের ডেলি গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ থেকে সৃষ্ট তাকাকাউ ঝরনা।

২২৮ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসরের বিচরণ করেছে। অর্থাৎ ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ১৫০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস থাকলেও এদের দেহাবশেষ বা প্রামাণিক নিদর্শনগুলো খুঁজে পাওয়া সহজসাধ্য নয়। কানাডার আলবার্টা অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক আর আবহাওয়াগত অবস্থান নিদর্শনগুলো সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আরমার্ড ডাইনোসরের (নডোসর) যে ফসিলটি ২০১১ সালে আলবার্টায় তৈলকূপ খননের সময় আবিষ্কার হয়, সেটিকে বলা হয় ‘বেস্ট প্রিজার্ভড এভার’। ক্যালগেরির থেকে ঘণ্টা দেড়েকের ড্রাইভে ছোট্ট শহর ড্রামহেলারের ‘দ্য রয়াল টাইরেল মিউজিয়াম’টি ডাইনোসর সম্পর্কে জানার যোগ্য জায়গা।

মিউজিয়াম দেখা শেষ হলে আরও ঘণ্টা দেড়েকের ড্রাইভে চলে গেলাম ডাইনোসর প্রাদেশিক পার্ক দেখতে। আলবার্টায় ড্রাইভ করার বিশেষত্ব হচ্ছে হলুদ বর্ণের বিস্তীর্ণ ক্যানোলা ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে শতশত মাইল ড্রাইভ করা। ক্যানোলা আলবার্টা তথা কানাডার অন্যতম অর্থকরী ফসল। ক্যানোলার আবিষ্কারক কানাডা সঙ্গত কারণেই বিশ্বের এক নম্বর ক্যানোলা উৎপাদক আর রপ্তানিকারক দেশ। 

অদ্ভুত সুন্দর ল্যান্ড স্কেপ ডাইনোসরের প্রাদেশিক পার্ক এলাকাটির। খনন কাজ অব্যাহত আছে। শতবর্ষের খনন কাজে ১৫০টি পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসরের কঙ্কাল আবিষ্কার হয়েছে এ এলাকায়। প্রায় ৫০ ধরনের ডাইনোসর প্রজাতি পাওয়া গেছে এখানে। ৭৫ মিলিয়ন বছর আগে বড় বড় নদীর বালু আর কাদা জমে এ উপত্যকার  মাটির স্তরগুলো তৈরি হয়েছে।

সবশেষ বরফ যুগের বরফগলা পানির প্রভাবে নানা আকারের নানা বর্ণের মাটির স্তরের অতুলনীয় ল্যান্ডস্কেপটির উৎপত্তি। বিশেষ এ ল্যান্ডস্কেপের জীববৈচিত্র্যও ইউনিক। প্রাদেশিক পার্কে কয়েক ঘণ্টার হাইকিং শুধু  ডাইনোসর নয়, ভূতত্ত্বের এক উৎস সম্পর্কেও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় সিক্ত হবেন।

ভাগ্নের বিয়ে উপলক্ষে ক্যালগেরি ঘোরার সুযোগ হয়েছিল। ভাগ্নে, মানে বর স্বপ্নিল ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল গ্রাজুয়েট হয়ে ম্যাকমাস্টারে ইন্টারনাল মেডিসিনে রেসিডেন্সি করছিল। কনে প্রিমা ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল গ্রাজুয়েট হয়ে ম্যাকমাস্টারে অফথালমোলজিতে রেসিডেন্সি করছিল। বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের ‘হাব’ হিসেবে পরিচিত ক্যালগেরি। গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো ছিল মূলত ক্যালগেরির শতশত বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সমাবেশ। কেননা কনের বাবা নিজে প্রকৌশলী হিসেবে বেশ পরিচিত নাম।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আবারও রকি পর্বত ভ্রমণযাত্রা শুরু। ড্রাইভ করতে হবে আলবার্টা থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় কেলোনায়। ক্যালগেরি থেকে বানফ্ ন্যাশনাল পার্ক হয়ে  স্বল্প দূরত্বের রাস্তায় না গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তরে আলবার্টার রাজধানী অ্যাডমন্টন হয়ে বেশ লম্বা পথে পশ্চিমে জেস্পার ন্যাশনাল পার্ক থেকে দক্ষিণে নেমে কেলোনা যাব। রকি মন্থনে এ সিদ্ধান্তের কারণ অ্যাডমন্টনে ফার্মাসিস্ট দম্পতি রবিন-মৌসুমির আমন্ত্রণে একদিনের জন্যে বেড়িয়ে যাওয়া। সেখানে দেখা হলো কৃতি কৃষিবিদ হাবিব ভাইয়ের সাথে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ডক্টর হাবিব এখন আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেলিব্রেটি অধ্যাপক। কানাডার অর্থনীতিতে ২৬ বিলিয়ন ডলার অবদানের ফসল ক্যানোলা নিয়ে আগেই বলেছি। ক্লাবরুট রোগ ক্যানোলা উৎপাদনে প্রবল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অধ্যাপক হাবিব রোগপ্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করে কানাডার ক্যানোলা চাষীদের মুখে শুধু হাসিই ফোটাননি, কানাডার কৃষি অর্থনীতিতে রেখেছেন বিশাল অবদান। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পথে অ্যাডমন্টনে কিছুটা সময় রবিন-মৌসুমীর যত্ন-আত্তিতে আর কৃষিবিদ বাবুর সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলাম হাবিব ভাই-ভাবীর আতিথেয়তায়। ক্যালগেরি থেকে অ্যাডমন্টন পর্যন্ত ড্রাইভটি আমার কাছে অনেকটাই সাদামাটা মনে হয়েছে, অন্যান্য ইন্টারসিটি যোগাযোগের মত। তবে সামনে হয়তো অপেক্ষা করছিল প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্যের অবগাহনে একটি ড্রাইভ।

রকি পর্বতমালা ভ্রমণের এ পর্যায়ে আলবার্টার অ্যাডমন্টন থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার ড্রাইভ করে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য জেস্পার ন্যাশনাল পার্কের পাথুরে পাহাড়, পাহাড়ের খাদে হিমবাহের বরফ গলা নদী, মিঠা পানির লেইক, মুক্ত মনে ঘুরে বেড়ানো প্রাণিকূলকে আরও কাছ থেকে দেখতে গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ অবস্থান এবং এরকম রকমারি বিনোদন নিতে নিতে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বিশ্বখ্যাত টুরিস্ট শহর কেলোনার দিকে এগোতে থাকলাম।

জেস্পার ন্যাশনাল পার্কে  রয়েছে বেশ কয়েকটি লেইক। মাঝখানে একটি লেইকে নেমে কিছুক্ষণ কায়াকিং, করে আবারো বাপ-ছেলের পালাবদল করে ড্রাইভিং। বানফ ন্যাশনাল পার্কের  সাথে জেস্পার ন্যাশনাল পার্কের পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি আপনাকে উপহার দেবে প্রকৃতির প্যানোরমিক ভিউ আর দ্বিতীয়টি আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির আঁচলে, জীববৈচিত্র্যের পরশে।  কানাডার রকি ভ্রমণে গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ দর্শন অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। ইউরোপের সুইজারল্যান্ড আর কানাডা রকি পর্বত  প্রযুক্তির স্পর্শে বর্তমানে পর্যটকদের হিমবাহ উপভোগ করার জনপ্রিয় ভেন্যু।

জেস্পার পার্ক থেকে দক্ষিণে ড্রাইভ করে বানফের কাছাকাছি এসে আমরা মিলিত হই ট্রান্স কানাডিয়ান হাইওয়ে ওয়ানে। ট্রান্স কানাডিয়ান হাইওয়ে ওয়ান পশ্চিম কানাডায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রান্তের মূল যোগাযোগ সূত্র। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ক্যাম্পলুপ্স সংলগ্ন দাবানল উপদ্রুত এলাকার পাহাড়ি এলাকার দৃষ্টিনন্দন এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যাওয়ার সময় কিছুটা দূরের পাহাড়ে দাবানলটি দেখা যাচ্ছিল। 

এ হাইওয়েতে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলে। কিন্তু উদ্ভুত ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধে গাড়ির গতি কমাতে হচ্ছিলো। দাবানলকে আরেকটু কাছ থেকে চাক্ষুস দেখার আগ্রহে ক্যাম্পলুপ্স শহরে কাছ দিয়ে কিছুটা  ঘুরে কেলোনাতে আসাতে সময় বেশি লেগেছিল।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এক লাখ ৩০ হাজার জনসংখ্যার মাঝারি আকারের শহর কেলোনা। ইতিহাস ঐতিহ্যে আর পর্যটনে বেশ নামডাক।  রকি মন্থনে কেলোনায় রাত যাপনের সিদ্ধান্তে শহরের কেন্দ্রে হোটেলে উঠি। হাইওয়ে ৯৭ দিয়ে শহরে প্রবেশের মুখে ১৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ওকানাগান লেইকের ওপরে উইলিয়াম বেনেট ভাসমান সেতুটি দৃষ্টি কাড়ে। চমৎকার এ সেতুটি দেখে মনে হয়েছিল শহরটিতে রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক কাজ করেছি। সেতুর আশেপাশের পার্ক, হারবার আর রেস্তোরাঁ পাড়া আমাদের কেলোনা ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তোলে।

পরের দিন ওকানাগান লেইকের আঁচলে আশ্রিত খুব সুন্দর শহর কেলোনা থেকে ৫০০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সুন্দর এবং বৃষ্টিবহুল শহর ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সিয়াটলে পৌঁছাই। বোয়িং আর বিল গেটসের মাইক্রোসফটের হেড কোয়াটার সিয়াটলে। বোয়িং প্রোডাকশন সাইট আর মিউজিয়াম দর্শন মিস হওয়া উচিত নয়। বোয়িং মিউজিয়ামে ৭৭৭ সিরিজের উচ্চ প্রযুক্তির এয়ারক্রাফটটি আর বাংলাদেশের পতাকাটি চোখ এড়ায়নি।  মিউজিয়ামের উপরতলা থেকে একের পর নানা ধরনের বোয়িং বিমানের টেস্টিং ফ্লাইট দেখা  বিরল অভিজ্ঞতা।

সিয়াটলের অন্যতম আকর্ষণ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে সি ফুডের জন্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক পাইক প্লেস মার্কেট। জাপানে চাকরির সময়ে প্রজেক্টের কাজে সিয়াটলের বাস্টির বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবার আসা হয়েছে, ফলে এটি আমার খুব পরিচিত একটি শহর। জাপানি সহকর্মীদের সাথে দেড় দশক আগে সিয়াটল মেরিনারস স্টেডিয়ামে বিখ্যাত জাপানি বেইজবল খেলোয়াড় ইচিরু-র খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল।

প্রবাসী কফি প্রেমিকদের বিশ্বখ্যাত কফি শপ চেইন স্টারবাকস এর নাম না জানার কথা নয়। স্টারবাকসের প্রথম স্টোরটি ১৯৭১ সালে শুরু হয়  সিয়াটলের এ পাইক মার্কেটেই। কফির জন্য লাইনে দাঁড়ানোর পরও ভ্যাংকুবারে ফেরার তাড়া থাকায় সপরিবারে কফি খাওয়া হয়নি এখানে। তবে সি ফুড রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেতে ভুলিনি।

সিয়াটল থেকে আবার কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ফেরা। এবার প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে কানাডার তৃতীয় বৃহত্তম শহর রূপবতী ভ্যাংকুবারের হয়ে যাত্রা। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে ভিড়ের কারণে ইমিগ্রেশন পার হতে বেশ সময় লেগে যায়। ভ্যাংকুবারে প্রকৃতির নান্দনিকতা উপভোগ করার আগে পারিবারিক বন্ধুদের কিছুটা সময় না দিলেই নয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা কৃষিবিদ ড. আবু আলী, জাপানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পিএইচডি মেইট বন্ধুবর ড. রব্বানী আর আনন্দমোহন কলেজের পরিচিত মুখ খোকা ভাইয়ের সাথে কেটেছে বেশ  কিছুক্ষণ।

পরের দিন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের রাজধানী ভিক্টোরিয়া ভ্রমণ। ফেরিতে করে যেতে হবে ভ্যাংকুবার আইল্যান্ডে। ওই দিন সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে বলে সকাল সকাল রওয়ানা দিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের বর্ধিত অংশ হারো প্রণালী ভ্যাংকুবার আইল্যান্ড বা ভিক্টোরিয়াকে বিচ্ছিন্ন করেছে ভ্যাংকুবার সিটি থেকে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। এ প্রণালীটি কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সীমান্ত।

ফেরিতে গাড়ি পার্ক করে উপরের দিকে যাত্রীদের বসার আরামারদায়ক জায়গায় ঘণ্টা দেড়েকের আয়েশি ভ্রমণ দিলাম। মুগ্ধ হলাম হারো প্রণালীর ইকো সিস্টেম দেখে।

আমাদের গন্তব্য ভিক্টোরিয়া বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় একটি ভেন্যু। বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বোটানিক্যাল গার্ডেন বুচার্ট এখানে। প্রাদেশিক পার্লামেন্ট, ভিক্টোরিয়া বিমানবন্দর, নৌবন্দরসহ কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার আগেই বুচার্ট গার্ডেন দেখার পর্বটি সেরে ফেলি। ভীষণ সুন্দর একটি ল্যান্ডস্কেপে পুরো গার্ডেনটি। কানাডিয়ান উদ্যোক্তা, জাপানি আর ইতালিয়ান ডিজাইনারদের মমতায় তৈরি হয়ে গেল বৈশ্বিক ফুল আর উদ্ভিদ প্রেমিকদের আকর্ষণীয় একটি বাগান। বছরে মিলিয়ন দর্শক ছুটে আসে কানাডার এই ঐতিহাসিক দেখতে। বাহারি ফুলের, গাছপালা, পাখি আর নান্দনিক স্থাপনার পাশাপাশি  জাজ উৎসব, আতশবাজির উৎসব অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে একে।

রকি পর্বতমালা ঘুরতে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখেই কি কেবল মন ভরে! সিদ্ধান্ত নিলাম রকি পর্বতে চড়তে হবে। ভিক্টোরিয়া দেখার পর ভ্যাংকুবারের বাসিন্দা বন্ধুবর রাব্বানীর পরিবারের সাথে  রকি আরোহণ ছিল আমাদের আরেকটি অ্যাডভেঞ্চার।

হুইসলার, ভ্যাংকুবার সিটির উত্তরে একটি পর্যটন কেন্দ্র। ২০১০ সালের শীতকালীন অলিম্পিক ভেন্যু ছিল। ল্যান্ডস্কেপের নান্দনিকতায় হুইসলার সংলগ্ন এলাকায় হুইসলার আর ব্ল্যাককম্ব পর্বতের সমন্বয়ে গঠিত রকিরেঞ্জ এক কথায় অপূর্ব, বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিসেবে এর খ্যাতি। হুইসলার পৃথিবীর দীর্ঘতম স্কি রিসোর্টের জন্যও বিখ্যাত। রোপওয়ে বা গন্ডোলা দিয়ে প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে রকির সৌন্দর্য উপভোগ করা অন্যরকম এক ভাললাগা। হুইসলারে রকি পর্বতে উঠতে রোপওয়ের একাধিক স্তর আছে। বেশ সাহসী না হলে রোপওয়ের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো হয়ে ওঠেনা। গৃহকর্ত্রীদের অনেকেরই  উচ্চতাভীতি থাকে, আমাদের ক্ষেত্রে তাই হল, কর্ত্রীরা বেশি উপরে উঠতে চাইলেন না। পর্বতারোহণে আমি আর আমার ছেলেমেয়েরা অভ্যস্ত, তাই ওদের সাথে যতটুকু উপরে যাওয়া যায়- উঠে গেলাম। রব্বানী পরিবার রকির চূড়ায় একটি রোপওয়ে স্টেশনে জোহরের নামাজ সেরে নিলেন।

ধাপে ধাপে চূড়ায় ওঠার জন্য বিভিন্ন সক্ষমতার রোপওয়ে/গন্ডোলা থাকে। বেঞ্চি ধরনের উন্মুক্ত রোপওয়ে সাধারণত স্বল্প দূরত্বে যায়, পা ছড়িয়ে বসে উপরে নিচে চারিদিকে দেখাটি রোমাঞ্চকর। দূরপাল্লার যাত্রায় কিংবা গভীর খাদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে ব্যবহৃত  গন্ডোলা হচ্ছে  ‘ক্লোজড বক্স’ ধরনের। গন্ডোলা দিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাবার আমার জাপান আর ইউরোপের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে দ্বিধা নেই রকিরেঞ্জের খাদগুলো অনেক বেশি গভীর। নিচের দিকে তাকালে ঘর বাড়িগুলো যে রকম ছোট দেখায়, তাতে কতোটা উঁচুতে ধাতব তারের কৃপায় ঝুলে আছেন অনুভবে অসুবিধে হয়না। উচ্চতাভীতি আছে যাদের- তাদের জন্য অবশ্য এ  আয়োজন নয়।

রকি থেকে ফিরে ভ্যাংকুবারের বিখ্যাত স্টেনলি পার্ক, ডাউন টাউন আর ভিন্ন ধরনের স্থাপত্যের প্যান-প্যাসিফিক হোটেল এলাকা বেড়ানোর কাজটি সেরে ফেলি। বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে বহু দেশে প্যান-প্যাসিফিক হোটেল অবস্থানে সুযোগ হয়েছিল। জাপানে থাকাকালীন প্রথববারের মত পেশাগত কাজে ভ্যাংকুবারে এসে এ হোটেলটির স্থাপত্য আর লোকেশন দৃষ্টি কেড়েছিল বটে।

রকি পর্বতমালা দর্শনে পারিবারিক এ আয়োজনে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম কোস্টে প্রায় সাড়ে তিনহাজার কি.মি. ড্রাইভের সিংহভাগ করেছিল আমার ছেলে আসাহী। লং ড্রাইভের শেষ পর্যায়টি ছিল ভ্যাংকুবার বিমান বন্দরে ভাড়া করা রেংগ্লার জিপটি জমা দিয়ে বিমানে মন্ট্রিয়লে ফেরা। চেক ইন আর সিকিউরিটি পেরিয়ে চলে গেলাম এয়ার কানাডার এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জে। এয়ার কানাডার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত যাত্রী হওয়ার কারণে পুরো পরিবার নিয়ে লাউঞ্জের সুবিধেভোগী। এ সুবিধেগুলো উপভোগে তরুণদের আগ্রহ বরাবরই বেশি থাকে, বিশেষ করে খাবারের রকমারি আইটেমে। রাতের খাবার আর কম্পিউটারে কিছুটা কাজ সেরে নিলাম লাউঞ্জে।

ভ্যাংকুবার থেকে এয়ার কানাডার বোয়িং ৭৭৭ এর রাত্রিকালীন রেডআই ফ্লাইটটি যখন ভ্যাংকুবার ত্যাগ করছিল, আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তখন জমা হয়ে গেছে রকি পর্বত আর ডাইনোসরের হারানো রাজ্যের পুঞ্জিভূত সুখস্মৃতি।

লেখক: কলামনিস্ট  এবং বায়োটেক  বিষয়ে বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত।

লেখকের ইমেইল: ssyed@lallemand.com

ছবি: লেখক

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!