বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’, সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘উঠোন পেরিয়ে দুই পা’ কতবার যে পড়েছি, পড়তে পড়তে রোমাঞ্চিত হয়েছি, আর ভেবেছি কবে একটু সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় হবে! সেই সুযোগটা খুব বড় হয়ে ধরা দিলো যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি স্কলারশিপ পাওয়ার পর। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি সামারে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক বিস্ময়ে ঢুঁ মেরে আসি।
প্রথম বাহন লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্স থেকে এয়ারে গেলাম কলোরাডোর ডেনভারে, সেখানে পৌঁছে ৫ দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেললাম। ডেনভার শহরে দুপুরের খাওয়া সেরে আমাদের প্রথম গন্তব্য এস্টেস পার্ক। কিন্তু সেখানে যাওয়ার রাস্তা দুটো, ইচ্ছে করে আমরা একটু ঘুরো পথ নিলাম- ডেনভার থেকে লাভল্যান্ড হয়ে এস্টেস পার্ক। সোয়াম্প আর সমতলের অনেকটা বাংলাদেশি আবহাওয়ার লুইজিয়ানা থেকে কলোরাডো গিয়ে শুরুতে সব ল্যান্ডস্কেপ একটু আলাদা সুন্দর লাগে।
পাহাড় চূড়ায় উঁচু-নিচু রাস্তা, ট্রেইলরিজ রোড ধরে ধরে শুরু হলো আমাদের পথচলা। পথের মাঝে ঈগল ক্লিফ মাউন্টেইন, ডিয়ার মাউন্টেইন ও সানড্যান্স মাউন্টেইন দেখলাম, রেইনবো কার্ভ ওভারলুক- ফরেস্ট ক্যানিয়ন ওভারলুকে থামলাম; কলোরাডো রিভার ট্রেইলহেড ধরে হেঁটে গিয়ে নদীটা দেখে আসলাম। পুরোটা রাস্তাজুড়ে যা দেখি তাই যেন সুন্দর; তাই আমরা ঠিক গন্তব্য ভুলে পথকেই গন্তব্য মেনে নিলাম। তবু দুপুর গড়ানোর আগে পৌঁছে গেলাম গ্র্যান্ড লেইকে। গ্রান্ড লেইকভর্তি সেইল বোট, পেছনে পাইন গাছ আর পাহাড়ের ঢাল ধরে লেইকপাড়ের বাড়িগুলো দেখে আমার গলা ছেড়ে গাইতে মন চাইলো আব্বুলিশের সেই প্রিয় গানটি- ‘দেখোতো বনের গাছে, দেখোতো নদীর কাছে চলো/ বানাবো কাঠের বাড়ি, আমাকে নেবে কি? তুমি বলো’।
সারা রাস্তায় আমাদের কারও ফোনের কোনো নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না, দুপুরে আর একটা প্রেজেন্টেশন ছিলো, তাই পথে ল্যান্ডার নামে ছোট্ট একটা শহরে এক সাবওয়েতে ঢুকে ওয়াইফাই কানেক্ট করে সেই প্রেজেন্টেশন সারলাম। তিন ড্রাইভার মিলে প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়ে, বিকেল হতে হতে গ্র্যান্ড টেটোন ন্যাশনাল পার্ক ডিঙিয়ে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে ঢুকলাম। প্রথম দিনের প্ল্যান ছিলো শুধু ওল্ডফেইথ ফুল গাইজার দেখা। ঠিক যে মুহূর্তে আমরা পৌঁছেছি- ঠিক তখন সবচেয়ে বড় গাইজার দিয়ে অসাধারণ এক জিওথারমাল উদগিরণ দেখতে পেলাম। পাহাড়, বন-বনানীর মাঝখান দিয়ে চারদিকে বিভিন্ন গাইজার থেকে সাদা উদগিরণের দৃশ্যে চারদিকের আকাশ ছেয়ে গেছে; একটু পরপর যেমন ফুটন্ত জলাধার, হালকা সালফাইডের গন্ধ আমার সেই নটরডেম কলেজের কেমেস্ট্রি ল্যাবের কথা মনে করিয়ে দিলো।
ইয়েলোস্টোন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীর প্রথম ঘোষিত ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় নয় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ পার্ক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি স্টেইট জুড়ে আছে- ওয়াইয়োমিং, আইডাহো আর মন্টানা। এ পার্কের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, অনেক জিওথার্মাল গাইজারের উদগিরণস্থল, আর পাহাড়-ঝরনা-বনানী। এতকিছু দেখার ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করার আছে যে এ পার্কে বোধ হয় মাসব্যাপী সময় কাটালেও শেষ হবে না। তবু আমরা প্ল্যান করলাম যতটুকু দেখা যায়। তাই আবার পরদিন খুব ভোরে উঠে বের হয়ে গেলাম, প্রথম গন্তব্য নরিস গাইজার বেসিনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে পরলো বিশাল এলাকাজুড়ে এল্ক-এর বিশাল পাল, তাদের দেখে ছবি তুলে আমরা পৌঁছলাম নরিস গাইজার বেসিন, সেখানেও ভিন্নমাত্রার গাইজার উদগিরণ দেখে গেলাম ম্যামথ হট স্প্রিং-এ।
পাহাড় ধরে শুরুতে কিছুটা হাইক করে নেমে গেলাম লোয়ার ফলসকে কাছ থেকে দেখতে, যার গভীরতা ৩০৮ ফিট, নায়াগ্রা ফলসেরও প্রায় দ্বিগুণ। নিচে নেমে যা দেখলাম, আমি বিস্মিত; এত তীক্ষ্ণ এত প্রকট, এত অসামান্য রঙধনু আমি জীবনেও দেখিনি। মনে হচ্ছিলো যেন এ রঙধনুর দিকে অনন্তকাল শুধু তাকিয়েই থাকা যায়। যাই হোক- একটা বড় সময় কাটালাম আমরা এই ক্যানিয়ন, লোয়ার ফলস আর আপার ফলসে। আমাদের গন্তব্যগুলো যেন একটা থেকে অন্যটা বেশি করে টানছে- মনে হচ্ছিলো প্রত্যেকে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য নিয়ে পাগল করে দিতে যেন মুখিয়ে ছিলো।
পথে বাইসন, মোস, এল্ক-এর জন্য গাড়ি থামাতে হলো- নেমে কিছু ছবি তুললাম। গ্র্যান্ড টেটোনে জ্যাকসন লেইক- জেনি লেইক, স্নেইক রিভার, সিনিকলুপ ড্রাইভ- সবমিলিয়ে আর এক সৌন্দর্যের সমুদ্র যেন। বিকেল গড়িয়ে পাশের জ্যাকসন শহরে খাবার খেয়ে আমরা আবার দীর্ঘ ড্রাইভ শুরু করলাম, আর এক অসামান্য পথ ধরে ধরে। আমরা তিনজন ড্রাইভার, সবাই যেন কাড়াকাড়ি করছিলাম, গাড়ি চালাতে- এত মনোমুগ্ধকর সে ড্রাইভ, যে গাড়ি চালানোর বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসেনি।
লেখক: গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অর্লিন্স, লুইজিয়ানা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |