ভ্রমণ কাহিনি: বিশ্বের প্রথম জাতীয় উদ্যানে

ছোটবেলা থেকে শুরুতে দেশটা তারপর পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আমার স্বপ্ন ছিলো। দেশ-বিদেশের সব সিনেমা দেখার সময় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চাইতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড বা আবহের দৃশ্যপট আমাকে বেশি টানতো।

খাইরুল হাবিব পুলক, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিন্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2021, 02:03 PM
Updated : 16 Sept 2021, 02:42 PM

বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’, সুনীলের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘উঠোন পেরিয়ে দুই পা’ কতবার যে পড়েছি, পড়তে পড়তে রোমাঞ্চিত হয়েছি, আর ভেবেছি কবে একটু সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় হবে! সেই সুযোগটা খুব বড় হয়ে ধরা দিলো যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি স্কলারশিপ পাওয়ার পর। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি সামারে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক বিস্ময়ে ঢুঁ মেরে আসি।

তিন গাড়িচালক

এবারের গন্তব্যটা ছিলো সবগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক ঢিলে তিন পাখি, অর্থাৎ একযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত ও অসামান্য তিন ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে আসা- রকি মাউন্টেইন, ইয়েলোস্টোন, আর গ্র্যান্ড টেটোন। শুরুটা হলো হুট করে- প্রায় একসঙ্গে, পিএইচডি প্রপোজাল, তিনটা কনফারেন্স পেপার আর প্রজেক্টের রিপোর্ট সাবমিশনের এক ঝড় পারি দিতেই এক বড় ভাই বললেন, চলো যাই। ভাবনা-চিন্তা না করে এয়ারটিকেট কেটে রওনা দিয়ে দিলাম।

প্রথম বাহন লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্স থেকে এয়ারে গেলাম কলোরাডোর ডেনভারে, সেখানে পৌঁছে ৫ দিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেললাম। ডেনভার শহরে দুপুরের খাওয়া সেরে আমাদের প্রথম গন্তব্য এস্টেস পার্ক। কিন্তু সেখানে যাওয়ার রাস্তা দুটো, ইচ্ছে করে আমরা একটু ঘুরো পথ নিলাম- ডেনভার থেকে লাভল্যান্ড হয়ে এস্টেস পার্ক। সোয়াম্প আর সমতলের অনেকটা বাংলাদেশি আবহাওয়ার লুইজিয়ানা থেকে কলোরাডো গিয়ে শুরুতে সব ল্যান্ডস্কেপ একটু আলাদা সুন্দর লাগে।

কিন্তু যে লাভল্যান্ড পেরুলাম, দুপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের ভেতরে যেন একটা গলি পথের মতো আমাদের রাস্তা, আর রাস্তার সঙ্গে অসামান্য প্রবাহী এক পাহাড়ি নদী- বিগ থম্পসন রিভার। কি যে অসাধারণ সেই নদীর স্রোত আর পাহাড়ঘেরা পথের ড্রাইভটুকু, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। সন্ধ্যা হতে এস্টেস পার্কে পৌঁছে আগে থেকে বুক করে রাখা একটি হোটেলে উঠলাম। রাতের খাবার কিনতে যখন বের হয়েছি রাস্তায় গাড়ি তুলতে দেখি, অন্ধকারে রাস্তা পাড়ি দিচ্ছে হরিণ প্রজাতির প্রাণী এল্ক, ওদের আঙিনায় আমরাই তো অনাহুত মানুষ, তাই গাড়ি থামিয়ে ওদের চলাচল সুগম করলাম। তারপর রাতটা হোটেলে কাটিয়ে খুব ভোরে উঠে রওনা দিয়ে দিলাম- রকি মাউন্টেইন ন্যাশনাল পার্কে, এত ভোরে যে গেটে টিকেটও লাগলো না।

পাহাড় চূড়ায় উঁচু-নিচু রাস্তা, ট্রেইলরিজ রোড ধরে ধরে শুরু হলো আমাদের পথচলা। পথের মাঝে ঈগল ক্লিফ মাউন্টেইন, ডিয়ার মাউন্টেইন ও সানড্যান্স মাউন্টেইন দেখলাম, রেইনবো কার্ভ ওভারলুক- ফরেস্ট ক্যানিয়ন ওভারলুকে থামলাম; কলোরাডো রিভার ট্রেইলহেড ধরে হেঁটে গিয়ে নদীটা দেখে আসলাম। পুরোটা রাস্তাজুড়ে যা দেখি তাই যেন সুন্দর; তাই আমরা ঠিক গন্তব্য ভুলে পথকেই গন্তব্য মেনে নিলাম। তবু দুপুর গড়ানোর আগে পৌঁছে গেলাম গ্র্যান্ড লেইকে। গ্রান্ড লেইকভর্তি সেইল বোট, পেছনে পাইন গাছ আর পাহাড়ের ঢাল ধরে লেইকপাড়ের বাড়িগুলো দেখে আমার গলা ছেড়ে গাইতে মন চাইলো আব্বুলিশের সেই প্রিয় গানটি- ‘দেখোতো বনের গাছে, দেখোতো নদীর কাছে চলো/ বানাবো কাঠের বাড়ি, আমাকে নেবে কি? তুমি বলো’।

বাইসনের বিচরণ

গ্র্যান্ড লেইকে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে, পাশের সাবওয়েতে লাঞ্চ সেরে আমরা রওনা দিলাম যেদিক থেকে এসেছি তার উল্টো দিকে। বাকিটা দিন আমরা গাড়ি চালালাম পাহাড়, নদী, বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর সবুজ বনানী ধরে। রকি মাউন্টেইন ডিঙিয়ে, কলোরাডো স্টেইট থেকে ঢুকে পড়লাম ওয়াইয়োমিং-এ, রাত হতে হতে আমাদের গন্তব্য ওয়াইয়োমিং-এর রলিন্স শহরে। পরদিন ছিলো আমার একটা কনফারেন্স, হোটেলের লবিতে বসে ভার্চুয়ালি প্রথম প্রেজেন্টেশন দিয়ে রওনা দিলাম ইয়েলোস্টোনের পথে।

সারা রাস্তায় আমাদের কারও ফোনের কোনো নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না, দুপুরে আর একটা প্রেজেন্টেশন ছিলো, তাই পথে ল্যান্ডার নামে ছোট্ট একটা শহরে এক সাবওয়েতে ঢুকে ওয়াইফাই কানেক্ট করে সেই প্রেজেন্টেশন সারলাম। তিন ড্রাইভার মিলে প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়ে, বিকেল হতে হতে গ্র্যান্ড টেটোন ন্যাশনাল পার্ক ডিঙিয়ে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে ঢুকলাম। প্রথম দিনের প্ল্যান ছিলো শুধু ওল্ডফেইথ ফুল গাইজার দেখা। ঠিক যে মুহূর্তে আমরা পৌঁছেছি- ঠিক তখন সবচেয়ে বড় গাইজার দিয়ে অসাধারণ এক জিওথারমাল উদগিরণ দেখতে পেলাম। পাহাড়, বন-বনানীর মাঝখান দিয়ে চারদিকে বিভিন্ন গাইজার থেকে সাদা উদগিরণের দৃশ্যে চারদিকের আকাশ ছেয়ে গেছে; একটু পরপর যেমন ফুটন্ত জলাধার, হালকা সালফাইডের গন্ধ আমার সেই নটরডেম কলেজের কেমেস্ট্রি ল্যাবের কথা মনে করিয়ে দিলো।

সেখান থেকে সন্ধ্যা হতেই বেরিয়ে পরলাম; আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোন শহরে। ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোন হচ্ছে- আইডাহো, ওয়াইয়োমিং আর মন্টানা- তিন স্টেইটের প্রায় মিলনস্থলের একটা শহর যার অবস্থান মন্টানা স্টেইটে পড়েছে। সেখানে দু-রাতের জন্য আমাদের হোটেল বুক করা ছিলো। ছোট্ট একটা শহর, খুব একটা খাবার-দাবারের দোকানপাট নেই, কিন্তু ইয়েলোস্টোন দেখতে হলে আমি বলব ওটাই সেরা জায়গা থাকার জন্য।

ইয়েলোস্টোন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এমনকি পৃথিবীর প্রথম ঘোষিত ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় নয় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ পার্ক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি স্টেইট জুড়ে আছে- ওয়াইয়োমিং, আইডাহো আর মন্টানা। এ পার্কের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, অনেক জিওথার্মাল গাইজারের উদগিরণস্থল, আর পাহাড়-ঝরনা-বনানী। এতকিছু দেখার ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করার আছে যে এ পার্কে বোধ হয় মাসব্যাপী সময় কাটালেও শেষ হবে না। তবু আমরা প্ল্যান করলাম যতটুকু দেখা যায়। তাই আবার পরদিন খুব ভোরে উঠে বের হয়ে গেলাম, প্রথম গন্তব্য নরিস গাইজার বেসিনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে পরলো বিশাল এলাকাজুড়ে এল্ক-এর বিশাল পাল, তাদের দেখে ছবি তুলে আমরা পৌঁছলাম নরিস গাইজার বেসিন, সেখানেও ভিন্নমাত্রার গাইজার উদগিরণ দেখে গেলাম ম্যামথ হট স্প্রিং-এ।

বিশাল এলাকাজুড়ে এল্ক-এর পাল

পথে কিছু ঝরনার দেখা পাওয়া গেলো। পাথর-শিলা-গাইজার-হট ওয়াটার সব মিলিয়ে ম্যামথ হট স্প্রিং এক অনবদ্য দৃশ্যপট এনে দিলো চোখের সামনে- যা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক সৌন্দর্য। সেখান থেকে গেলাম হেইডেন ভ্যালি, যেখানে অসংখ্য বাইসন ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছেমত। অনেকটা কাছে চলে গেলাম বাইসনের, ছবি তুললাম। তারপর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অব ইয়েলোস্টোন। যদিও এরাইজোনায় প্রকৃতির বিরল বিস্ময় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নই আমার দেখার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু ইয়েলোস্টোনের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যেন এক আলাদা সত্ত্বা। সেখানে আছে দুটো সুগভীর জলপ্রপাত, আপার ফলস আর লোয়ার ফলস।

পাহাড় ধরে শুরুতে কিছুটা হাইক করে নেমে গেলাম লোয়ার ফলসকে কাছ থেকে দেখতে, যার গভীরতা ৩০৮ ফিট, নায়াগ্রা ফলসেরও প্রায় দ্বিগুণ। নিচে নেমে যা দেখলাম, আমি বিস্মিত; এত তীক্ষ্ণ এত প্রকট, এত অসামান্য রঙধনু আমি জীবনেও দেখিনি। মনে হচ্ছিলো যেন এ রঙধনুর দিকে অনন্তকাল শুধু তাকিয়েই থাকা যায়। যাই হোক- একটা বড় সময় কাটালাম আমরা এই ক্যানিয়ন, লোয়ার ফলস আর আপার ফলসে। আমাদের গন্তব্যগুলো যেন একটা থেকে অন্যটা বেশি করে টানছে- মনে হচ্ছিলো প্রত্যেকে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য নিয়ে পাগল করে দিতে যেন মুখিয়ে ছিলো।

গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিকের অনবদ্য দৃশ্যপট

ইয়েলোস্টোন বলতে এর আগে যে ছবিটা প্রথমে মাথায় আসতো সেটা হলো অসামান্য বর্ণিল গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিক স্প্রিং। মিডওয়ে গাইজার বেসিনের মধ্যে গিয়ে যখন খালি চোখে জায়গাটা দেখলাম, তখন আসলে বোঝা গেলো- ছবিতে দেখা ও বাস্তবে দেখার কি বড় পার্থক্য। এই রঙের, এই বর্ণের কোনো তুলনা হয় না। সন্ধ্যা হতেই আবার ওয়েস্ট ইয়েলোস্টোন, রাতের খাওয়া- ঘুম। আবার পরদিন ভোরে উঠে ইয়েলোস্টোনের আরও কিছু স্পট- আপার গাইজার বেসিন, ওয়েস্ট থাম্ব গাইজার বেসিন, ইয়েলোস্টোন লেইক ঘুরে পথ ধরলাম গ্র্যান্ড টেটোন ন্যাশনাল পার্কে।

পথে বাইসন, মোস, এল্ক-এর জন্য গাড়ি থামাতে হলো- নেমে কিছু ছবি তুললাম। গ্র্যান্ড টেটোনে জ্যাকসন লেইক- জেনি লেইক, স্নেইক রিভার, সিনিকলুপ ড্রাইভ- সবমিলিয়ে আর এক সৌন্দর্যের সমুদ্র যেন। বিকেল গড়িয়ে পাশের জ্যাকসন শহরে খাবার খেয়ে আমরা আবার দীর্ঘ ড্রাইভ শুরু করলাম, আর এক অসামান্য পথ ধরে ধরে। আমরা তিনজন ড্রাইভার, সবাই যেন কাড়াকাড়ি করছিলাম, গাড়ি চালাতে- এত মনোমুগ্ধকর সে ড্রাইভ, যে গাড়ি চালানোর বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসেনি।

রাত হয়ে গেলো পৌঁছতে, পরের গন্তব্য ওয়াইয়োমিং-এর লারামি শহর। পরদিন আবার লাভল্যান্ডের সেই পাহাড়- স্রোতের নদী আর সুরঙ্গপথ ঘুরে যখন ডেনভার এয়ারপোর্টে পৌঁছেছি, তখন যেন তারাশঙ্করের ‘কবি’-র কথা একটু বদলে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘প্রকৃতির বিস্ময় দেখে মিটল না আশ- কুলালনা এ জীবনে। হায়, জীবন এত ছোট কেনে?’

লেখক: গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অর্লিন্স, লুইজিয়ানা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!