মনে হচ্ছিল মাউন্ট ফুজির গায়ে নানা রঙের তারার মেলা বসেছে। ওই একগুচ্ছ আলোগুলোই এক একটি কুঁড়েঘর। যার একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব ২০-২৫ মিনিটের আরোহন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমাদের জন্য কোনটা বুকিং দেওয়া হয়েছে। উপায় না দেখে মুস্তাফিজ ভাই স্থানীয় এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলে উনি ম্যাপ দেখিয়ে বললো – ‘তোমরা এখন এখানে আছো। এখান থেকে ২০-২৫ মিনিট উপরে উঠলে একটি কুঁড়েঘরে পাবে, তারপর আরও ৩০ মিনিটের মত উঠে গেলে যে কুঁড়েঘর পাবে সেটাই তোমরা খুঁজছো’।
এ কথা শোনার পর আমরা ভাবছিলাম আমাদের আরও ১ ঘণ্টার মত আরোহন করতে হবে! মানে সত্যিই আরও এক ঘণ্টা! ততক্ষণে আমরা একটানা ৬ ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে ৩ হাজার মিটার উপরে উঠে গেছি। অক্সিজেনের স্বল্পতাও একটু একটু টের পাচ্ছিলাম। সবাই বেশ ক্লান্ত। তাই আরও এক ঘণ্টা আরোহন করতে হবে শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়াটা স্বাভাবিক। তবু আমরা উঠেছিলাম। হয়তো চূড়ায় উঠার তীব্র তৃষ্ণা আমাদের উঠিয়েছিল। সন্ধ্যা সাতটার কিছু সময় পর আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা কুঁড়েঘরে পৌঁছে যাই।
যতই উপরে উঠছিলাম রাস্তা যেন তত সরু হয়ে আসছিল। কোথায় কোথাও তো আবার একজন হাঁটার মতও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যে একটু বিশ্রাম নেবো তার জন্যও কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। আমরা দাঁড়িয়ে গেলে আমাদের পিছে শত শত মানুষের মানুষজট লেগে যাবে। কিন্তু বিশ্রাম তো নিতে হবে। একটু চওড়া জায়গা দেখলেই আগ্নেয়শিলার উপরে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করছিলাম। বসে নিচের দিকে তাকালে শত শত চলমান বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যাচ্ছিল। অনেকটা জোনাকির মত। কিন্তু এগুলো জোনাকি নয়, এরা আমাদের মতই মাউন্ট ফুজি আরোহন করছেন।
আমরা যখন ফুজি সান সামিট করি তখন ঘড়িতে ভোর ৪টা বেজে ৫৩ মিনিট। সূর্যোদয় ৫টা বেজে ৩ মিনিটে, সেই কাঙ্ক্ষিত সোনালি মুহূর্তের সাক্ষী হতে এখনো আনুমানিক দশ মিনিটের অপেক্ষা। আমাদের মত আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। কারও হাতে মোবাইল ফোন, কেউ আবার দামি ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। মুস্তাফিজ ভাই একটা গোপ্রো অ্যাকশন ক্যামেরা কিনলে আমরাও ওই দামি ক্যামেরাওয়ালা মানুষের কাতারে পরতাম। আমরা অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু মানুষটা আমাদের পাত্তাই দিল না।
ঐশ্বর্যময় সোনালি আলো তার তেজ দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে চারদিকে আলোকিত করে ফেলল, সত্যিই বিস্ময়কর এক মুহূর্ত। উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে একটি নতুন দিনের জন্ম দেখার অভিজ্ঞতা সত্যি অসাধারণ। শিক্ষার্থী দম্পতি ও দুই বন্ধুর কাছে মাউন্ট ফুজির চূড়া থেকে লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর মুহূর্ত জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে, আজীবন।
লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, চিবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |
আগের পর্ব