ভ্রমণ কাহিনি: মাউন্ট ফুজি জয়, শেষ পর্ব

সূর্য পাহাড়ের অন্যপাশে থাকায় ততক্ষণে অল্প অল্প অন্ধকার নেমে এসেছে। উপরে পাহাড়ি কুঁড়েঘরগুলোতে আলো জ্বলছে। মাথা উঁচু করে উপরে তাকালেই গুচ্ছ গুচ্ছ মিট মিট করে জ্বলতে থাকা লাইট দেখা যাচ্ছিল।

সুদ্বীপ পাল শুভ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2021, 04:40 AM
Updated : 8 Sept 2021, 04:40 AM

মনে হচ্ছিল মাউন্ট ফুজির গায়ে নানা রঙের তারার মেলা বসেছে। ওই একগুচ্ছ আলোগুলোই এক একটি কুঁড়েঘর। যার একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব ২০-২৫ মিনিটের আরোহন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমাদের জন্য কোনটা বুকিং দেওয়া হয়েছে। উপায় না দেখে মুস্তাফিজ ভাই স্থানীয় এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলে উনি ম্যাপ দেখিয়ে বললো – ‘তোমরা এখন এখানে আছো। এখান থেকে ২০-২৫ মিনিট উপরে উঠলে একটি কুঁড়েঘরে পাবে, তারপর আরও ৩০ মিনিটের মত উঠে গেলে যে কুঁড়েঘর পাবে সেটাই তোমরা খুঁজছো’।

এ কথা শোনার পর আমরা ভাবছিলাম আমাদের আরও ১ ঘণ্টার মত আরোহন করতে হবে! মানে সত্যিই আরও এক ঘণ্টা! ততক্ষণে আমরা একটানা ৬ ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে ৩ হাজার মিটার উপরে উঠে গেছি। অক্সিজেনের স্বল্পতাও একটু একটু টের পাচ্ছিলাম। সবাই বেশ ক্লান্ত। তাই আরও এক ঘণ্টা আরোহন করতে হবে শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়াটা স্বাভাবিক। তবু আমরা উঠেছিলাম। হয়তো চূড়ায় উঠার তীব্র তৃষ্ণা আমাদের উঠিয়েছিল। সন্ধ্যা সাতটার কিছু সময় পর আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা কুঁড়েঘরে পৌঁছে যাই।

ডান থেকে শিক্ষার্থী দম্পতি ও দুই বন্ধু

অর্থী আপু অভ্যর্থনা কক্ষে টিকিট দেখাতেই একজন মধ্যবয়সী মহিলা আমাদের ফেইস মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। হ্যাঁ কোন ফলের জুস কিংবা ফুল নয়; ফেইস মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার! করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পৃথিবীর পুরো সিস্টেমে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তবে হোটেল বা রিসোর্টের বেলায় তা ভিন্ন হবে কেন? তাই এভাবে অভ্যর্থনা পেয়ে আমি মোটেও অবাক হইনি। বরং নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। রাতের খারাব খেতে বসে পরিবেশনকারীকে কেমন প্যারা দিয়েছিলাম সেটা না হয় না বলাই থাক। তবে ভদ্রলোকটি বেশ আন্তরিক ছিলেন বলতে হবে। এবার ঘুমানোর পালা। কারণ মাঝরাতে আমাদের শেষ প্রস্থের আরোহন সম্পন্ন করে সূর্য উঠার আগের শিখরে পৌঁছতে হবে, নয়তো এত কষ্ট, এত স্বপ্ন সব বৃথা হয়ে যাবে।

হৃদয়ে বাংলাদেশ

এ রাতেও ঘুমটা ঠিকঠাক হলো না, কিন্তু আমাদের দলের একজন ঠিকই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল আর আমার হিংসে হচ্ছিলো। রাত ১টা বেজে ৫০ মিনিটে আমরা মাউন্ট ফুজির চূড়া অভিমুখে আবার আরোহন শুরু করলাম। আরও তিন ঘণ্টা লাগবে বলে শুনেছি! কিন্তু পর্বতে সাফল্য অর্জনে কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। রাস্তা খুব বেশি কঠিন না হলেও ভয়ংকর রকমের খাড়া ছিল, সঙ্গে রাতের আঁধার যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি বেশ বিপদসঙ্কুল মনে হচ্ছিল। তাছাড়া উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় ভোগার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাপমাত্রাও হিমাংকের নিচে চলে গেছে বলে অনুভব করছিলাম।

যতই উপরে উঠছিলাম রাস্তা যেন তত সরু হয়ে আসছিল। কোথায় কোথাও তো আবার একজন হাঁটার মতও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যে একটু বিশ্রাম নেবো তার জন্যও কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। আমরা দাঁড়িয়ে গেলে আমাদের পিছে শত শত মানুষের মানুষজট লেগে যাবে। কিন্তু বিশ্রাম তো নিতে হবে। একটু চওড়া জায়গা দেখলেই আগ্নেয়শিলার উপরে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করছিলাম। বসে নিচের দিকে তাকালে শত শত চলমান বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যাচ্ছিল। অনেকটা জোনাকির মত। কিন্তু এগুলো জোনাকি নয়, এরা আমাদের মতই মাউন্ট ফুজি আরোহন করছেন।

চার ফুজিপ্রেমী

পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমরা প্রায় চূড়ার কাছে চলে এসেছি। বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ঘন মেঘ থাকায় দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ আমাদের সামনে দেখা দিল তরী ফটক। এটি এক বিশেষ ধরনের ফটক যা জাপানের মন্দিরগুলোর সামনে দেখা যায়। এবার আর বুঝতে বাকি নেই আমরা মাউন্ট ফুজি জয় করে ফেলেছি। পূর্ব দিগন্তে এখন বেশ ভালোই কালচে কমলা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে; বুঝলাম সূর্যোদয়ের সময় হয়ে এসেছে।

আমরা যখন ফুজি সান সামিট করি তখন ঘড়িতে ভোর ৪টা বেজে ৫৩ মিনিট। সূর্যোদয় ৫টা বেজে ৩ মিনিটে, সেই কাঙ্ক্ষিত সোনালি মুহূর্তের সাক্ষী হতে এখনো আনুমানিক দশ মিনিটের অপেক্ষা। আমাদের মত আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। কারও হাতে মোবাইল ফোন, কেউ আবার দামি ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। মুস্তাফিজ ভাই একটা গোপ্রো অ্যাকশন ক্যামেরা কিনলে আমরাও ওই দামি ক্যামেরাওয়ালা মানুষের কাতারে পরতাম। আমরা অনেক বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু মানুষটা আমাদের পাত্তাই দিল না।  

কাঙ্ক্ষিত সোনালি মুহূর্তের সাক্ষী

আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমরা সত্যি মাউন্ট ফুজির শিখরে দাঁড়িয়ে আছি; আর কিছুক্ষণ পর সূর্যোদয় দেখবো। শেষ পর্যন্ত, আমরা যে মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তা এসে গেছে। সূর্য পূর্ব দিগন্তের উপরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ আলোকিত হতে শুরু করেছে। হঠাৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্বত আরোহনের সমস্ত অস্বস্তি, সমস্ত ক্লান্তি এক নিমিষে গলে মেঘের সঙ্গে উড়ে গেল। দিনের নতুন সূর্যের উজ্জ্বল কমলা আলো তার আভা দিয়ে মেঘের রাজ্যের উপরে এক অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে শুরু করলো।

ঐশ্বর্যময় সোনালি আলো তার তেজ দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে চারদিকে আলোকিত করে ফেলল, সত্যিই বিস্ময়কর এক মুহূর্ত। উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে একটি নতুন দিনের জন্ম দেখার অভিজ্ঞতা সত্যি অসাধারণ। শিক্ষার্থী দম্পতি ও দুই বন্ধুর কাছে মাউন্ট ফুজির চূড়া থেকে লাল সবুজের পতাকা উড়ানোর মুহূর্ত জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে, আজীবন।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, চিবা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!

আগের পর্ব