এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তার মধ্যে অনেকে আইসিইউতে আছেন। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। শুরুতে এ প্রকোপ কম থাকাতে লকডাউন চলছিলো বেশ ঢিলেঢালাভাবে। কারণ প্রথম ও দ্বিতীয়বার এমন লকডাউন দিয়ে ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
কিন্তু এবার আর সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। উপরন্তু দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিলো। সত্যি কথা বলতে এখনও বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে কমিউনিটিতে আক্রান্তের সংখ্যা কোনভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আর সংক্রমণ রোধের একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে লকডাউন। এ লকডাউনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে সবার্বগুলোতে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ দেখা দিয়েছে সেগুলোর সবগুলোতে লকডাউন চলছে। কিন্তু কিছু সবার্বকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে কমিউনিটি সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। সেই সবার্বগুলো হচ্ছে - ব্ল্যাকটাউন, ক্যাম্বেলটাউন, ক্যান্টারবুরি-ব্যাংকসটাউন, কাম্বারল্যান্ড, ফেয়ারফিল্ড, জর্জেস রিভার, লিভারপুল ও পারামাটা।
নাগরিকদের বাসায় থাকার জন্য প্রতিদিন নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারসহ অন্যান্য দায়িত্বরত কর্মকর্তারা অনুরোধ করে যাচ্ছেন। কোন দরকারে বাসা থেকে বের হলেও বাসার কেন্দ্র থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সবার্বগুলোর জন্য পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে।
টিকা কেন্দ্রের বাইরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইন
এছাড়া সবাইকে টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে তাদের প্রতিদিনকার বক্তব্যে। বলা হচ্ছে যে টিকাই পান নিয়ে নিন, কারণ টিকা নেওয়া মানুষের শরীরে সংক্রমণের হার অনেক কম। এছাড়া এখন পর্যন্ত যারা মারা গিয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন যিনি প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। অন্যরা কোন টিকাই নেয়নি। আগে বয়সের হিসাবে বয়স্কদের জন্য টিকা নির্ধারিত ছিলো। কয়েকটা ধাপে বয়সসীমা বাড়িয়ে এখন আঠারো বছরের চেয়ে বড় যে কেউ টিকার জন্য আবেদন করতে পারবেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে। অস্ট্রেলিয়াতে বর্তমানে দুই ধরণের টিকা দেওয়া হচ্ছে – ফাইজার ও অ্যাস্ট্রেজেনেকা।
এর মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনিতে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। পরেরবার আবার একইরকম সমাবেশ করতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে সেটা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে এখন পর্যন্ত টিকা নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। যদিও টিকা কেন্দ্রের বাইরে প্রতিদিন অপেক্ষমান মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
আমার প্রথম ডোজের টিকা নেওয়ার সময় ছিলো ৫ জুলাই সকাল আটটা ত্রিশ মিনিট। আমি তাই সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অত সকালেও দেখি আমার সামনে গোটা বিশেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের সঙ্গে আমার পেছনে লাইন দীর্ঘ হতে শুরু করলো।
টিকা নেওয়ার পর পনের মিনিট অপেক্ষা করতে হয় অবজারভেশন কক্ষে
এরপর টিকা কক্ষে প্রবেশের পর আবারও তথ্যগুলো যাচাই করে টিকাপ্রার্থীর শারীরিক বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে নেন। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী টিকার বিষয়ে বিস্তারিত বলেন, যেমন - কোন ব্র্যান্ডের টিকা, কত পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কতদিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে আসতে হবে। টিকা নেওয়া হয়ে গেলে সবাইকে অবজারভেশন কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। টিকাদানকারী টিকা দেওয়ার সময় থেকে হিসাব করে একটা সাদা কাগজের স্টিকারে পনের মিনিট পরের সময়টা লিখে সেটা জামার সঙ্গে লাগিয়ে নিতে বলেন। অবজারভেশন কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করার পর সেই স্টিকারের সময় ধরে ধরে সবাইকে ডেকে আবার লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। এরপর আবারও একজন স্বাস্থ্যকর্মী সবকিছু চেক করেন। যেমন টিকা নেওয়ার পর কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, সমস্যা হলে কী ধরণের ব্যবস্থা নিতে হবে এসব বিষয়ে পরামর্শ দেন।
ঠিক একইভাবে তিন সপ্তাহ পর নিতে হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ। আমাদের বন্ধু আশফাক ভাই এবং দিশা ভাবি টিকা নিয়েছিলেন ক্যান্টারবুরি কেন্দ্র থেকে। দুই ডোজ টিকা নেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোন করে জানানো হয় উনারা টিকা নেওয়ার জন্য যে সময়টা কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন সেই সময়ে ওখানে এমন একজন ছিলেন পরবর্তীতে যাকে পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পজিটিভ বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাই উনাদেরকে আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং তিনদিন অন্তর অন্তর পরীক্ষা করাতে হবে। উনাদের প্রথম পরীক্ষাতে ভাইরাস ডিটেক্ট হয়নি। এরপর আবার উনারা টেস্ট করানোর জন্য নমুনা দিয়েছেন। এ কয়দিন উনারা কোথাও যেতে পারবেন না, নিজেদের বাড়ির মধ্যে থাকতে হবে।
ক্যান্টারবুরি কেন্দ্র থেকে টিকা নিয়েছেন আশফাক ভাই ও দিশা ভাবি
এভাবে করোনাভাইরাস এক নতুন জীবনবোধের উপায় বাতলে দিচ্ছে। মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে সবাই মুখোশ পরে ঘুরছে। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। আগে যেমন সবাই সবার বিপদে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াতেন এখন সবাই দূরে সরে গিয়ে বরং পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কারণ সংস্পর্শে আসলে এ রোগ আরও বেশি ছড়িয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করবে। বাজার-ঘাটের জন্য আগে যেমন সবাই শপিংমলগুলোতে হামলে পড়তেন এখন সেখানে সবাই অনলাইন শপিংয়ে ঝুঁকে পড়ছেন।
বাড়ি বাড়ি এসে পোশাক থেকে শুরু করে মুদির সদাই পর্যন্ত ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেলুনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তাই অনেকেরই চুল কাটা বন্ধ হয়ে আছে। অবশ্য অনেকে চুল কাটার যন্ত্র কিনে বাসায় নিজে নিজে চুল কেটে নিচ্ছেন। আমাদের বাসায় ছোট রায়ানকে কোনভাবেই চুল কাটানোর জন্য রাজি করানো যাচ্ছে না। তাই তার চুলের নিচে ঢাকা পরে যাচ্ছে কানের লতি।
মানচিত্রে সিডনির লকডাউনের রেড জোন
আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম মানুষ সামাজিক জীব, তাই সমাজে সবাই একত্রে মিলেমিশে বসবাস করেন। একে অপরের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। গত প্রায় দেড় বছরে ভাইরাস প্রকোপে এক ধরণের নতুন সমাজব্যবস্থা ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। আমরা একে অপরের সংস্পর্শে না এসেও অন্যের পাশে আছি। বিপদগ্রস্ত মানুষকে যতটুকু পারা যায় আর্থিক এবং মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে দেখাও হচ্ছে ইথারের ভার্চুয়াল মাধ্যমে, হচ্ছে মিথস্ক্রিয়া।
মহামারীর প্রভাবে এভাবে হয়তোবা একটা নতুন জীবনবোধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম হয়তোবা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মুখোশ পরে চলাকে তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। যে বাতাসে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন আবার সেই একই বাতাসের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছে জীবাণু। কোন একদিন আসবে যখন করোনাভাইরাস জীবাণু পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। মানুষ মুখ থেকে মুখোশ খুলে একে অপরকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। আনন্দে বারবার কোলাকুলি করবে। গুরুজনরা ছুঁয়ে দেখবেন তাদের স্নেহের পরবর্তী প্রজন্মকে আর শোনাবেন মহামারীর গল্প, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের গল্প বা বেঁচে থাকার গল্প।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |