জার্মানির নুরেনবার্গের ফাবের পার্ক পেরিয়ে রাস্তায় উঠলাম। লক্ষ্য আইবাখের নদীর ওপরে কাঠের সেতুটি, যেটি নুরেনবার্গ ও স্টাইন শহরকে পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের যোগাযোগের বন্ধনে বেঁধেছে। রাস্তায় উঠেই দেখি একটা দমকল বাহিনীর গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আসছে। তারপর সেটা সরু রাস্তা ধরে ঢাল দিয়ে নিচের দিকে গেল।
রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা ছিল, সব গাড়ি এ রাস্তায় চলাচল করতে পারে না। তবে সে প্রতিবন্ধকতা সরানোর চাবি দমকল বাহিনীর কর্মীদের কাছেও থাকে। তারা সে তালা খুলে যেকোনও রাস্তায় যেতে পারে।
এর কিছুক্ষণ পর দেখলাম মাথার ওপরে হেলিকপ্টার উড়ছে। তখন মনে হল হয়তো বড় ধরনের কিছু ঘটেছে। ভাবছিলাম- হয়তো আগুন লেগেছে বনে কোথাও, তা না হলে দমকল বাহিনীর গাড়ি এবং একইসাথে হেলিকপ্টার কেন?
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথমদিকে আরেকবার এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। দেখেছিলাম- কয়েকজন সন্দেহজনক যুবক বনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। তাদের কারো কাছে সম্ভবত দাহ্য পদার্থ ছিল। কেউ একজন পুলিশ ও দমকল বাহিনীকে খবর পাঠিয়েছিল- ‘তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক’। তারা বনে আগুন লাগাতে পারে। সেদিনও সেখানে দমকল বাহিনীর কয়েকটা গাড়ি নৌকাসহ উপস্থিত ছিল। পুলিশের গাড়ি এবং মাথার ওপর হেলিকপ্টার চক্কর দিতেও দেখেছিলাম। সেদিন অবশ্য হেলিকপ্টার মাটিতে নামেনি। এটা ছিল নুরেনবার্গের ফাবের পার্কের মধ্যে।
যাই হোক, দমকল বাহিনীর গাড়িটা সেতুটির এক মাথায় গিয়ে থেমে গেল। কারণ সেতু দিয়ে কোন গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। উল্টোদিকে দেখলাম আরেকটি দমকল বাহিনীর গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর একটু সামনে গিয়ে দেখলাম আরও পাঁচটি দমকল বাহিনীর গাড়ি এবং একটি পুলিশের গাড়ি। নদীর পাশে ফাঁকা মাঠ, সেখানে হেলিকপ্টারটিও নেমেছে।
নদীর কাছে গিয়ে আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু কেন এত উদ্ধারকর্মী, কী হয়েছে ইত্যাদি জানার স্বাভাবিক একটা কৌতূহল হল।
একজনকে জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন, কেউ একজন একটা বল নদীতে ছুঁড়ে মেরেছিল এবং সেটা তুলতে একটা কুকুর জলে লাফ দেয়। কিন্তু জলে নামার পর কুকুরটির উঠতে সমস্যা হচ্ছিল। তা দেখে তার মালিকও কুকুর বাঁচাতে দ্রুত জলে লাফ দেয়। কিন্তু তিনিও সমস্যায় পড়েন। এ অবস্থায় আশেপাশের লোকজন তাকে সাহায্য করে এবং দমকল বাহিনীকে টেলিফোন করে ১১২ নম্বরে। আর দ্রুত দমকল বাহিনীর গাড়িগুলো বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে সেখানে এসে হাজির হয় উদ্ধারে। কয়েকজন উদ্ধারকর্মীকে দেখলাম নৌকা নিয়ে প্রস্তুত। সে এক মহা উদ্ধার আয়োজন!
গ্রীষ্মে এ নদীতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ তাদের কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন। বল ছুঁড়ে ফেলেন বা কোন একটা গাছের ডাল ছুঁড়ে ফেলেন এবং কুকুরগুলো সাঁতার কেটে তা তুলে নিয়ে আসে। এসব নিত্যদিনের চিত্র। কিন্তু বর্তমানে বন্যার কারণে নদীতে স্রোত বেড়েছে, যার কারণেই হয়তো সেদিন সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
এলাকার দুই বাড়ির বাসিন্দা আর যাদের কৃষি জমি আছে সেখানে, তারা গাড়ি নিয়ে সে পথে চলাচল করতে পারেন। কিন্তু তাদেরও খুব সাবধানে চলাচল করতে হয়। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়িচালক সবক্ষেত্রে বেশি দায়ী থাকেন।
এ রাস্তায় আরেকবার একটা কুকুর গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সেদিন সকালের দিকে আমি যখন হাঁটছিলাম সেখানে পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসা করলো- আমি কিছু দেখেছি কিনা। কারণ যে গাড়ির সঙ্গে কুকুরটির ধাক্কা লেগেছিল, সে গাড়িটি সেখানে ছিল না। চলে গিয়েছিল। এটাও একটা অপরাধ। পালিয়ে যাওয়া গাড়িটির সন্ধান মিললে বড় ধরনের জরিমানার সম্মুখীন হবে এবং কমপক্ষে তিন মাসের জন্য চলাচলের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
আবার আসি সেদিনের উদ্ধার কাজের কথায়। পরে ফ্রাঙ্ক বলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি আমাকে দুর্ঘটনা সম্বন্ধে বিস্তারিত জানালেন। আমি দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে থেকেই তিনি সেখানে ছিলেন। বললেন,“কিছুক্ষণ আগে খবরের কাগজের লোকজন এসেছিল এবং পুলিশ দুর্ঘটনা-কবলিত মানুষটিকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। কুকুর এবং মালিক জীবিত আছে এবং তাদের অবস্থা গুরুতর নয়। বড় ধরনের কোন সমস্যার শিকার হয়নি।"
জার্মানদের কাছে একটি জীবনের দাম যে কত সেদিন সেটা অনুভব করলাম আরেকবার। কেবল মানুষের জন্যই যে তারা এমন ব্যবস্থা নেয় সেটি নয়, পশুর জন্যও থাকে একই প্রস্তুতি, যত্ন ও সতর্কতা। দুর্ঘটনার দিন এতোগুলা গাড়ি-হেলিকপ্টার উদ্ধারকাজে আসার জন্য সরকারের বাংলাদেশি টাকায় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে।
পরে ফ্রাঙ্কের সাথে কথা বলতে বলতে বাসার দিকে রওনা দিলাম। তিনি জানালেন, আমি যে এলাকায় থাকি তিনিও সে এলাকার বাসিন্দা। তবে তার সাথে সাইকেল থাকায় তিনি আগেই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ কথা হলো দুইজনের,বন্ধুত্বও হয়ে গেল। আমরা একে অপরের সাথে আবার দেখা হওয়ার আশা ব্যক্ত করে বিদায় নিলাম।
আমি সাধারণত সাত কিলোমিটার হাঁটি প্রতিদিন। কিন্তু সেদিন দুর্ঘটনার কারণে কম হাঁটলাম। যখন বাসায় ফিরলাম তখনও দিনের আলো রয়েছে, সাড়ে ৮টা বাজে ঘড়িতে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে লেখা বাদ দিয়ে ছবিগুলো দেখে অলস সময় কাটালাম।
ছবি: মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
লেখক: গবেষক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি
ইমেইল: mfjoarder@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |