স্লোভেনিয়া পাহাড়-লেইক: পার্থিক সৌন্দর্যে অলৌকিক অনুভূতি

পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি? যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ? আইসল্যান্ড? নিউ জিল্যান্ড কিংবা সুইজারল্যান্ড? কাশ্মীর?  অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ শহরের উপকণ্ঠের হালস্টাট?

রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2021, 03:11 AM
Updated : 17 July 2021, 03:15 AM

এ প্রশ্নের উত্তর একেকজনের কাছে একেকটা। তবে তালিকা করলে নিশ্চয়ই অনেকগুলোই ‘কমন’ পড়বে। সে তালিকায় হয়তো ‘ক্রাইনস্কা গোরা’ নামটি উপেক্ষিত রয়ে যায়। 

প্রায় আট হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশ স্লোভেনিয়া। মধ্য ইউরোপের এদেশটি এখনও পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে ততোটা পরিচিত নয়। অনেকে আবার ‘স্লোভেনিয়া’ এবং ‘স্লোভাকিয়া’র  মধ্যে গুলিয়ে ফেলে একই দেশ হিসেবে ভাবেন।

স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে পেচ পর্বত। অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া এবং ইতালির সীমানা এখানে এসে মিশেছে।

তবে স্লোভেনিয়ায় বেড়াতে এসে একে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর একটি বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন পর্যটকরা। যার সৌন্দর্যের মূল রহস্য আল্পস ও ডিনারাইডস পর্বতমালা, বিভিন্ন ধরনের লেইক এবং স্কি রিসোর্ট। বিশেষ করে স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ‘ক্রাইনস্কা গোরা’-কে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি বলে মনে হয় আমার কাছে।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ‘ক্রাইনস্কা গোরা’র দূরত্ব ৫৩ মাইলের কাছাকাছি। লুবলিয়ানার সেন্ট্রাল বাস স্টেশন থেকে সরাসরি বাসে ক্রাইনস্কা গোরাতে যাতায়াত করা যায়। শীতকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্কি-প্রেমীরা ক্রাইনস্কা গোরাতে জড়ো হন।

ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্ৰিয় স্কি রিসোর্টগুলোর মধ্যে ক্রাইনস্কা গোরা একটি। শীতে ক্রাইনস্কা গোরাসহ উত্তর স্লোভেনিয়ার বেশিরভাগই তুষারে ঢেকে যায়। আবার গ্রীষ্মে স্লোভেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে যেখানে তীব্র দাবদাহে হাসফাস, ক্রাইনস্কা গোরার বাতাসে তখন কোমলতার ভাটা নেই। বসন্তকাল আসতে না আসতেই, ক্রাইনস্কা গোরাসহ পুরো স্লোভেনিয়া সবুজ পাতায় ছেয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়।

গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যায় অনেকে ক্রাইনস্কা গোরায় জড়ো হন সেখানকার শীতল প্রশান্তিময় বাতাসের লোভে।

প্রায় দুই বছর স্লোভেনিয়াতে থাকার পরও ক্রাইনস্কা গোরাতে ঘোরার সুযোগ ও সৌভাগ্য হচ্ছিল না। স্লোভেনিয়ায় আসা বিদেশি পর্যটকদের প্রায় সবারই প্রধান গন্তব্য হয় লেইক ব্লেড কিংবা পোস্তোয়ানা কেইভ।

স্লোভেনিয়া তথা মধ্য ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কি রিসোর্টগুলোর মধ্যে প্লানিসা অন্যতম।

অথচ স্লোভেনিয়ানদের জিজ্ঞাসা করলে বেশির ভাগ মানুষ একবাক্যে ক্রাইনস্কা গোরার নাম উচ্চারণ করবেন। স্লোভেনিয়ার স্থানীয় ভাষা ‘গোরা’ শব্দের অর্থ পর্বত, আর ক্রাইনস্কা হচ্ছে ‘কারাভাঙ্ক’ শব্দটির অপভ্ৰংশীয় রূপ। ‘কারাভাঙ্ক’ পর্বতমালার কোলঘেঁষে ক্রাইনস্কা গোরার অবস্থান। প্রকৃতপক্ষে লাইমস্টোন আল্পস পর্বতমালার অংশবিশেষ হচ্ছে এ কারাভাঙ্ক পর্বতমালা।

স্লোভেনিয়ার উত্তরাংশের সাথে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত রয়েছে। সে কারণেই এ অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে অস্ট্রিয়ান ও জার্মানদের প্রভাব রয়েছে। প্রাণিজ আমিষ সসেজ পর্বতে ঘেরা এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাবার।

ইতালির রোমে জমির হোসেন ভাই থাকেন। আমার জীবনে এ মানুষটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার হাত ধরে লেখালেখি শুরু। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, অনুপ্রেরণা দেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি স্লোভেনিয়া এসেছিলেন। তার সম্মানে এ ট্যুরের আয়োজন।

জেলেনচি ন্যাশনাল রিজার্ভ।

স্লোভেনিয়াতে গণপরিবহণের ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। তাই আমরা যখন ক্রাইনস্কা গোরা যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হয়েছিল। গাড়ির মালিকই ড্রাইভার, আবার একইসঙ্গে আমাদের ট্যুর গাইড। শীতকালে তিনি স্কি প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। তার নাম রোমান ব্রান্টজ। রোমান ক্রাইনস্কা গোরার স্থানীয় বাসিন্দা। পুরো অঞ্চল তার নখদর্পণে। তার সাথে এক ধরনের অলিখিত চুক্তি হলো- ১৩০ ইউরোর বিনিময়ে তিনি আমাদের ক্রাইনস্কা গোরাসহ লেইক ব্লেড এবং ভিনটেগার জর্জ ঘুরিয়ে দেখাবেন। ।

ক্রাইনস্কা গোরার ট্যুরটিকে সাত রঙে রাঙাতে পেরেছি অত্যন্ত অমায়িক রোমানের কারণে। পুরো যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গা ও দর্শনীয় স্থান নিয়ে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। রোমানের সঙ্গে ফেইসবুকে যোগাযোগটা রয়ে গেছে।   

পেচ পর্বত ছিল আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল । প্রায় এক হাজার ৫০৯ মিটার উঁচু এ পর্বতটি লাইমস্টোন আল্পস পর্বতমালার অংশবিশেষ। চারদিক নানা আকৃতির পাহাড়বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অবারিত ভাণ্ডার পেচ। অস্ট্রিয়া, ইতালি ও স্লোভেনিয়া—তিনটি দেশের সীমানা একীভূত হয়েছে এ স্থানে এসে। তাই এ তিন দেশের মানুষের কাছে এ স্থানটি ঐতিহাসিকভাবেই ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের প্রতীক।

লেইক ইয়াসনা।

ক্রাইনস্কা গোরা থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ট্রমেয়া নামক স্থানে কারাভান পর্বতমালার ভেতরে পেচ পর্বতের অবস্থান। তবে অস্ট্রিয়ান ও জার্মানদের কাছে এ স্থানটি ‘ড্রেইল্যানড্রেক’ এবং ইতালিয়ানদের কাছে এ স্থানটি ‘মন্তে ফোরনো’ নামে পরিচিত। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রোববার অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া ও ইতালির মানুষ এখানে মিলিত হন। তিনটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মানুষ মাতে বর্ণিল উৎসবে।

পেচ পর্বত থেকে আমাদের পরের গন্তব্য হয় প্লানিসা। প্লানিসাও স্লোভেনিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ আলপাইন রিসোর্ট। ক্রিকেটারদের কাছে যেভাবে লর্ডসের ক্রিকেট গ্রাউন্ড কিংবা মেলবোর্নের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গুরুত্ব যেরকম, স্লোভেনিয়াসহ আশেপাশের দেশগুলোর স্কি জাম্পারদের কাছেও প্লানিসার গুরুত্ব অনেকটা সে রকম। প্রত্যেক বছরের শীতকালে তাই প্লানিসাতে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক স্কি টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়।

রোমান জানালেন, শীতকালে এখানে মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা থাকেনা। পাশাপাশি জিপ লাইনের অভিজ্ঞতা নিতেও অনেকে এ স্থানে একত্রিত হন। শীতকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে প্রাকৃতিকভাবে স্কি  প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে না, এজন্য তাই এখানে কৃত্রিমভাবে স্কি প্রশিক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে। স্কি এর পাশাপাশি কেউ চাইলে এখানে গরমের দিনেও আইস হকি কিংবা অন্যান্য উইন্টার স্পোর্টসে অংশ নিতে পারেন। অসলোর হলমেনকোলেন স্কি মিউজিয়ামের মতো প্লানিসার স্কি মিউজিয়ামটিও বেশ প্রসিদ্ধ। মিউজিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে ছয় ইউরো গুনতে হয়। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আমাদের ভ্রমণের সময় মিউজিয়ামটি বন্ধ রাখা হয়েছিল।

গোল্ড হর্ন চ্যামোয়া স্ট্যাচুর সামনে লেখক

যারা ডানা মেলে ওড়ার অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্য প্লানিসাতে রয়েছে উইন্ড টানেল। আপনি চাইলে এ উইন্ড টানেলের ভেতরে কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলে থাকার স্বাদ নিতে পারেন।

প্লানিসা দেখার পর আমরা গেলাম জেলেনচি ন্যাশনাল রিজার্ভে। স্লোভেনিয়ান ভাষায় জেলেনচি শব্দের অর্থ সবুজ। জেলেনচি ন্যাশনাল পার্ক হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জলজ এবং বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে ‘জেলেনচি’ জলাশয়। ভূ-গর্ভের থেকে উৎপত্তি হওয়া এ জলাশয়ে পানির তাপমাত্রা শীতকালেও পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। তাই অনেকে একে থার্মাল স্প্রিং-ও বলেন। স্লোভেনিয়ার বিখ্যাত নদী ‘সাভা ডোলিনকা’র উৎপত্তি ঘটেছে এই থার্মাল স্প্রিং থেকে। ‘সাভা ডোলিনকা’র মাধ্যমে ইউরোপের অন্যতম প্রধান নদী সাভার উৎপত্তি। রোমানের বর্ণনা থেকে জানতে পারি জেলেনচির তলদেশে পান্নার মতো নীলাভ সবুজ বর্ণের এক ধরনের পাথরের প্রাচুর্য রয়েছে, যার কারণে এ জলাশয়ের পানি ওই একই রংয়ের।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হলো লেইক ইয়াসনা। লেইক ব্লেইড কিংবা লেইক বোহিনির মতোই এটি পরিচিত। কৃত্রিম উপায়ে নির্মিত দুইটি লেইকের আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে লেইক ইয়াসনার সৃষ্টি। শীতকালে এ লেইকের পানির পুরোটা বরফে জমে যায়, গ্রীষ্মকালে অনেকে রৌদ্রস্নান করতে এখানে জড়ো হন। মহামারীর মাঝেও এ স্থানে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। লেইকের নীল জলরাশির সাথে চারদিকের জুলিয়ান আল্পস পর্বতমালা একাকার হয়ে সমগ্র পরিবেশকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। যারা ছবি তুলতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এখানে রয়েছে ‘গোল্ড হর্ন চ্যামোয়া স্ট্যাচু’।

কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের স্থানগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা

স্লোভেনিয়াতে ‘গোল্ড হর্ন চামোয়া’ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উপকথা রয়েছে। ‘চ্যামোয়া’ হচ্ছে এক বিশেষ প্রজাতির পাহাড়ি ছাগল যা এ অঞ্চলের প্রধানতম প্রাণী। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে চ্যামোয়ার সংখ্যা অনেক কমে এসেছে।

ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের স্থানগুলোতে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এসব ঘরবাড়িও যেন প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে পুরো এলাকার সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

লেইক ইয়াসনা থেকে আমাদের পরের গন্তব্য ছিল রুস্কি চ্যাপেল। স্লোভেনিয়ান ভাষায় রাশিয়াকে ‘রুশিয়া’ বলা হয়। ‘রুস্কি’ চ্যাপেল হচ্ছে রাশিয়ানদের তৈরি অর্থোডক্স গির্জা। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত স্লোভেনিয়া অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। 

অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের কথা আমরা অনেকে শুনেছি। ১৯১৪ সালের ১৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে বিদ্রোহী সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর এক সদস্যের গুলিতে তিনি নিহত হন। অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং একই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যার প্রেক্ষিতে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া এ সময় সার্বিয়ার পক্ষ নেয় এবং সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরিকে হুঁশিয়ারি দেয়। এর তিন দিন পর অর্থাৎ ৩১ জুলাই জার্মানিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের সেনাদের হাতে বন্দি রাশিয়ানদের এ গির্জা বা চ্যাপেলটির নির্মাণ কাজে লাগানো হয়েছিল।

ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষের অন্যতম প্রধান খাবার ঘরোয়াভাবে তৈরি এ সসেজ। ছবি: রোমান ব্রান্টেজ

স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে বড় গিরিপথের নাম ভ্রিশিচ পাস, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ২৮৫ ফুট উচ্চতায় এ গিরিপথটি আপার ক্র্যানিওলার সাথে ট্রেন্টা ভ্যালিকে সংযুক্ত করেছে। ভ্রিশিচ পাসেরও এক বিস্তীর্ণ অংশের নাম রাখা হয়েছে ‘রুশকা চেষ্টা’। স্লোভেনিয়ান ভাষায় ‘চেষ্টা’ শব্দের অর্থ সড়ক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দি রাশিয়ানদের এ সড়কের নির্মাণকাজে লাগানো হয়েছিল। আর এটি নির্মাণ করতে গিয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এদেরকে রুস্কি চ্যাপেলের আশেপাশে সমাহিত করা হয়। সপ্তাহের প্রতি রোববার এ গির্জাটি প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। শেষবার ২০১৬ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন স্লোভেনিয়া সফরে আসেন, তখন তিনি রুস্কি চ্যাপেল পরিদর্শনে এসেছিলেন।

রুস্কি চ্যাপেল দেখা শেষে আমরা ছুটে গেলাম ভিনটেগার জর্জের দিকে। পথিমধ্যে রোমান স্পিট নামক এক পর্বতের সামনে গাড়ি থামালেন। শীতকালে এ পর্বতের পুরো অংশে ঘন তুষারে আচ্ছাদিত হয়। স্পিট তার চূড়ার দিকে অনেকটা পিরামিডের আকৃতি ধারণ করেছে যা জুলিয়ান আল্পসের অন্যান্য পর্বতের তুলনায় একেবারে আলাদা। আর এ কারণে এ পর্বতটি স্লোভেনিয়ানদের কাছে আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। ছবি তোলার জন্য তাই অনেক দর্শনার্থীদের কাছেই স্পিট পর্বতটি বেশ জনপ্রিয়। স্লোভেনিয়ার বিখ্যাত গিরিখাত বা ক্যানিয়নগুলোর মধ্যে ভিনটেগার জর্জের অবস্থান সবার ওপরে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত ভিনটেগার জর্জ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

রুস্কি চ্যাপেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দি রাশিয়ানদের দিয়ে নির্মাণ করা হয় এ অর্থোডক্স চার্চ।

‘ভিনটেগার’ শব্দটি ওয়াইন উৎপাদনের সাথে জড়িত। রোমানকে তাই জিজ্ঞেস করলাম এ স্থানটিকে ভিনটেগার জর্জ নামে ডাকা হয় কেন। রোমানের বক্তব্য অনুযায়ী, ভিনটেগার জর্জকে ঘিরে এক সময় নাকি ওয়াইন শিল্প গড়ে উঠেছিল, এখন অবশ্য তা ইতিহাস।

এ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা শাম জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এ জলপ্রপাত থেকে বিখ্যাত রাডোভনা নদীর উৎপত্তি। স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম পাথরের তৈরি আর্ক-শেইপের রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ হয়েছে রাডোভনা নদীর ওপর। ভিনটেগার জর্জের  জলধারা অত্যন্ত খরস্রোতা, তবে এ খরস্রোতা জলধারার মাঝেও ট্রটসহ বিভিন্ন মাছ চলাচল করতে দেখে আমার আশ্চর্য লাগলো। এতো খরস্রোতা জলধারার মাঝেও কীভাবে জলজ প্রাণীগুলো বেঁচে থাকে সে প্রশ্ন বারবার উঁকি উঁকি দিচ্ছিল।

লেইক ইয়াসনার মতো এখানকার জলধারাও নীল। মনে হয় তলদেশ থেকে পান্না কিংবা নীলার বিচ্ছুরণ ঘটছে। পানির স্রোতের গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভিনটেগার জর্জের নিম্নাংশে স্লোভেনিয়ার সরকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে।

মাউন্টেন স্পিট। পিরামিড আকৃতির চূড়ার জন্য এ পর্বতটি স্লোভেনিয়ানদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত।

আগেই বলেছি বাইরের দেশ থেকে স্লোভেনিয়াতে যেসব বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন তাদের সবার গন্তব্য হয় লেক ব্লেইড। জমির ভাইও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। লেইক ব্লেড এবং  ভিনটেগার জর্জ অবশ্য ক্রাইনস্কা গোরার অংশ নয়। 

জমির ভাইকে চমকে দিতে সেদিনের শেষ অভিযাত্রা ছিল লেইক ব্লেডের দিকে। স্লোভেনিয়ায় ধর্মের প্রভাব খুব কম। তবে লেইক ব্লেড স্লোভেনিয়ানদের ক্রিশ্চিয়ানিটির ঐতিহ্য ধারণ করছে। প্রচলিত রয়েছে যে, স্লোভেনিয়ার মানুষের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজ শুরু হয়েছিল লেইক ব্লেডকে ঘিরেই।

লেইক ব্লেডের ঠিক মাঝখানে ছোট এক দ্বীপ- ব্লেড আইল্যান্ড। ওই দ্বীপের আকর্ষণ হচ্ছে ‘প্রিমিলেজ চার্চ অব দ্য অ্যাজামশন অব মারিয়া’। অনেকে আবার এ গির্জাটিকে ‘চার্চ অব দ্য মাদার অব গড’ নামেও ডাকেন। এটি মূলত একটি ক্যাথলিক গির্জা, তবে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের আগে  এখানে প্যাগানদের তৈরি একটি মন্দির ছিল। গির্জার ভেতরে ‘উইশিং বেল’  ঘণ্টা রয়েছে। একটি মোটা দড়ি ধরে টান দিলে ঘণ্টাটি বেজে উঠে। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস কেউ যদি এ ঘণ্টাটি বাজানোর পর তার মনের কোনও ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, তাহলে সেটি পূরণ হয়।

স্লোভেনিয়ানদের চোখে লেইক ব্লেড হচ্ছে এ পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা। মূলত প্রেমিক-প্রেমিকারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে লেইকে আসেন। স্বর্গসম পরিবেশে বিয়ের স্মৃতিকে চিরমধুর করে রাখতে চান যুগলরা।

স্লোভেনিয়ার অন্যতম বিখ্যাত জলপ্রপাত শামের সামনে লেখক।

প্লেটনা নামের কাঠের তৈরি এক বিশেষ নৌকার সাহায্যে ব্লেড আইল্যান্ডে পৌঁছানো যায়। চার্চের পাশাপাশি ব্লেড আইল্যান্ডের ভেতরে ৫২ মিটার দীর্ঘ এক দুর্গ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সৌখিন কিছু মানুষের জনবসতি। লেইক ব্লেডের উত্তর-পূর্ব বরাবর রয়েছে ব্লেড ক্যাসেল। আনুমানিক ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রাজা দ্বিতীয় হেনরির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিক্সেনের বিশপ আলবুইনের নেতৃত্বে প্রথম এ দুর্গটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আলবুইনের হাত ধরে আধুনিক কালের ব্লেড কমিউনিটির গোড়াপত্তন ঘটে। এক সময় পুরো ব্লেড কমিউনিটির শাসনভার বিশপদের হাতে ছিল। তারা জনসাধারণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতেন। মধ্যযুগে এ প্রাসাদকে সংস্কার করা হয় এবং এর ভেতরে অতিরিক্ত কয়েকটি টাওয়ার যোগ করা হয়। একসময় প্রাসাদের ভেতরেও জনবসতি গড়ে উঠেছিল।

আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে ক্রাইনস্কা গোরা অন্যতম। পুরো যাত্রাপথের সৌন্দর্য আমার হৃদয়ে এতোটা গভীর ছাপ ফেলেছে যে, ঘুরেফিরে বারবার সেদিনটিতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। যাত্রাপথের পুরো সৌন্দর্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে না পারার একটা আফসোস রয়েই গেছে।

পার্থিব ক্রাইনস্কা গোরার প্রত্যেক পরতে অলৌকিক, অপার্থিবের হাতছানি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

লেখক: স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগে স্নাতক করছেন।

ইমেইল: rakib.rafi786@gmail.com

লেখকের অন্যান্য লেখা:

উপেক্ষিত এক বলকান স্বর্গ শহরে 

আমার বন্ধু লেইরা

বাইক রেসার ক্রিস্টিনা ও আমার অসমবয়সী প্রেম!

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!