ভ্রমণ কাহিনি: আইল অব ওয়াইট

মহামারীতে প্রায় দেড় বছর ঘরবন্দি জীবনযাপন করছি। প্রিয় মাতৃভূমি, নিকটাত্মীয় থেকে বহু দূরে পরবাস নামক কারাগারে। এর মাঝেই ঘুরে এলাম ‘আইল অব ওয়াইট’, যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় জনবহুল দ্বীপ।

ওয়াহিদুজ্জামান মৃধা, যুক্তরাজ্য থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2021, 07:26 AM
Updated : 9 July 2021, 07:26 AM

এ যেন হাজারও দুঃখ ও ব্যস্ততা ভুলে ক্ষণিকের আনন্দ খোঁজা, তবে সেটা প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির দেওয়া নির্মল সে আনন্দ ক্ষণকালের জন্য সব অপ্রাপ্তি যেন মিটিয়ে দিয়েছে। চমৎকার, নৈসর্গিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য যা কল্পনাকেও হার মানায়। এর মাঝে অনুকূল আবহাওয়া সহায় হওয়ায় আনন্দের কোন ঘাটতি হয়নি।

দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ ও বিশাল স্বচ্ছ নীল জলরাশি যেন সৌন্দর্য সৃষ্টিতে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। সত্যি দেখার মতো ‘আইল অব ওয়াইট’। এটি ইংলিশ চ্যানেল ও হ্যাম্পশায়ারের উপকূলে দুই থেকে পাঁচ মাইলের মধ্যে, সেখান থেকে এটি সোলেন্ট দিয়ে আলাদা করা হয়েছে।

এ দ্বীপে এমন রিসোর্ট রয়েছে যা রানী ভিক্টোরিয়ার সময় থেকেই ছুটি কাটানোর গন্তব্য ছিল। এটি হালকা আবহাওয়া, উপকূলীয় দৃশ্য, মাঠ, নিম্নভূমি এবং চেইনগুলোর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য পরিচিত। দ্বীপটি হ্যাম্পশায়ারের ঐতিহাসিক কাউন্টির অংশ। এটি ইউনেস্কোর বায়োস্পিয়ার রিজার্ভ হিসেবে মনোনীত।

‘আইল অব ওয়াইট’ মূলত একটি লেগুন, যা মূল ভূখণ্ডের অংশকে পৃথক করে ওয়ার্সেস্টার কাউন্টি, মেরিল্যান্ডের মিডটাউন অংশ থেকে ওশান সিটি, ওয়ার্সেস্টার কাউন্টিতে সংযুক্ত করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শ্যাঙ্কলিন চেইন, ক্লিফ লিফট, ব্রেডিং ডাউন লোকাল নেচার রিজার্ভ, ব্ল্যাকগ্যান চাইন, স্যান্ডাউন সমুদ্র সৈকতসহ নানা দর্শনীয় স্থান। আছে স্বচ্ছ নীল পানির ঢেউ, সমুদ্রের বালুকনার মাঝে সূর্যের উত্তাপ। সাজানো-গোছানো পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, ঘরবাড়ি, ফোয়ারা, নদী, গাছপালা ও প্রকৃতির অপরূপ সাজ।

এমনকি সমুদ্রপাড়ে রয়েছে ছোট বাচ্চাদের জন্য বিনোদনের নানা উপকরণ। কচিকাঁচাদের আনন্দের লাফালাফিতেই চোখ আটকে যায়। পাশেই স্বচ্ছ নীল জলরাশির বিশাল সমুদ্র। অথচ স্বাভাবিক প্রকৃতির কোন রকম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সবকিছুই যেন নিজের মতো করে প্রযুক্তি দিয়ে প্রাকৃতিক করে সাজিয়ে নিয়েছে। অবশ্য ইউরোপের যেখানে গিয়েছি এ রূপই দেখেছি। পাহাড়, পর্বত, প্রকৃতি যেখানে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থানে রেখে বসবাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।

লন্ডন থেকে ‘আইল অব ওয়াইট’ মিনিবাস যোগে প্রায় ৮০ মাইলের পথ। শহর বন্দর পেরিয়ে কখনও পাহাড়, কখনো পর্বত, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বিশাল বিশাল রাস্তা, অরণ্য, সমতল ও সাউথাম্পটনের ‘রেড ফানেল’ দীর্ঘ ফেরি পার হয়ে সেখানে যাওয়া। আগেও অন্যান্য দুর্গম এলাকায় গিয়ে খেয়াল করেছি, এখানে এসেও দেখলাম; যুক্তরাজ্যের সীমানায় যে কোন জায়গায় থাকেন না কেন সেখানকার এবং রাজধানী শহরের নাগরিক সুবিধা একই রকম। যাবতীয় উপাদান, সুযোগ-সুবিধা একই।

অবশ্য এখানে নির্মল প্রকৃতির বাড়তি সুবিধা। এসব দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কীভাবে তারা এমনটি করতে পেরেছে! ইউরোপে যা দেখি তাতেই অবাক হই। আসলে দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা-আন্তরিকতা আর পরিকল্পিত  পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই ।

‘ইউনিভার্সেল ভয়েস ফর হিউম্যান রাইটস’ (ইউভিএইচআর) ইউকে  গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ ও বনভোজনের জন্য এ জায়গা নির্ধারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতায় ভরপুর ছিল এ আয়োজন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন কেটেছে পারস্পরিক সম্পর্কের নির্মলতায়। এতে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ‘ইউভিএইচআর ইউকে’ এর সভাপতি জাকের আহমদ চৌধুরী। তাকে সহযোগিতা করেছেন আবু বকর, মাহিদুর রহমান, শাহান বিন নিজাম, মুসলিম খান, জয়নাল আবেদীন, দেলোয়ার হোসাইন, এমদাদুল হক, লায়েক আহমেদ,  ইশতিয়াক হোসেন, রায়হান চৌধুরী, বেলাল আহমদ, হোসেন আলী, মাসুদ আহমদ, মারুফ আহমদ, তাহমিদ আহমদ, আবুল কালাম, জসিম উদ্দিন, সাইফুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম, হেলাল আহমদ, শামীম আহমদ, নজরুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আরিফুর রহমান, খায়রুল আমিন, তাহমিদ খান ও রুহুল আমিন।
ভোর সাড়ে সাতটায় পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্ক থেকে দুটি মাইক্রোবাস যোগে যাত্রা শুরু হয় ‘আইল অব উইট’ এর উদ্দেশ্যে। দিনব্যাপী এ ভ্রমণে যাওয়া-আসা এবং সমুদ্রপাড়ের সময়টুকু এমনই সৃজনশীল ছিল যে, যেসব লোক কখনো মাইক্রোফোনের কাছেও ভিড়েনি সেও তার মধ্যে থাকা নানা ভাব-কথন উজাড় করে দিয়েছেন।

সবার পরিচিতি পর্ব শেষে গান, গল্প, কৌতুক, কবিতা, চুটকি, আঞ্চলিক গান, কৃষ্টি-কালচার উপস্থাপনে মাতিয়ে রাখা হয়। তাদের সেসব পরিবেশনায় প্রতীয়মান হয়েছে – সবার মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা কিছু প্রতিভা দিয়েছেন। আর যারা মাইক্রোফোন ধরেননি; তারা সঙ্গ দিয়ে পুরো ভ্রমণকে প্রাণবন্ত রেখেছেন।

সমুদ্রের নীল জলরাশির উদাত্ত হাতছানি কার সাধ্য এড়িয়ে যাওয়া! তীরে এসে বাস থামতেই সবাই নেমে পড়ে। লাফালাফি, সাঁতার কাটা, ফুটবল নিয়ে মাতামাতি, সেলফি, ফটোশেসন আর চলে লম্ফঝম্ফ। এর মাঝে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সমুদ্রের জোয়ারভাটা। ফলে আমরা যেখানে লাফালাফি, দাপাদাপি করেছি কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বিশাল মরুভূমি! ধূ ধূ বালুচর! প্রকৃতির মাধ্যমে স্রষ্টার লীলাখেলা সত্যি অবাক করে।

এ আকর্ষণ রেখে কি ফিরতে ইচ্ছে করে! মন চায় জোয়ারভাটার এ খেলা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামুক। জোনাকি জ্বলুক। চাঁদের আলো পড়ুক নীল জলরাশির ঢেউয়ে। সব কোলাহলে তৃপ্তির প্রশান্তি ঘিরে কেটে যাক না সময়, কিন্তু যান্ত্রিক এ জীবনে তা কি সম্ভব! এবার যে ফেরার পালা। ফিরতে মন নাহি চায়। তবুও ফিরতে হয়। তবে আবার আসবো এ আশায়।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!