ইউরোপে একটি মেয়েশিশু যেভাবে বড় হয়ে ওঠে

২০০৩ সাল, অক্টোবর মাস। ঢাকার বেইলি রোডের মনোয়ারা হাসপাতাল। পৃথিবীতে এলো সে। আমি মা হলাম। আমাদের মেয়ের নাম দিলাম, অনন্যা।

রাবেয়া মীর, সুইডেন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2021, 09:28 AM
Updated : 6 July 2021, 09:28 AM

অনন্যা আড়াই বছর বয়সে আমাদের সঙ্গে সুইডেনে আসে। আসার পর প্রি-স্কুল শুরু করে। বাচ্চারা এখানে প্রি-স্কুলে যায় পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত। ওদের বয়স যখন চার-পাঁচ বছর, তখন ওদেরকে অন্য সবকিছুর সঙ্গে একটি বাক্য গুরুত্ব সহকারে শেখানো হয়। তা হলো, ‘আমার শরীর আমার। আমার শরীর স্পর্শ করার অনুমতি অন্য কারও নেই’। এ কথাটি মেয়ে-ছেলে সবার জন্য।

একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ। ওকে গোসল করাতে নিয়ে গেলে আমাকে বলছে, ‘আমার শরীর স্পর্শ করো না, এটা আমার শরীর’। আমি প্রথমে ধাক্কা খেলাম, সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম, স্কুলে শেখানো হচ্ছে। আমি ওকে বললাম, ‘তুমি ঠিক বলেছো। মা, তোমার অনুমতি নিয়ে তোমার শরীর ধরতে পারি?’।

অনন্যার ছোটবেলায় আমরা মা ও বাবা ওকে স্কুলে আনা নেওয়া করতাম। ও যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, বয়স প্রায় দশ, প্রথম দু’একদিন যেতেই স্কুলে পৌঁছানোর কিছুদূর আগে থেকেই ও আমাদের চলে যেতে বলে। জিজ্ঞেস করলে বলে ওঠে, ওর বন্ধুরা স্কুলে একা যাওয়া আসা করে। বুঝলাম, ও নিজের স্বাধীনতাটা পেতে চায় এবং বন্ধুদের কাছেও প্রশ্নের মুখে পড়তে চায় না।

আমরা তড়িঘড়ি করে দু’একজন বাবা-মায়ের কাছ থেকে জানতে চাইলাম, বাচ্চারা কোন বয়স থেকে স্কুলে একা যায়। জানতে পারলাম, ঠিক এই বয়স থেকেই ওরা স্কুলে একা একা যাওয়া আসা করে। বাচ্চাদের সঙ্গে শুধু একটা মোবাইল ফোন থাকে। পরদিন থেকে ওকে একা ছেড়েছি স্কুলে। ও প্রথমে বাস ধরতো, কয়েকটা স্টেশন পর বাস থেকে নেমে পাতাল ট্রেন ধরতো। মোট ২৫ মিনিটের মতো লাগতো স্কুলে পৌঁছাতে। ভাবনায় আসেনি, ও আমার ছেলে বাচ্চা না, মেয়ে বাচ্চা। সামাজিক নিরাপত্তা আর নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থার কারণে অনেক সহজে এমনটা সম্ভব হয়েছে।

অনন্যা তার বন্ধুদের সঙ্গে, প্রি-স্কুলে

কিশোর বয়সের শুরুতে শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে কিছুটা অন্যরকম আচরণ করতে থাকে মেয়েটা। চুপচাপ থাকে। ওর সঙ্গে খুব একটা বেশি কথা বলা যেত না, চট করে রেগে যেত। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ছুটির দিনে একটু রাত করে বাসায় ফেরে। আমাদের মেয়েটি যদি রাত করে ফিরত, আমি চিন্তিত হতাম। ওর সঙ্গে আলোচনায় এবং আশপাশটা দেখে বুঝেছি, এখানে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার বিষয়ে আমার মেয়েটি সচেতন। মেয়ে বলে নিরাপত্তা কম তা নয়। বরং বাসে ট্রেনে মেয়েদের কখনো কখনো বেশি উচ্ছ্বাস নিয়ে চলতে দেখা যায়।

একটা ব্যাপারে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে, যখন দেখি,  হরমোন পরিবর্তনজনিত মেয়েদের ঋতুপরিক্রমার মতো বিষয়টি পরিবারে ও সমাজে অন্য সব ইতিবাচক ঘটনার মতোই দেখা হয়। আমার মেয়েটির এরকম ঋতুচক্রে  পৌঁছানোর আগেই জানতে পারলাম, এখানে যেদিন মেয়েরা প্রথমবারের মতো হরমোন পরিবর্তনজনিত এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, সেদিন পরিবারের সবাই মিলে দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখে। আমরাও করেছি, অনন্যার হরমোন পরিবর্তনজনিত ঋতুচক্র শুরুর প্রথম দিনে।

ভালো লাগে, ও যখন তার বাবাকে বলে, ‘বাবা, ফেরার পথে আমার জন্য স্যানেটারি ন্যাপকিন নিয়ে এসো’। এখানে বলে নেওয়া দরকার, ওর বাবা পেশায় একজন চিকিৎসক। তাই কখনো কখনো বলতে শুনি, ও তার বাবাকে বলছে, ‘বাবা, একটা ব্যথার ওষুধ দাও, ঋতুচক্রের কারণে ব্যথা হচ্ছে আমার’। এই কথায় আমি ফিরে যাই আমার কিশোরবেলায়। বাংলাদেশে গ্রামে বেড়ে ওঠা সেই আমি ও আমার সমবয়সীদের কথা মনে পড়ে যায়। একটা ছোট বাচ্চা হিসেবে শারীরিক এ পরিবর্তনটি পরিবারে ও সমাজে ঠিকমত মোকাবিলা করা কতই না জটিল ছিল। আমার বা আমাদের ঋতুচক্র চলাকালীন সেকি লুকোচুরি! কিছুটা ভয়, ভীষণ লজ্জা – পাছে কেউ দেখে বা জেনে ফেলে। এ যেন এক গর্হিত সময়!

কৈশোরের শেষপ্রান্তে আমাদের ছোট সেই অনন্যা এখন অষ্টাদশে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ে। গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই তিন বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করেছে, ছুটির সময় সাতদিনের জন্য স্পেনে যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। আজ সেই ছোট অনন্যা প্রথম বাবা-মাকে ছেড়ে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছে। ভালো লাগছে, কিন্তু কেন জানি ওর যাওয়ার আগের দিন থেকেই বুকের ভেতরটায় ফাঁকা অনুভব করছি।

ওরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। কোথায় কখন প্রতিবাদ করতে হবে, তা জানে। এখানকার বাচ্চারা পরিবার, স্কুল-কলেজ, সমাজ থেকে বিশেষ করে নারী অধিকার সম্পর্কে শিখে ওঠে ছোটবেলা থেকেই। অনন্যাকে বললাম, মা, এখন থেকেই আমার ভেতরটা খা খা করছে। ও বলে, ‘মা...চিন্তা করো না, তুমিই তো বলে থাকো, পৃথিবীটা একা ঘুরতে শেখো, জীবনের মুহূর্তগুলো উদযাপন কর’। জড়িয়ে ধরলাম ওকে আর মনে মনে বলতে লাগলাম, সেই ছোট শিশুটি আমার।

অনন্যা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে, ল্যাবরেটরিতে

শুরু হলো স্পেনযাত্রার প্রস্তুতি। ওর বাবা আর আমি ব্যাগ বের করে দিয়ে বললাম, ব্যাগ গুছিয়ে নাও। যদি কোনকিছু কিনতে হয়, বলো আমাদের। কিছু টাকা পয়সা দিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কিছু জিনিস কিনে নিয়ে এসে ব্যাগ গুছালো। ওর বাবা পাসপোর্ট এগিয়ে দিলো, টিকিট প্রিন্ট করে দিলো, যদিও ই-মেইলে সব আছে।

আমি আমার এক স্প্যানিশ বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিলাম, যে আমার মেয়েটি ঘুরতে যাচ্ছে। ওর ফোন নাম্বারটা অনন্যাকে নিরাপত্তা বাবদ দিয়ে দিতে চাই। আমার স্প্যানিশ বন্ধু খুব আগ্রহ নিয়ে উত্তর লিখলো, অবশ্যই দেবে। ওর বাবা একটা ভালো পরিমাণের টাকা ইউরো করে দিলো, যাতে আর্থিক কোনোরকম সমস্যায় না পড়ে। আমি আরও সাবধানী হয়ে, আমার ক্রেডিট কার্ডটা ওকে দিয়ে বললাম, সঙ্গে রাখো, বিপদে- যে কোন জায়গা থেকে টাকা তুলতে পারবে বা কার্ডটি ব্যবহার করতে পারবে।

স্পেন যদিও দেশ হিসেবে ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপদ, ভ্রমণকারী হিসেবে ওখানে গেলে মেয়েটির কোন কোন দিকে সচেতন থাকা দরকার, ওর বাবা আর আমি ওর সঙ্গে আলোচনা করলাম। ওর যেহেতু আঠারো হয়নি, কোনো ধরনের অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান করতে পারবে না, তাও বললাম। কোনো অপরিচিতের কাছ থেকে কিছু খাওয়া বা নেওয়া যাবে না, ব্যাগ সাবধানে রাখতে হয়, যাতে করে অন্য কেউ অপ্রত্যাশিত কিছু ঢুকিয়ে না রাখে ব্যাগে। আর ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বিপদে পড়লে কোথায় যোগাযোগ করবে প্রথম? আমরা পরামর্শ দিলাম পুলিশ এবং ওখানকার সুইডিশ দূতাবাসে যোগাযোগ করতে।

এসে গেলো যাবার মুহূর্ত। ওদের তিন বন্ধুর একজনের বাবা বিমানবন্দরে গাড়ি দিয়ে ওদেরকে নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। খুব ভালো লাগছে, সন্তান ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, আমাদের ছেড়ে একা চলতে শিখছে, মেয়ে-বাচ্চা বলে আলাদা করে চিন্তা করতে হচ্ছে না। মা বাবাকে চুমু দিয়ে ও গাড়িতে উঠে গেলো।

প্লেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে মোবাইল বার্তা পাঠিয়েছে, প্লেন ছাড়বে এখন। তিন ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলো স্পেনে। পৌঁছেই জানালো, ‘মা, বিমান থেকে নেমেছি, ব্যাগ সংগ্রহ করছি’। হোটেলে পৌঁছে, ছোট একটা ভিডিও পাঠিয়েছে, হোটেলটা দেখতে কেমন, বারান্দা থেকে নীল সমুদ্র আর সমুদ্রপাড় দেখা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, একজন খাবার নিয়ে এসে দরজায় টোকা দিচ্ছে, ওদের খাবার এসেছে। বুঝলাম, অনলাইনে হয়তো খাবার কেনার ব্যবস্থা করেছে। আমার চোখে আনন্দের পানি।

অনন্যা অষ্টাদশে, তার মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে শুভরাত্রি বলে বার্তা পাঠালো। পরদিন সকালবেলা উঠেই দেখি মোবাইল বার্তা পাঠানোর একটা গ্রুপ তৈরি করেছে, আমাদের তিনজনকে নিয়ে, ওর বাবা, আমি আর ওর ছোট ভাই লুব্ধককে নিয়ে। একজনকে ওর সম্পর্কে কিছু লিখলে বা ভিডিও পাঠালে যেন তিনজনই জানতে ও দেখতে পারি। আমার ভালো লেগেছে, ১১ বছরের ছোট ভাইকেও এখানে সমান গুরুত্ব দিয়েছে ও। এতে করে লুব্ধক তার দায়িত্বটা শিখবে। এভাবে সময় সময় বার্তা পাঠিয়ে আমাদেরকে জানায়, মনে হয় যেন, ও আমাদের সঙ্গেই আছে, শহরেই কোথাও ঘুরতে গিয়েছে।

আর একটা মজার ঘটনা বলি। ওর যাওয়ার দ্বিতীয় দিনে, দেখি হঠাৎ, আমার  বিকাশ অ্যাকাউন্টে, এখানে ‘সুইস’ বলে এটিকে, মেয়েটার ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা আসছে পরপর। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুইবার। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কোনো সমস্যা কিনা, ওর হিসাব থেকে তো আমার হিসাবে এখন টাকা আসার কথা নয়। সঙ্গে সঙ্গেই ওকে লিখলাম, তোমার হিসাব থেকে বারবার আমার হিসাবে সুইস হচ্ছে, তুমি কি কিছু জানো?

ও আমাকে বললো, ‘জানি মা, আমি পাঠাচ্ছি, কারণ আমার এক বন্ধুর কার্ড কাজ করছে না, তাই ও তোমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছে। যে পরিমাণ ব্যবহার করছে ও আমাকে সুইস করছে, আর আমি তোমাকে সুইস করে দিচ্ছি।’ আমি হাসলাম, ভালো লাগলো, ওর দায়িত্বশীলতা দেখে।

আমাদের ছোট সন্তানরা বড় হয়। সমাজ দেয় নিরাপত্তা আর আমরা বাবা-মায়েরা ওদের প্রতিটি কাজকর্মে বন্ধুর মতো পাশে থেকে ওদের আত্মবিশ্বাসের শেকড় গড়ি ।

লেখক পরিচিতি: স্টকহোমে শিক্ষকতায় জড়িত। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয়, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট ডক্টরেট করেছেন জার্মানির দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!