বাইক রেসার ক্রিস্টিনা ও আমার অসমবয়সী প্রেম!

আজ থেকে সাত বছর আগে এইচএসসির দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় হঠাৎই মোটর স্পোর্টসের ওপর আমার আগ্রহ তৈরি হয়। সে সময়ে রোমানিয়ার বাইক-রেসার ক্রিস্টিনার সঙ্গে আমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়। কে জানতো অর্ধযুগ পরে তার সঙ্গে আমার ইউরোপের মাটিতেই দেখা হবে!

রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2021, 07:50 PM
Updated : 4 July 2021, 07:50 PM

ওই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোটরবাইকারদের খুঁজে বের করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করাটা কেন জানি একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল। এভাবেই কোনও একটি ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে ক্রিস্টিনাকে পেয়ে গিয়েছিলাম।

বেশ কিছুদিন তার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার কারণে ব্যস্ততা, ব্যক্তিগতজীবনে সমস্যা এবং হতাশার কারণে ধীরে ধীরে মোটর স্পোর্টসের প্রতি আমার আগ্রহ হারিয়ে যায়। এ কারণে ক্রিস্টিনার সাথে একটা লম্বা সময় আমার সেভাবে আর যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি।

২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় প্রথম ইউরোপে আসি। ইউরোপে আসার পর কোনও এক অজানা কারণে রোমানিয়া আর বুলগেরিয়া- এ দুইটি দেশের ওপর আগ্রহ কাজ করতো। এ কারণে পরের বছর মার্চের শেষ সপ্তাহে ইস্টারের ছুটিতে রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া ঘোরার জন্য মনস্থির করি।

রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে যখন পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো- আরে ক্রিস্টিনা তো এখানকারই! আবার একটু পুরনো বন্ধুত্বকে ঝালাই করে নিই।

ক্রিস্টিনাকে মেসেজ করলাম। সে উত্তর দিল সঙ্গে সঙ্গেই। ঠিকানা দেওয়ার পর রওনা দিলাম তার বাসার দিকে।

তখন ক্রিস্টিনার বাসা ছিল শহরতলির বুখারেস্টের আলেকজান্দ্রু আইওয়ান কুজা পার্কের কাছে। বুখারেস্টের সিটি সেন্টার থেকে বেশ খানিকটা দূরে এবং সম্পূর্ণ কোলাহল নির্ঝঞ্ঝাটমুক্ত একটি জায়গা।

বুখারেস্টে বসবাসকারীদের নিত্যদিনের সঙ্গী আমাদের দেশের মতোই ট্রাফিক জ্যাম। আর এ ট্রাফিক জ্যামের কারণটাও খুব অদ্ভুত।

রোমানিয়ার কমিউনিস্ট শাসক নিকোলাই চওশেস্কুর শাসনামল (১৯৬৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত)  থেকে বুখারেস্টের স্থানীয় প্রশাসন পরিবহন ব্যবস্থার ওপর বেশ ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এ কারণে বুখারেস্টের বেশিরভাগ জায়গায় গাড়ি পার্কিং করতে আলাদাভাবে কোনও খরচ হয় না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে অনেকে তাই যে যার মতো যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করে রাখেন। ফলে বুখারেস্টের শহরতলিতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে অফিস আওয়ারে প্রায়ই এ যানজট দুঃসহ আকার ধারণ করে। পাশাপাশি গাড়ির হর্নের শব্দ তো আছেই।

হাজারো যান্ত্রিকতার ভিড়ে মুক্ত বাতাসে খানিকটা প্রশান্তির জন্য  চাইলে ক্রিস্টিনার বসবাসের জায়গা আলেকজান্দ্রু আইওয়ান যে কারও জন্য অন্যতম আদর্শ। ক্রিস্টিনা আমাকে আলেকজান্দ্রু আইওয়ান কুজা পার্কে আসার জন্য বলেছিল।

আমাকে দেখার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো এবং আমার গালে চুমু আঁকলো। সাথে সাথে এক অনাবিল প্রশান্তি পুরো হৃদয়কে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুললো।

কিছুক্ষণ ক্রিস্টিনার সাথে পার্কের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করলাম। ক্রিস্টিনা সম্পূর্ণভাবে বিপরীত জগতের একজন মানুষ। তবে তার সৃষ্টিশীল ব্যক্তিসত্ত্বা রয়েছে আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে।

বাইক রেসিং-এর পাশাপাশি ক্রিস্টিনার শখ হচ্ছে ন্যাচার ফটোগ্রাফি করা। জানালো, প্রকৃতির বিভিন্ন ছবি তুলতে ভীষণ ভালোবাসে। সে কখনও গাছের ছবি তোলে, কখনও আবার পাখি, কাঠবিড়ালিসহ বিভিন্ন জীবজন্তুর।

কিছুক্ষণ পার্কে বসে গল্পের পর আমরা চলে গেলাম পার্কের ঠিক বিপরীতে থাকা একটি শপিং মলে। শপিং মলের ছাদে একটা রেস্তোরাঁ ও কফি বার রয়েছে। সেখান থেকে পুরো পার্কের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। সারাদিন ঘোরাঘুরির কারণে বেশ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি  কোকাকোলা করলাম আর ক্রিস্টিনা কফি অর্ডার করলো। এরপর অনেকক্ষণ এটাসেটা নিয়ে গল্প হলো।

ক্রিস্টিনার বর্তমান বয়স প্রায় ৩৪, যেখানে আমার ২৪। বয়সে দশ বছরের বড় ক্রিস্টিনার সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন আমাকে তার প্রতি দুর্বল করে দিয়েছিল। মূলত আমি আকর্ষিত হয়েছিলাম ওর চিন্তা জগতের প্রতি।

ক্রিস্টিনা বিশ্বাস করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জিত জ্ঞানের চেয়ে বাস্তবে অর্জিত জ্ঞানের গুরুত্ব অনেক বেশি। পাশাপাশি সে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সমাজের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করাটাই প্রকৃত সার্থকতা। তাই হাসিমুখে সে ইউনিভার্সিটিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন উপভোগের একটি জীবন বেছে নিয়েছে। করপোরেসিকে সে ভেঙে দিতে চায়।

এক সাথে কিছু ছবি তুলি আমরা। ততোক্ষণে বিকাল হয়ে গিয়েছে। আমার ফেরার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। ক্রিস্টিনা আমাকে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সেখানে দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে আমরা অনুরোধ করি আমাদের আরও কিছু ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। তিনি দায়িত্বরত অবস্থায়ও আমাদের অনুরোধ রাখেন আন্তরিকতার সাথে।

এরপর আমি ক্রিস্টিনাকে বিদায় জানিয়ে মেট্রোতে উঠে পড়ি মিলিটারি অটোগারার উদ্দেশে যেখান থেকে আমার ফিরতি বাসে উঠার কথা ছিল। বিদায়ের সময় ক্রিস্টিনা আমাকে আরও দুইবার জড়িয়ে ধরে এবং আমার গালে চুমু খায়।

এরপর? এরপর আবার সেই আগের জীবন। ইউনিভার্সিটি, পড়াশোনা এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে আমার জীবনটা আবদ্ধ হয়ে পড়লেও ক্রিস্টিনার সাথে সেদিনের সে মুহূর্তগুলো সব সময়ই আমার হৃদয়ে চির ভাস্কর।

এখনও মাঝেমধ্যে ফেইসবুকে যোগাযোগ হয় ক্রিস্টিনার সঙ্গে। তার সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। বছর তিনেক আগে তার বাবা মারা গেছেন। বয়সজনিত কারণে মা-ও অসুস্থ থাকেন। এদিকে ক্রিস্টিনার মোটর-স্পোর্টস ক্যারিয়ারেও এখন বেশ টানাপড়েন যাচ্ছে।

মোটর-স্পোর্টস নিঃসন্দেহে অনেক ব্যয়বহুল। তাই নিয়মিতভাবে সে অংশ নিতে পারছে না। কারণ তার বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। যদিও সে এ বয়সে যথেষ্ট ফিট কিন্তু তবুও কোনো এক অজানা কারণে সে স্পন্সর পাচ্ছে না, যার মাধ্যমে সে আসলে আবার কাঙ্ক্ষিত রেসিং ট্র্যাকে ফিরে আসবে।

কথোপকথনে বুঝতে পারি, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ওপর ক্রিস্টিনা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কেননা তার মতে, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এমন একটি অর্থনৈতিক সিস্টেমের জন্ম দেয় যেখানে মানুষের কোনও স্বপ্ন থেকে আরম্ভ করে নিত্য প্রয়োজনীয় মৌলিক অধিকার, এমনকি চিকিৎসাসেবার মতো মানবিক বিষয়গুলোও বাণিজ্যে পরিণত হয়।

নতুন করে মোটর বাইক কেনা, এমনকি তার এখন যে বাইকটি রয়েছে বেশ পুরোনো বাইক- সেটার চাকা মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থটুকুও এখন ক্রিস্টিনার হাতে নেই। তার উপর চলছে করোনাকাল। জানিনা, কিভাবে সামাল দিবে সে!

সম্প্রতি রোমানিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করেছে। তবে এখনও দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে।

 মানুষ বাঁচে আশায়, ক্রিস্টিনা এখনও স্বপ্ন দেখে যে, তার এ দুরাবস্থা কোনো একদিন দূর হবে এবং সে আবারও মোটরস্পোর্টসে তার হারানো দিনগুলো ফিরিয়ে আনবে।

আমার সঙ্গে ক্রিস্টিনার আর কখনও দেখা হয়নি। তবে তার প্রতি দুর্বলতা রয়েই গেছে। কে জানে ওর প্রতি অসম বয়সের প্রেমের অনুভূতিতেই ভুগি কিনা!

লেখক: স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগে স্নাতক করছেন।

ইমেইল: rakib.rafi786@gmail.com

লেখকের অন্যান্য লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!