আমার বন্ধু লেইরা

ইউরোপের আদি অধিবাসীরা জাতিগতভাবে সবাই ককেশীয় এবং শ্বেতাঙ্গ হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে বিভাজন। এ কারণে বুলগেরিয়ার একজন মানুষকে বাহ্যিকভাবে যে রকম দেখা যায়, সুইডেন, নরওয়ে অথবা ডেনমার্কের কোনও অধিবাসীকে দেখতে ঠিক একইরকম দেখা যায় না। 

রাকিব হাসান রাফি, স্লোভেনিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2021, 09:40 PM
Updated : 23 June 2021, 09:40 PM

আর এর বাইরে স্লাভিক দেশগুলোর মানুষ তো রয়েছেই। বলা হয়ে থাকে, স্লাভিক দেশগুলোর নাগরিকরা নাকি শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বাহ্যিক রূপ-লাবণ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে।

রাশিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়ার এসব দেশের আদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা ‘স্লাভ’ নামে পরিচিত, যার ‘স্লাভিক’ শব্দটি এসেছে।

স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে বিশেষ করে এদের শরীরের বিভিন্ন অংশের গঠন কিংবা চুল অথবা গায়ের চামড়া কিংবা চোখের রং-সহ বেশ জিনগত কিছু কারণে ইউরোপের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থেকে এরা আলাদা। মাঝে-মধ্যে এ সসব দেশের মেয়েদের দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন তাদের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। 

তেমনই এক অপার সৌন্দর্যের অধিকারী আমার বন্ধু ভ্যালেরিয়া কর্টুন। যদিও আমরা তাকে ‘লেইরা’ বলে সম্বোধন করতাম। লেইরার সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক নয়, বরং মনের দিক থেকেও সে অন্যরকম। সে গল্প বলতেই স্লাভিক সৌন্দর্যের সাতকাহন নিয়ে বসেছিলাম।  

লেইরার বাবার বাড়ি ইউক্রেনের এক সময়ের রাজধানী কারকিভের একবারে কাছেই। বর্তমানে লেইরা রাশিয়ার দক্ষিণের শহর রোস্তোভ-অন-ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করছে। 

‘ইরাসমাস প্লাস একচেঞ্জ প্রোগ্রামে’র আওতায় সে এক সেমিস্টারের জন্য স্লোভেনিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা’তে এসেছিল। ডরমেটরিতে লেইরা ছিল আমার প্রতিবেশী। মাত্র তিন-চার মাস ছিল লেইরা; হয়ে উঠেছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। 

একবার পায়ে কাঠের টুকরো বিঁধে দুই রাত অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছিলাম। বাসা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব কয়েক মাইলের। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছিল স্লোভেনিয়ায়। তাই হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকগুলো কেবল কোভিড আক্রান্ত এবং গুরুতর রোগী ছাড়া অন্য কাউকে চিকিৎসা দিচ্ছিল না। এসময় লেইরা নিজে এসে আমার পায়ে আটকে থাকা কাঠের টুকরোকে বের করে দিয়েছিল। 

অল্প কয়েকদিনেও একসাথে অনেক জায়গায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে আমাদের। লেইরা যখন ভালো কিছু রান্না করতো আমাদের সবার সাথে সেটা ভাগাভাগি করতো। রান্না করে খাবারের একটা অংশ সে কিচেনে রেখে দিত। কেউ যদি কোনও কারণে রান্না করতে না পারতো বা ডরমেটরির কারও কাছে যদি খাবার না থাকতো- তাহলে লেইরার রান্না করা খাবার তো ছিলই। 

পায়ে কাঠের টুকরো ঢোকার কিছুদিন বাদে গত বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে আমার হঠাৎই করে ভীষণ জ্বর আসে। করোনাভাইরাসের লক্ষণ মনে করে সবাই আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিল। তবে লেইরা এবং একইসাথে আমার আরেক সার্বিয়ান প্রতিবেশী নিকোলা কুৰ্দুমানোভিচ ছিল ব্যতিক্রম। 

মারাত্মক ছোঁয়াচে কোভিডের তোয়াক্কা না করেই এ দুইজন আমাকে ডরমেটরি থেকে আট কিলোমিটার দূরের একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। 

সেমিস্টার শেষ করে লেইরা ফিরে গেছে রাশিয়ায়। বিদেশ বিভুঁইয়ে ওর কাছ থেকে যে সেবা পেয়েছি, বন্ধুত্বের যে প্রগাঢ় বন্ধনে অল্প কয়েকদিনেই আমরা মানসিকভাবে খুব কাছাকাছি হয়েছিলাম- সে স্মৃতিগুলো জীবন্ত সত্তা হয়ে আমার ভেতরে রয়ে গেছে।  

হয়তো বা এ স্মৃতির টানে ভবিষ্যতে কোনওদিন ছুটে যাবো রাশিয়া কিংবা ইউক্রেনে। গত বছরের সে সুন্দর মুহূর্তগুলো আর ফিরে আসবে না। তবে লেইরার সাথে নিশ্চয়ই আরও কিছু স্মরণীয় সুন্দর মুহূর্ত কাটবে। সেটুকু হলেই বা ক্ষতি কী! 

লেখক: স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বিভাগে স্নাতক করছেন।

ইমেইল: rakib.rafi786@gmail.com

লেখকের অন্যান্য লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!