এ অনুষ্ঠানকে চীনা ভাষায় ‘তুয়ান-উ-চিয়ে’ বলা হয়। প্রতি বছর চীনা চন্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিনে এটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী এবছর ১৪ জুন এটি উদযাপন করা হবে।
ড্রাগন নৌকা উৎসবের ইতিহাস দুই হাজার বছরের পুরনো হলেও ২০০৬ সালের ২০ মে প্রথমবারের মতো এটিকে জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ২০০৮ সাল থেকে চীনে এ উৎসব পালন করার জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
চীনাদের বিশ্বাস যে ড্রাগন নৌকা উৎসবের শুরুটা হয়েছিল ছু রাজ্যের (৭৭০-২২৩ খ্রিস্টপূর্ব) একজন দেশপ্রেমিক কবি ও কূটনীতিক ব্যক্তি ছু ইয়ুয়ানের (৩৪৩-২৭৮ খ্রিষ্টপূর্ব) মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। ছু ইয়ুয়ান ছিলেন সত্যবাদী ও পণ্ডিত ব্যক্তি, যে কারণে তার রাজসভার অনেকেই তাকে অপছন্দ করতো। যার ফলস্বরূপ তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে রাজার চোখে রাজ্যের শত্রু হিসাবে প্রমান করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু ছু ইয়ুয়ান এ মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে না পেরে একসময় বুকে পাথর বেঁধে মিলুও নামক নদীতে ঝাঁপ দেয়।
এখবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষেরা তখন তাকে নৌকা করে উদ্ধার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। এসব ঘটনার পরও তিনি ছিলেন রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাছে অনেক সম্মানিত ও প্রিয়ভাজন, তাই পরবর্তীতে ছু ইয়ুয়ানের মৃত্যুদিনকে কেন্দ্রে করে রাজ্যের মানুষেরা নদীতে ড্রাগন নৌকা উৎসবের আয়োজন করে তাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে এবং নদীতে ভাত ছিটাতে থাকে যাতে করে তার দেহ মাছে খেয়ে না যায়। তবে সেই ভাত যাতে সহজেই ডুবে যেতে পারে এবং ছু ইয়ুয়ানের কাছে পৌঁছতে পারে সেজন্য তারা বাঁশের পাতার মধ্যে ভাতগুলোকে বেঁধে জলে ফেলে দেয়। আর এর থেকেই শুরু হয় ‘জোংজি’ নামক এ বিশেষ খাবারের।
তবে জোংজি তৈরির উপকরণের উপর নির্ভর করে এর স্বাদ ও গন্ধ ভিন্ন হয়ে থাকে। এছাড়া এ উৎসবে ‘রিয়াল্গানমদ’ নামে বিশেষ এক ধরণের পানীয় পান করা হয়ে থাকে। কারণ প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিলো যে, এই বিশেষ ধরণের পানীয় পান করলে সব প্রকার পোকামাকড় এবং অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ড্রাগন নৌকা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো ড্রাগন নৌকা প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সব বোটগুলো কাঠের তৈরি চীনা ড্রাগন আকৃতির হয়ে থাকে, যার সামনের দিকটা হা করা ড্রাগনের মুখাকৃতি এবং পেছনের দিকটা আগুন জ্বলা ড্রাগনের লেজের মতো করে তৈরি করা হয়ে থাকে। এ নৌকাগুলো সাধারণত ২০-৩৫ মিটার লম্বা হয় এবং এক একটি নৌকায় প্রায় ৩০-৬০জন অংশগ্রহণ করতে পারে।
২০১৮ সালে চীনে আসার পর থেকে আমি দেখছি এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ৩ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ উৎসব উপলক্ষে সব চীনা নাগরিকরা তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে এবং কেউ কেউ মাগওরট পাতা দরজার সামনে ঝুলিয়ে রাখে, কারণ তাদের বিশ্বাস এ পাতা দরজায় ঝুলিয়ে রাখলে নাকি বিভিন্ন পোকামাকড় বিশেষ করে মশা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অন্যান্য উৎসবের মতো এ উৎসবেও বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন উপহার দিয়ে থাকে, যার মধ্যে সিল্কের কাপড়ে মোড়ানো বিশেষ সুগন্ধি উল্লেখযোগ্য। এসময় চায়নার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড় এবং বিভিন্ন গণপরিবহনগুলোতেও থাকে বিশেষ সুবিধা।
এছাড়া আমি দেখেছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাংহাই এর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে ড্রাগন নৌকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। এদিন আমি ও আমার বন্ধু-বান্ধব এবং শিক্ষক সবাই মজা করে দিনটি উদযাপন করে থাকি।
কিন্তু গত বছর কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এ উৎসব উদযাপন করা হয়নি, তবে আশা করি এবছর কিছুটা হলেও উদযাপন করা হবে। এছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে দেখি এ উৎসবের অন্তত ১৫ দিন আগে থেকেই বিভিন্ন স্বাদের জোংজি বিক্রি করা শুরু করে। সব মিলিয়ে চারদিক আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করে।
আধুনিক সময়ে চীনের এ ড্রাগন নৌকা উৎসব শুধু চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা এখন গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ এশিয়ার অনেক দেশে উদযাপন করা হয়। তাই পরিশেষে এটা বলা যায় যে ড্রাগন নৌকা উৎসব প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক: মাস্টার্স অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটি, সাংহাই, চীন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন |