সুইডেনে প্রতিদিনের জীবনযাপনে পরিবেশ রক্ষার নমুনা

একদিন আমার দশ বছরের মেয়ে স্কুল থেকে ফিরেই বাসায় সেদিনের জমে থাকা ময়লাগুলো আলাদা আলাদা জমা করে বিভিন্ন ময়লার বাক্সে ফেলতে লাগলো। বিভিন্ন ময়লার বাক্স বলতে কাগজ, প্লাস্টিক, খাবারের উচ্ছিষ্ট, ইলেকট্রনিক তার, ব্যাটারি ইত্যাদি ফেলার আলাদা বাক্স।

রাবেয়া মীর, স্টকহোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2021, 04:36 AM
Updated : 31 May 2021, 04:36 AM

এ বাক্সগুলো এখানকার রান্নাঘরে সারিবদ্ধভাবে বিশেষ করে পানির কলের বেঞ্চের নিচে সাজানো থাকে। মেয়েটি আমার শুধু তাই করে থেমে যায়নি, খেয়াল করে দেখছে আমরা ঠিক বাক্সে ঠিক ময়লাটা ফেলেছি কিনা। ভালো লাগা ছুঁয়ে গেলো। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, খুব ভালো কাজ করছো। কিন্তু কি ব্যাপার, আজ বাসার ময়লাগুলো আলাদা আলাদা করে ফেলার প্রতি তোমার আগ্রহ?

ও বলতে লাগলো- মা, এগুলো একসঙ্গে ফেললে পরিবেশ ভাল থাকবে না। আর একসময় আমাদের বিভিন্ন দেশ পানির নিচে চলে যাবে, খুব ভয়ের না মা? বুঝতে দেরি হলো না, স্কুলে পরিবেশ সম্পর্কে শেখানো হচ্ছে, প্রতিদিনের ময়লাগুলো যেখানে সেখানে না ফেলে কীভাবে কোথায় ফেলা যায়।

প্রথম যখন এদেশে এসেছি, ছাত্রাবাসে থাকতাম। অনেককিছুই নিজ দেশ থেকে আলাদা বলে চোখে পড়তো। এর মধ্যে একটি হলো, রান্নাঘরে বিভিন্ন ময়লা বিভিন্ন বাক্সে ফেলা। ঘরে জমানো ময়লাগুলো ফেলার জন্য বাসার বাইরে একটু দূরে বড় বড় বাক্স থাকে। পরে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে ময়লা সংক্ষরক্ষণকারীরা ময়লার গাড়ি নিয়ে এসে ময়লাগুলো নিয়ে যায়। এটা সপ্তাহে এক বা দুইবার হয়। এখানকার সব মানুষ মোটামুটি এভাবে বাসাবাড়ির ময়লাগুলো ফেলে অভ্যস্ত। তবে বাইরের দেশ থেকে যখন কেউ সুইডেনে আসে, এ অভ্যাসে আসতে তাদের সময় লেগে যায়।

রাস্তার পাশে খোলা বইয়ের তাক থেকে পথচারী পছন্দমত বই নিচ্ছেন

একটি ঘটনা বলি। স্টকহোমের বিভিন্ন এলাকায় আমার থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একবার ইউরডব্রু নামক একটি জায়গায় বাসা নিলাম। শুনলাম ওই এলাকায় যাদের বসবাস তাদের রাজস্ব বেশি দিতে হবে। কারণ ওই এলাকায় বাইরে থেকে আসা লোকজন বেশি থাকে এবং তারা ময়লা আলাদা করে ফেলাটা ভালোভাবে অনুসরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। তাই ময়লাগুলোকে পরে সরকারের আলাদা করে ফেলতে হয় ও অতিরিক্ত খরচ পড়ে। এ এলাকার মানুষকে বেশি রাজস্ব দিতে বাধ্য করে, এভাবে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলতে নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে বলে সরকার মনে করে।

এদেশে বড় কোনো উৎসব হলে সাধারণ জনগণ বিভিন্ন পানীয়ের কাচের বোতল ভেঙে রাস্তায় ফেলে রাখে যা পরের দিন লোকবল নিয়োগ করে সরকার থেকে পরিষ্কার করতে হয়। এ কাচগুলো রাস্তায় চলার সমস্যা করে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে। এগুলো পরিষ্কার করতে অতিরিক্ত লোকবল দরকার হয়। এ কাজে ব্যবহৃত গাড়ি থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বাতাসে আসে।

পুনরায় ব্যবহার করা যায় এমন কাপড় ফেলার বাক্স

বেশ কয়েক মাস আগে একটি টি-শার্ট কিনে দাম দিতে গিয়ে একটি পলিথিন ব্যাগ নিতে গিয়ে দেখলাম হাতের কাছে কোনো ব্যাগ নেই। কোনোকিছু কেনার সময় পলিথিন ব্যাগও তুলে দিতাম, এখন আর দেখছি না। অপেক্ষা করছি, দেখি, ক্যাশিয়ার কী বলেন। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগ লাগবে কিনা। আমি বললাম, লাগবে। দেখছি, ডেস্কের নিচ থেকে কাগজের ব্যাগ বের করছেন। আর একটি কাগজের ব্যাগের দাম পলিথিন ব্যাগের চেয়ে তিনগুণ বেশি। পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের জন্য ভালো নয়। তাই ব্যাগের পরিবর্তন, বুঝতে পারলাম। হাতের নাগালের বাইরে রাখার কারণটা ধরতে পারলাম। লোকজনের যাতে করে একটু কষ্ট হয় ব্যাগটা সহজে নিতে এবং নিরুৎসাহিত হয় নতুন ব্যাগ ব্যবহারে।

দেখা যায়, অনেক মানুষই এখন বাড়ি থেকে পুরোনো ব্যাগটি নিয়ে আসে এবং একই ব্যাগ বারবার ব্যবহারকারীকে পরিবেশবান্ধব বলেও মনে হয়। পুরোনো ব্যাগ ব্যবহার করলে ভেতরে ভেতরে একটা ভালো লাগা কাজ করে এই ভেবে, আমরা পরিবেশের যত্ন নিচ্ছি।

বাস বা ট্রেনে উঠলেই দেখা যায় দরজার কাছাকাছি ময়লা ফেলার বাক্স থাকে। এ বাক্সগুলোতে সাধারণত কাগজ, প্লাস্টিক বা ফলের খোসা এজাতীয় ময়লাটা বেশি ফেলা হয়। এ ধরণের ময়লাগুলো একই বাক্সে ফেলার অনুমতি আছে। কিন্তু অন্য কোনো রকম ময়লা যেমন ইলেকট্রিক তার বা ব্যাটারি এসব এই বাক্সগুলোতে ফেলা নিষেধ।

রাস্তার পাশে খোলা বইয়ের তাক

বনে ও পার্কে মানুষ হাঁটে, দৌড়ায়, কখনোবা বেঞ্চে বসে সময় কাটায়। হাতে কোনো ময়লা, যেমন ব্যবহৃত টিস্যু বা ফলের অবশিষ্ট অংশ কোথায় ফেলা যায়, চিন্তা করতে হয় না। কিছুদূর পরপর ময়লা ফেলার বাক্স। ঠিক একই রকম ব্যবস্থা রাস্তার ধার ও নদীর পাড়গুলোতেও। তবে একেবারেই প্লাস্টিক বোতল, টিস্যু বা প্লাস্টিক ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায় না, তা না। এরকম পড়ে থাকতে দেখা গেলে অস্বাভাবিক মনে হয়। কেউ কি অজান্তে বা অবহেলায় ফেলেছে? এ প্রশ্নটা মাথায় আসে।

একটি ব্যাপারে আমি অবাক হয়েছিলাম। এখানে গাড়ির হর্ন বাজানোর বাতিক নেই। সুইডেনে আসার পর এক বছরের মধ্যে যখন গাড়ির কোনোরকম হর্ন শুনিনি। একদিন শুধু দেখেছিলাম এক গাড়িচালক একটি হর্ন বাজিয়েছিল। কারণ আরেকজন চালক রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ভুল করেছিল বলে!

ছাত্রাবাসে যখন থাকতাম, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ছাত্ররা সাপ্তাহিক ছুটিতে রাত দশটার পর থেকে প্রায় ভোর পর্যন্ত পার্টি করতো। সেখানে অনেক গান বাজনা, নাচ, গল্প বেশ আওয়াজের সঙ্গে হতো। কাজের দিনগুলোতে রাত আটটার পর সাধারণত কোনো রকম আওয়াজ কেউ করে না। কারণ পরের দিন সবার কাজ আছে, আগের রাতে সবাইকে ঘুমাতে হবে।

বাড়ির পাশে ময়লা ফেলার সারিবদ্ধ বাক্স

একটা গল্প বলি। আমার ছেলে লুব্ধক যখন আমার গর্ভে, তখন একদিন রাত দুইটা পর্যন্ত ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, ঘুমাতে পারছি না। পাশের রুমে ভীষণ আওয়াজ, গান বাজনা হচ্ছে। পরে মনে হলো, বলি আমার অবস্থাটা। দরজায় টোকা দিয়ে বললাম, আমি ঘুমাতে পারছি না, শব্দের জন্য। ওরা বুঝতে পেরে আওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছিলো।

আরেকটা জিনিস ভালো লাগতো, ছাত্রাবাসে যদি কোনো ছাত্র পার্টি করতো, তাহলে দুই-তিনদিন আগে থেকেই একটা ছোট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিতো যে তার একটা পার্টি হবে, ওইদিন। তাহলে অন্যরা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারতো যে সেদিন আওয়াজ হতে পারে। অপ্রয়োজনীয় বিকট শব্দ অনবরত না হলে মানুষ সুস্থ থাকে বেশি, কারণ অপ্রয়োজনীয় শব্দ বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের ঘুমের ক্ষতি করে থাকে বা দিনের বেলায় বিরক্তি তৈরি করে থাকে।

রাস্তার পাশে পার্কে ময়লা ফেলার বাক্স

কারখানায় এবং গবেষণাগারে যে রাসায়নিক জিনিস ময়লা হিসেবে বের হয়, সেগুলো সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বড় বড় বাক্স থাকে ওখানে। বাক্সগুলো বিভিন্ন রঙের ও নামের হয়। বাক্সের গায়ে বিভিন্ন বিপদজনক চিহ্ন দেওয়া থাকে, যাতে করে যারা কাজ করেন তারা সহজে বুঝতে পারেন, কোথায় কোন ময়লা ফেলতে হবে। চিহ্ন থেকে এটাও বোঝা যায়, ময়লাগুলো ফুসফুস বা চামড়ার জন্য ক্ষতিকর কিনা, যাতে করে ফেলার সময় কর্মীরা সাবধান থাকে। পরবর্তীতে ময়লা সংরক্ষণকারীরা সপ্তাহে দুই বা একবার এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।

একবার অৱস্টা নামক একটি জায়গায় বাস করতাম। ওখানে রাস্তার পাশে খোলা বইয়ের তাক দেখে প্রথমে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম, নতুন পুরোনো বইগুলো কি কেউ বিক্রি করছে? একটু কাছাকাছি গিয়ে দেখি কেউ কেউ তাদের পুরোনো বই রেখে যাচ্ছে আর কেউ আবার পছন্দ অনুযায়ী বই বাছাই করে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, মানুষের পড়া পুরোনো বইগুলো এখানে রেখে যায় এবং অন্যরা নিজের মতো নিয়ে যায়। পুরোনো বইগুলো এভাবে মানুষ পড়ছে। এতে করে একই রকমের বই উৎপাদন দরকার হচ্ছে না। আবার একই বই দিয়ে অনেক মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

ঠিক এরকমটি দেখেছি এখানকার বিভিন্ন বিপণিকেন্দ্রে। চা-কফির দোকানের পাশেই বইয়ের তাকের মতো আছে, যেখানে মানুষ পুরোনো বই রেখে যায়। চা কফি পান করতে করতে বসে থাকা মানুষ বই এর নামগুলোতে চোখ বুলাতে পারে, ইচ্ছে হলে পাতা উল্টে দেখে ও পছন্দ হলে সাথে করে বইটি নিয়ে যেতে পারে। এভাবে পুরোনো বইগুলো অন্যদের কাজে লাগানো হয়।

এবার আসি ক্লাড ব্যাংক বা কাপড়ের ব্যাংক প্রসঙ্গে। কাপড় পুরোনো হয়ে ছিঁড়ে গেলে, বা জুতা ছিঁড়ে গেলে ময়লা হিসেবে একটা আলাদা জায়গায় ফেলা হয়, তা জানি। কিন্তু রাস্তার পাশে সবুজ রঙের বড় বড় বাক্স যেখানে লেখা ‘ক্লাড ব্যাংক’, মানে কাপড়ের ব্যাংক। দেখে ভাবছিলাম, এগুলো কেন? শুনলাম, মানুষের ব্যবহার করা কাপড় বা জুতা যা অন্য কেউ এখনো ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয়, এমন কাপড় লোকেরা ধুয়ে এখানে রেখে যায়। পরে ক্লাড ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত লোকজন এসে নিয়ে যায় এবং অস্বচ্ছল দেশগুলোতে পাঠায়।

শুধু তাই নয়, পুরনো জিনিসপত্র বিক্রির দোকানগুলোতে মানুষ পুরোনো জামা কাপড়, অন্য জিনিসপত্র বিনামূল্যে দিয়ে যায় এবং সেসব দোকানে এগুলোকে নামমাত্র দামে বিক্রি করা হয়। এসব টাকা পরে সমাজে কোনো ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে করে পুরোনো জিনিসগুলো কাজেও লাগছে এবং অন্যরা তাদের পছন্দমতো জিনিস কম দামেও পাচ্ছে!

রাস্তার পাশে ময়লা ফেলার বাক্স

সুইডেনে প্লাস্টিক বোতল ফেরত দিয়ে বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়। বিভিন্ন পানীয়ের বোতলগুলোতে একটা নির্ধারিত মূল্য লেখা থাকে। বোতলগুলো ফেরত দিলে সে অনুযায়ী টাকা পাওয়া যায়। প্রত্যেক বাসায় প্লাস্টিক বোতল জমানো হয় এবং বেশ কিছু জমে গেলে বাজারে নিয়ে গিয়ে একটা মেশিনে একটি একটি করে ফেললে টাকার রশিদ বের হয়ে আসে। এতে করে বাচ্চারাও বোতল জমা দিতে বেশ মজা পায়। বড়-ছোট সবাই এভাবে পরিত্যক্ত বোতল পুনরায় জমা দিতে উঠে পড়ে লাগে।

প্রতিদিন জীবনযাপনের অনেক গল্প ও কথা ভিড় জমাচ্ছে। একটি কথা বলে শেষ করবো। ভালো লাগে যখন দেখি, গাড়ি থাকা সত্ত্বেও ভারি কিছু না কিনলে লোকজন পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বাজার সদাই করতে গেলে পায়ে হেঁটে বা বাসাইকেলে করে যায়। এতে দুটো লাভ, এক. শরীর ভালো থাকে ও দুই. গাড়ি থেকে অতিরিক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়ায় না।

লেখক পরিচিতি: স্টকহোমে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয়, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করেছেন জার্মানির দ্রেসদেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন