ভ্রমণ কাহিনি: শিষামারা নদীর বাঁকে, পর্ব ২

সকালে রাধা আর মৌমিতার ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করতে যাবার আয়োজন চলছে। আমাকে খুব করে বলল। আমি বললাম, ‘পাখির ছবি তোলা হইতে ঘুম উত্তম।’

ফাতিমা জাহানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2021, 08:22 AM
Updated : 26 May 2021, 08:35 AM

পাগল নাকি! সারা বছর খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। এখন বেড়াতে এসেও (অবশ্যই অবকাশ যাপন মাউন্টেন ক্লাম্বিং বা কোন বিশেষ জায়গায় যাওয়া নয়) ভোরে উঠতে হবে! কক্ষনো না। এরা সকাল হতেই বেশ ক্যামেরা ট্যামেরা কাঁধে নিয়ে পাখির মতো উড়ে গেল। আমি খানিকক্ষণ বাদে উঠে দোতলা থেকে হাক দিলাম, ‘টুসু চা আ আ আ আ।’

এরপর নিচে নেমে দেখি দল প্রায় ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। নিজের বাড়িতে সকালবেলায় চা, কফি নিজেকেই বানিয়ে খেতে হয়। এখানে দোলনায় বসে মাথা ঘুরিয়ে গাছপালা দেখতে দেখতে চা খাওয়ার (তাও আবার অন্যের হাতে বানানো) স্বর্গীয় সুখ কেন মিস করব!

চায়ের পর নাস্তা পর্ব। এরপর আমরা এখানে যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সার্থক করা মানে আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা। অবশ্য এ দলের মেয়েদের তো মনে হয় ঘোরার চেয়ে হৈচৈ আর আড্ডায় মনোযোগ বেশি। আমি এদের দলে ভিড়ে হার্ড কোর ট্রাভেলার থেকে দূরে সরে বখে গিয়েছি। এরকম করে বখে যেতে চেয়েছিলাম সবসময়।

যথাসময়ে গাড়ি হাজির। আমরাও কলকল করতে করতে গাড়িতে বসে গান শুনতে শুনতে চিলাপাতা জঙ্গল পার হলাম। জঙ্গলে গরুর পালের সঙ্গে রাখাল বেসে যাদের দেখলাম তারা আদিবাসী নারীপুরুষ। বাংলার গভীর জঙ্গলের সঙ্গে পরিচয় এই প্রথম। কেমন যেন শান্ত আর মায়া মায়া, ঝিম ধরানো ভাব আছে। চিলাপাতা জঙ্গল পার হয়ে চললাম হ্যামিলটনগঞ্জের মাঝ দিয়ে। নির্ঘাৎ ব্রিটিশদের দেয়া নাম। সেখানে থামা হল এক পশলা ছবি তোলার জন্য। ছবি আমি তুলি প্রকৃতির বা মানুষের। আর এখানে বাংলার প্রকৃতি সবুজে নীলে, জলে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। এই রূপ না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। যারা শহরে বড় হয়েছে তাদের জন্য এ এক নতুন দেশ।

পথের একপাশে একটা সাইকেল ভ্যানগাড়ি দাঁড় করিয়ে আখের রস বিক্রি করছেন একজন। আমার আখের রস খাওয়ায় একেবারেই মনোযোগ নেই। আমি চালকের সিটে বসে ভ্যানগাড়িটা চালাতে চাইলাম, কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়লো না। কারণ চাকা শিকল দিয়ে আটকানো ছিল। ভেবেছিলাম এই আখের রস বিক্রি করেই পরবর্তী ট্রিপের টাকা জোগাড় করব। সে আশায় গুড়েবালি।

বন্ধুরা এসে জুটেছে এতক্ষণে, নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এরপরের গন্তব্য ‘রাজা ভাত খাওয়া’ রেলস্টেশন। বেশ অদ্ভুত নাম। তবে এই নামের পেছনের ইতিহাসও বেশ উল্লেখযোগ্য।

হ্যামিলটনগঞ্জে দল

১৮০০ সালের দিকে কোচবিহারের রাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়ন ভুটানের রাজার হাতে বন্দি হন। রাজাকে প্রথমে বক্সা ও পরে তৎকালীন ভুটান রাজধানী পুনাখাতে বন্দি করে রাখা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও কোচবিহারের যৌথ সেনাবাহিনী কোচবিহার আর ভুটান সীমান্তের সমস্ত ভুটানি সেনাঘাঁটি ভেঙে দেয়। যুদ্ধের পর ইংরেজরা দাবি করে যে, রাজা ধৈর্য্যেন্দ্রনারায়নকে মুক্তি না দিলে তারা ভুটান রাজধানী দখল করবে। মুক্ত হলেন বাঙালি রাজা। রাজা ভুটান থেকে মুক্তি পেয়ে বক্সা পার হয়ে কোচবিহার যান।

রাজার মুক্তির আনন্দে রাজপুরুষগণ রাজাকে অভ্যর্থনা জানাতে বক্সায় আসেন এবং এখানেই রাজার প্রথম অন্নগ্রহণের ব্যবস্থা করেন। বহুদিন পর স্বদেশে ফিরে এই জায়গায় বসে রাজা ভাত খেয়েছিলেন। এরপর থেকে এখানকার নাম হয় ‘রাজা ভাত খাওয়া’। এখানে ততোধিক প্রাচীন ও অপার্থিব সুন্দর যে রেলস্টেশন আছে তা ব্রিটিশরা যেমন করে রেখে গিয়েছিল তেমনই রয়ে গিয়েছে, এক রত্তি বদলায়নি।

চারদিকে গাছপালার ছড়াছড়ি, দুটো রেল ট্র্যাক, লাল রঙা ইটের একতলা স্টেশন, স্টেশনের দরজা কাঠের, স্টেশনে পাতা সিমেন্টের বেঞ্চি। সবুজে লালে ছড়িয়ে আছে গ্রামের জগত। আহা, যেন গত শতাব্দীর প্রথমে চলে যাওয়া৷ আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল স্টেশনে এখন শুনশান নীরবতা। ট্রেন থামে খুব অল্পই, এতে স্টেশনের নীরবতার একটুও ব্যাঘাত ঘটে না।

স্টেশন পেরিয়ে আমরা চললাম বক্সা জঙ্গলের দিকে। সে প্রায় ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি। বক্সা জঙ্গল বাঘের জন্য প্রসিদ্ধ, কে জানে একসঙ্গে আটজন বাঘ দেখে আসল বাঘ না আবার ভয় পায়!

জঙ্গলে প্রবেশের মুখে আদিবাসীদের ছোট ছোট কাঠের ঘরবাড়ি, ওরা ‘টোটো’ জাতি। কেউ ঘরের দাওয়ায় বসে আছে তো কেউ পিঠে ঝুড়ি ঝুলিয়ে শাক সবজি বা কাঠের সন্ধানে চলেছে। কয়েকটা খাবারের দোকানও আছে জঙ্গলে ঢোকার মুখে, অবশ্য তা পর্যটকদের জন্য। বক্সা জঙ্গলের ভেতরে গভীরে যাবার অনুমতি নেই। এ জঙ্গল বাঘের জন্য বিখ্যাত। পাখির ডাক আছে অবারিত আর গাছের পাতার শিরশিরে বাতাস। নিচের ঢালে গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণা। আমাদের ফটোসেশান করতে করতেই অনেকখানি সময় পেরিয়ে গেল। জঙ্গলে শাল, সেগুন, কড়ই, মেহগনি, চিলনি, আকাশমণি, জারুল, সেগুন গাছের ছড়াছড়ি।

মৌমিতা আমাকে বেশ শিখিয়ে পড়িয়ে নিল কিভাবে ছবির জন্য পোজ দিতে হয়। লাভ হয়েছে বলে তো মনে হয় না। সব পোজ পরে গুলিয়ে ফেলেছি। যেখানে মুচকি হাসার কথা সেখানে বত্রিশ দাঁত বের করা, যেখানে ডান হাত খানিক উপরে তুলতে হবে সেখানে একপায়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। এরপর আমরা গেলাম জয়ন্তী পাহাড়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের দলেও কিন্তু একজন আছে জয়ন্তী নামের। অসামান্য সুন্দরী জয়ন্তীও আজ পাহাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ জামা পরে এসেছে।

একদল স্কুলের বাচ্চাদের মতো জয়ন্তী নদীর পাথুরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অবশ্য জল এখন হাঁটু অবধি, তবে স্রোত তীব্র। পায়ের নিচে ছোট ছোট সাদা আর ধূসর পাথর, সামান্য প্রস্থের নদী পেরিয়ে আরও সামনে পাথরের শুভ্র চাদর আর তার সামনে বিশাল বাহু মেলে দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় সবুজ জয়ন্তী পাহাড়। আমাদের বাংলার পাহাড়! পাহাড়ের গা ঘেঁষে আরও দূরে ভুটান পাহাড়।

নদীর এপাড়ে তিনজন বাঙালি নারী রঙ্গিন শাড়িতে পুজো দিতে এসেছেন, একজনের পরনে অবশ্য সাদা থান। হাতের থালায় ফলারের নৈবেদ্য। স্রোতোস্বিনী নদীর দিকে মুখ করে চলছে মন্ত্রপাঠ। আর আমার দল ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে নদীর দু’পাড়ের সাদা পাথরে আর নদীর ছোট ছোট স্রোতে। আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্যই আমরা এসেছি। সেভাবেই ভাগ করে নিলাম আমাদের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় একসঙ্গে। স্বাতী যে কখন ফটাফট গাদাখানেক ক্যান্ডিড ছবি তুলেছে তা বুঝতেই পারিনি। দিন শেষে আমরা যখন রিসোর্টে ফিরলাম হৈহৈ করে রাজ্য জয়ের আনন্দে তখন আর আমাদের কে পায়!

চিলাপাতা জঙ্গলে আদিবাসী

সন্ধ্যে সবে ছুঁই ছুঁই করছে শিষামারা নদীর আঁচল। ধীরে ধীরে গোলাপি হয়ে উঠছে নদী আর তার আপনজনেরা৷ আমরাও তার আপনজন। ভ্রমণের চেয়ে বেশি প্রিয় এখন এই মানুষগুলোর সঙ্গ। স্থান, কাল, পাত্র না মেনে যাদের সামনে মনের ডালি উজাড় করে দেয়া যায় তারা বন্ধু নয় আত্মীয়। এমন নয় যে একজন বলছে অন্যরা শোনে। সবার গল্প আছে আর আলাদা আলাদা গল্পগুলো যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন আমরা মহাসমুদ্রের বাসিন্দা, একজন আরেকজনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছি, একে অন্যের সঙ্গে, একে অন্যের মাঝেই বাঁচি।

আর এখানে তো সন্ধ্যে নামতেই নামে মাদকতা। জঙ্গলের মাঝে উঁচু করে বানানো ঘর আর আমরা তার বাসিন্দা। জঙ্গলের গন্ধে আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার সুরে বিলাসী হয় সবার অন্তরের বাসনা। আমাদের ওপর ভর করে সেই ঘোর, যার নাম হারিয়ে যাওয়া। জোনাক জ্বলে পথ দেখায় শিষামারা নদীর কূল ধরে আর আমরা খুঁজে চলি নতুন নক্ষত্রের রাজ্য।

যখন রাধার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি নতুন নতুন নক্ষত্রের নাম তখন রিসোর্টের মালিক মিঠুন দা এলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। বললেন চাইলে আমরা জঙ্গলের পথে এগোতে পারি যদি বন্যপ্রাণী দেখার আগ্রহ থাকে। সবাই রাজি হয়ে গেল। শুধু যদি আচমকা কোন ভয়ংকর প্রাণী সামনে এসে পড়ে তাহলে কোন শব্দ না করে রিসোর্টের দিকে দৌড় দিতে হবে। সবার সামনে আমি আর মিঠুন দা পেছনে স্বাতী আর রিসোর্টের একজন কর্মচারী সুবোধ, মাঝখানে অন্যরা। আমি এরকম জঙ্গলে অনেক চড়ে বেড়িয়েছি, তাই অভিজ্ঞতার জন্য এই মুহূর্তে আমার দাম বেড়ে গিয়েছে৷ মাটিতে পা পড়ে না প্রায়।

দাদা টর্চ নিয়েই এসেছিলেন। বৃষ্টির কারণে জঙ্গলের ঘাস ভেজা আর চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকেই চলছে। খানিক এগোই, আরও এগোই। এই রাতে অভিযান চালাই জঙ্গলের বাসিন্দাদের কাছে বন্ধুত্বের দাবিতে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর প্রায় নিরাশ হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুই কি দেখতে পাবো না! যেমন ভাবা তেমনি প্রায় দশ হাত দূরে টর্চের আলোর সামনে এসে পড়ল একটা বাচ্চা লেপার্ড। দাদা চট করে টর্চ নিভিয়ে দিয়েছেন। যা হবার তা ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে। বাচ্চা লেপার্ড জ্বলজ্বলে চোখের নিশানা রেখে দৌড়ে পালাল। এবার আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতার পালা। দাদার কথায় সবাই উল্টো ঘুরে দৌড় শুরু করল। বাচ্চা যেহেতু দেখা গিয়েছে সেহেতু মা লেপার্ডও কাছেই আছে। তিনি যদি মনে করেন যে বাচ্চার ক্ষতি করতে এসেছি আমরা তবে যে কোন একজন বা দু’জনকে এখানেই ধরাশায়ী করবেন।

বক্সা জঙ্গলের পথে

রিসোর্টে এসে একটা কমিটি বসে গেল গবেষণায়, কী দেখলাম তার। আমি নিশ্চিত সেটা বাচ্চা লেপার্ডই ছিল। কারণ আমিই সামনে থেকে দেখেছি। বিড়ালের চেয়ে আকারে একটু বড়। ভিকি এসে বলল, রাতে জেগে থাকলে কটেজের নিচে এক পাল হাতির চলাফেরাও দেখতে পাওয়া যাবে৷ সঙ্গে সঙ্গে সিসি ক্যামেরায় একটা ফুটেজ দেখাল। এ তো বিশাল হাতির পাল ঠিক আমাদের কটেজের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। একারণেই কটেজটা একতলা উঁচু থেকে শুরু হয়েছে। হরিণ তো রাতে খেলতে আসেই, ভাগ্য ভালো থাকলে এক শিং এর গন্ডারও দেখতে পাওয়া যাবে৷

পরদিন সকালেও আমি ছবি তোলার অভিযান থেকে ফাঁকি দিলাম। অবশ্য সকালে উঠেই দেখি রাধা নদীর পাড়ে গিয়ে অন্যপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গন্ডার আর হরিণের ছবি তুলে ফেলেছে। মৌমিতা তুলেছে হরেক রকম পাখির ছবি। আমি দোলনায় দোল খেতে খেতে হৈমন্তীর মিঠে সুরের গল্প শুনি। আর মাঝে মাঝে মাধবীর ছবি তুলে দেই। এরা সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছে। ভোরে একটুও আওয়াজ না করে মৌমিতা যখন ছবি তোলার জন্য বেরিয়ে পড়ে আমি টেরও পাই না। গত রাতে মাধবীর শরীর খারাপ লাগছিল, সম্পা মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম যত্ন শুধু বাড়ির আপনজনই করতে পারে। খাবার টেবিলে যখন বসি তখন মনে হয় ফেলে আসা পরিবার খুঁজে পেয়েছি। একরাশ সবুজের মাঝে আমরা তখন পাখি হয়ে কিচিরমিচির করি।

আজকে আমাদের বাইরে যাওয়া নেই। সারাদিন শিষামারা নদীর জলে ডুবে থাকা। সত্যি সত্যিই। আমি আগে কখনো নদীর জলে সারাদিন ডুবে কাটাইনি, সুইমিং পুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। দরকারি জিনিসপত্র আর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানীয় সঙ্গে নিয়ে আমরা চললাম শিষামারা নদীতে ডুব দিতে। গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতে আমার সবচেয়ে দরকারি জিনিস হল আমার ছাতা। বাংলায় এখন গরমকাল, এই শরত ছুঁতে চাওয়া দিনে যে রোদ উঠেছে তাকে বলা হয় কাঁঠাল-পাকা গরম। এরকম রোদে এক ঘণ্টা থাকলে অবশ্যই আমার মাথা পেকে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

জল দেখতে দূর থেকে সুন্দর, প্রথমে হাঁটুজল তারপর কোমর, তারপর গলা অবধি ডুবিয়ে আমাদের অবকাশ যাপন শুরু হল। মাথার উপরে নীল আকাশ, ওপাশে গাঢ় সবুজ বন, মাঝখানে স্বর্গের কাহিনির মতো এক টুকরো রুপোলি নদীর শীতলতা৷ নদীর নামটাও কোমলতায় ভরপুর, শিষামারা, যেন শিষ দিয়ে কাছে ডাকছে যে কাছে আসতে চায় তাকে।

রাজা ভাত খাওয়া রেলস্টেশন

একেকজনের সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হলে চলে যাওয়া যায় মাঝনদীতে বা কখনো এমনিই কিশোরবেলার মতো জলে দাপাদাপি। সূর্য মাথার উপর থেকে হেলে পড়ার আগে শেষ হল আমাদের জলকেলি। ফিরে টুসুর হাতের অসাধারণ সব বাঙালি আইটেম দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার আড্ডাখানায় জড়ো সবাই।

সন্ধ্যে নামতে না নামতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। খুব ইচ্ছে ছিল এই বনভূমিতে বৃষ্টি দেখা। আসলে গভীর জঙ্গলে বাংলায় আমি সেরকমভাবে প্রবল বরিষন দেখিনি। বাংলার বৃষ্টির ধরন অন্য যে কোন জায়গার থেকে আলাদা, মোহময়, ছন্দময়।  আমার সাধ অপূর্ণ রাখলোনা জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। ঝুম বর্ষা মানে তো উৎসব। যে কোন প্রাণীর চলাচল থামিয়ে দিয়ে নীরব চেয়ে থাকা। মুক্তোর ফোঁটার মতো জল ঝরে পড়ে ধূসর আকাশের মন বেয়ে বেয়ে আর আমি মনের মুক্তো সাজাই একেকটা বৃষ্টিকণা কুড়িয়ে কুড়িয়ে। এরমধ্যেই গরম গরম পাকোড়া আর চায়ে টেবিল ভরে গিয়েছে।

পরদিন আমাদের বিদায় বেলা। এই দলে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছি আমি, সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে, সবচেয়ে বেশি আমাকে সহ্য করেছে আমার বন্ধুরা। চারদিনে আমার চার জীবনের ভালোবাসা পাওয়া হয়ে গিয়েছে। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। সবাই এখান থেকে যাবে কলকাতা, আমার গন্তব্য ভিন্ন, আমি যাব ডুয়ার্স, সেখান থেকে আরও দূরে। তাই সকাল সকাল এক দফা ফটোসেশান শেষ করতে হল৷

এই দলের মতো জীবন নামক উৎসবে যারা মেতে ওঠে তাদের নাম লেখা, তাই নদীর প্রতিটি স্রোতে, জোনাকের পাখায়, বৃষ্টির গন্ধে আর তপ্ত দুপুরে কোন ছায়াদানকারী গাছের মায়ায়। শিষামারা দূর থেকে চুপচাপ দেখে আর মৃদু হাসে। মা সবসময়ই সন্তানের অপূর্ণ আশা পূরণের তাড়ায় থাকে। নদীও তাই। এই বৃহৎ চরাচরও পায়তারা করতে থাকে আমার ভ্রমণ পিপাসা মেটানোর।

আগের পর্ব:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন