ভ্রমণ কাহিনি: শিষামারা নদীর বাঁকে, পর্ব ১

জনমানবহীন জঙ্গল। ক্ষণে ক্ষণে পাখির ডাক, নাম জানা না জানা সব গাছের মদির সবুজ সুবাস, একটু ভেতরে পা বাড়ালেই মিলবে হরিণ, হাতি, গন্ডার বা ব্যাঘ্রের সাক্ষাত।

ফাতিমা জাহানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2021, 03:20 AM
Updated : 26 May 2021, 07:14 AM

সে নিঝুম জঙ্গলকে পাহারা দিয়ে, জল দিয়ে, খাদ্য দিয়ে রক্ষা করে যে মা, তার নাম শিষামারা নদী। আজকে সেই নদীতে উৎসব হতে যাচ্ছে। ভিন গাঁয়ের কয়েকটি পাগল মেয়ে নদীর সঙ্গে কথা কইতে আসবে, বলবে তাদের নিজেদের আনন্দ বেদনা বা আরও একটু বেশি কিছু, কিছু ইচ্ছের কথা বা অনুরাগের কল্পনা। নদীর সে কী আনন্দ! যাদের জন্য আবহমান কাল ধরে অপেক্ষা তারা এল তবে!

আকাশটাও জগতের সব নীল পান করে উপচে দিয়েছে তার রঙ। আজ তার দেবার দিন। বনভূমি নিশ্চুপ, এদিন কাউকে দেখার জন্য উৎসর্গকৃত। নদীর ছন্দে মাতাল রয় সবাই, নদী এনে দেয় একটা নিঃশব্দ দুপুরের কোমলতা। পূর্ণ হয় মনোবাসনা, নদীর কাছে যাবার বা না যাবার যে আকুলতা তা ভাসে শ্রাবণের শেষ বাতাসে। প্রতিধ্বনিত হয় সব পারাপারে। এ ঘোর কাটবার নয়!

কিন্তু ঘোরে থাকলে আমি শিষ দিয়ে ডেকে যাওয়া নদীর গল্প বলব কিভাবে! পৌঁছেছি পরশু, একদল মেয়ে মিলে। আমি সোলো ট্রাভেলার। দলবেঁধে ট্রাভেল করেছি সেই স্কুলে, তারপর স্বাধীনভাবে ট্রাভেলিং শুরু। বন্ধু স্বাতী ট্যুর অর্গানাইজ করে শুধু মেয়েদের জন্য। ছবি দেখি ফেইসবুকে, ভালো লাগে। এবার দেখি ট্যুর হচ্ছে ডুয়ার্সের কাছে আলীপুরদুয়ারের জলদাপাড়া জঙ্গলে, ভাবলাম একা তো অনেক হলো, এবার যাই একটা দলের সঙ্গে।

আমরা মোট আটজন। এক সন্ধ্যায় যাত্রাকালে কলকাতা রেলওয়ে স্টেশনে দেখা হলো একে অপরের সাথে। মাধবী, জয়ন্তী, হৈমন্তি, মৌমিতা, রাধা, স্বাতী, শম্পা কি সুন্দর নাম সবার! আমি যথারীতি হাই, হ্যালো করে নীরব রইলাম। আমি কথা খুব কম বলি। আর এই ট্রিপের পর কে কোথায় যাবে, তাই এত মায়া বাড়িয়ে কি লাভ!

সবাই কলকাতার বাঙালি আর আমি একমাত্র বাংলাদেশি। কলকাতা থেকে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। সবাই নিজ পেশায় সফল, সবার মনের বয়স এক। রাতভর ট্রেন আমাদের বুকে করে নিয়ে চলবে মেঘবাদলের দেশে, এই বর্ষাকালের শেষে। রাতের খাবার স্বাতী বাড়ি থেকে নিজ হাতে তৈরি করে এনেছিল। মেয়েটার যে কী মায়া!

আক্কাস মিয়া ও তার গরু

আমার মনের আগল খোলেনি তখনও। খাবার পর সবাই গল্প করছে আর আমি চুপচাপ নিজের বার্থে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখি বাইরে শিলিগুড়ির চা বাগান। মন ভালো হয়ে গেল। ট্রেনের দরজায় তখন স্বাতী আর রাধা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমিও ঝটাপট দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু ট্রেন এত দুলছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, খোলা দরজা দিয়ে টুপ করে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়েও যেতে পারি নিচের অসাধারণ সুন্দর চা বাগানে। রাধা আমার কোমর ধরল পেছন থেকে আর আমি ছবি তুলছি চা বাগানের, বাংলার সবুজ ধান ক্ষেতের, জলাশয়ের আর অবিশ্বাস্য রকমের গাঢ় নীল আকাশের। আমি এ রূপ তেমনভাবে দেখিনি বড় হবার পর। বেশিরভাগ সময়ই ভারতের অন্য রাজ্যে বা অন্য দেশে ভ্রমণ করি। মায়ের এমন উজাড় করা রূপ দেখে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আপন ফেলে পরের পেছন পেছন কেন ছুটেছিলাম এতকাল!

এসব ভাবছি যখন তখন কার যেন গান ভেসে আসল এই পাহাড়ি বাতাসে। মনের ভুলেই কি তবে শুনেছি, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওগো দয়াময় পাড়ে লয়ে যাও আমায়..’। পাড়ে আমাকে কে নিয়ে যাবে! মনে হয় ভুল শুনেছি। হতেই পারে। যে হারে প্রকৃতির সঙ্গে কথোপকথন চলছে, হতে পারে প্রকৃতিই গাইছে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। পুরোটা ভ্রম নয়। ট্রেনের প্যাসেজে একজন বাউল গেরুয়া বসনে, হাতে দোতারা নিয়ে গাইছেন। জগৎ সংসার পুরোপুরি ত্যাগ করতে না পারলে পাড়ে যাবার ডাকে এমনভাবে সাড়া দেয়া যায় না।

আমাদের গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের আলীপরদুয়ারের ফালাকাটা স্টেশন। বেলা এগারোটার দিকে ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিল। প্যাকেজ ট্যুরের এই এক সুবিধা, ট্রেন হইতে নামিবা মাত্রই গাড়ি হাজির। রেলস্টেশন থেকে রিসোর্টে যাবার পথে বাংলার শ্যামল রূপ যেন উথলে পড়ছে। দিগন্তে মিশে যাওয়া সবুজ ধানক্ষেত, কোথাও জলে নেমে নারীপুরুষ পাটের আঁশ ধুচ্ছেন, কোথাও দূরে দেখা যায় সবুজ পাহাড়, কোথাও আকাশ শুধুই রঙ বদলে আরও নিবিড় হতে চায়।

যে রিসোর্টে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার নাম জলদাপাড়া রাইনো কটেজ, জলদাপাড়া জঙ্গলের একদম ভেতরে। গভীর জঙ্গলের ভেতরে সিমেন্টের মাচার উপরে দোতলা দুটো পাকা কটেজ। কটেজে বনের শোভা আনার জন্য লতানো গাছ দেয়াল বেয়ে উঠেছে, নিচে গাছের ডালে দোলনা আর মাথার উপর গরাই গাছের ছাতি, গাছে পাখির সুর। কান পাতলে পাখির পাখা ঝাপটানোর আওয়াজও পাওয়া যায়। আর গাছের ঠাস বুননে এই দিনের বেলায়ও আবেশে আধার করে আসে।

রুমের দেয়ালে বাঁশ দিয়ে তৈরি ডেকোরেশন আর দেয়ালে ঝুলছে শীতল পাটির পর্দা। আরেকটু দূরে একতলা ডাইনিং হল। চেয়ার টেবিল সব গাছের গুড়ি কেটে তৈরি করা। বিশাল এলাকাজুড়ে কটেজ, এই জঙ্গলের সবটাই যেন নিজের। পৌঁছে নিজেদের রুম বুঝে নিলাম। শুরু হলো আমাদের আশপাশের নদী আর জঙ্গল অভিযান।

এই দলে আমরা বেশিরভাগই সমবয়সী, তার চেয়েও বড় কথা সমমনা। এরকম দলে ঠাঁই পাবার জন্য কতই না পাহাড় পর্বত, সাগর পেরিয়েছি কিন্তু মনমতো বন্ধু পাইনি। সবাই স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা, অন্যের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়, সম্মান করে, একেবারেই জাজমেন্টাল নয়, অপরের জন্য এক আকাশ ভালোবাসা বরাদ্দ করা আছে নিঃসার্থভাবে। যারা ভালোবাসা দিতে এবং পেতে জানে তারা কি আমার বন্ধু না হয়ে পারে!

ভেবেছিলাম যাচ্ছি একটা দলের সঙ্গে, ঘুরেফিরে এসে আবার নিজ শহরে ফিরে নিজের কাজে মনোযোগ দেব। এই বিশাল পৃথিবীতে কে বা কাকে মনে রাখে!

কিন্তু এই অল্প সময়ে সবাই সবার আপন হয়ে গেল। যেন আমার বোর্ডিং স্কুল জীবন ফিরে এসেছে। সবাই সবার জন্য ব্যাকুল, অন্যদের কিভাবে যত্ন করা যায় তাতেই ব্যস্ত। আমি আলাভোলা মানুষ, নিজের খবরই রাখি না, অন্যদের কি রাখব।

শিষামারা নদীর তীরে

পোশাক বদলে নিচে নেমে দেখি অন্যরা আসেনি। রিসোর্টের কেয়ারটেকার কাম কুক কাম সর্বেসর্বা যিনি, তার নাম টুসু। বাচ্চা একটা মেয়ে, বয়স ২৩ এর বেশি নয়। বেশ এক হাতে সামলাচ্ছে আমাদের। আসতে না আসতেই এত লোককে আপ্যায়ন তারপর খাবারের আয়োজন।

আমি ইতিউতি দেখে দোলনায় দোল খেতে খেতে দেখি আমাদের দল শিষামারা নদীর দিকে যাচ্ছে। আমাকেও ডেকে নিল৷ রিসোর্টের বারান্দা দিয়ে নদীর বাঁক সহ অনেকখানি দেখা যায়। কিন্তু এ যেনতেন নদী নয়, সাক্ষাত মা। সবাই সারি বেঁধে নদীর তীরে উঁচু জমিতে ঘাসের চাদরে বসে পড়ল। আমি একজনকেও পাত্তা না দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম নদীর আরও কাছে। এখন ভাটার টান। কাদা, জল দেখেই বোঝা যায়। নদীর দু’পাশেই জঙ্গল। আমি তীর ধরে হাঁটি, ভাবি কেন বাংলায় আসিনি আগে, এই যে জাদু, তা তো অন্য কোথাও নেই।

এই যে নদীর আলাদা গন্ধ তা এমন তীব্রভাবে কোথাও পাইনি, দূরে পাহাড় সেও কেমন যেন মন ভরিয়ে দেয়া। আমি প্রায় জঙ্গলে ঢুকেই গিয়েছি আর দল থেকেও অনেক দূরে চলে এসেছি। স্বাতী চিৎকারে ভাবনায় ছেদ পড়ল, ‘ফাতিমা আর যাসনে, ওদিকে চোরাবালি থাকতে পারে, বাঘও আছে।’

আমি একজন দলছুট, বেয়াড়া মানুষ। যতক্ষণ মন চাইল ঘুরেফিরে এলাম নদীর জলের কাছাকাছি থেকে, তাকে স্পর্শ করে৷ নদীর তীরে তখন গরু বাছুর চড়াতে এসেছেন চাষী, সঙ্গে মেয়ে। মাথায় গামছা, গায়ে হাফহাতা গেঞ্জি, লুঙ্গি পরিহিত৷ দেখেই আমার মনে হলো ‘গফুর’। গল্প করলাম কিছুক্ষণ। নাম তার আক্কাস মিয়া। কাছের গাঁয়ে ঘর, কৃষিকাজ করেন। আমি আরও দূরের পানে চেয়ে দেখি নদী ডাকছে, এদিকে বন্ধুরাও অনেকটা সময় ধরে অপেক্ষায় বসে আছে ওপাশে৷ আমার এই নিষ্ঠুর আচরণে দলের সবাই যেন আরও কাছে টেনে নিল। একসঙ্গে ফিরলাম ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খেতে।

খাবার তো নয় যেন রাজভোজ। বহু বছর পর এমন ঘরোয়া বাঙালি খাবার পেলাম, তাও আবার এতগুলো পদ একসঙ্গে। খেতে খেতে, গল্প করতে করতে বিকেল হতে চলল। এই বনভূমি এতোটাই নির্জন যে এখানে নিজেদের পায়ের আওয়াজও শুনতে পাওয়া যায়। চারদিকে শুধুই সবুজ, মাথার উপরে বিশাল বিশাল গাছের অট্টালিকার মতো ছায়া, ডানে বায়ে সবখানেই গাছের মায়া। আমার বনভূমি সম্পর্কে নিজস্ব একটা ধারণা আছে, সন্ধ্যে নামলেই গাছেরা কথা বলতে শুরু করে আর দিনের বেলায় শুধু আমার কথা শোনে। আমি গাছপালার মাঝে বড় হয়েছি। বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি বিস্তর। গাছের কথা আমি শুনতে পাই।

কটেজের বারান্দা থেকে শিষামারা নদীর আশপাশ কমলা থেকে নরম গোলাপি হয়ে আসে। খানিক পরে নীলাভ ধূসর। আর এর পরেই এইসব গাছ আর বনপাখিদের মাঝে হট্টগোল করা মেয়েরা ভীষণ রঙিন পাখা মেলে ধরে, নিজেদের আনন্দ-বেদনা, উল্লাস-উদযাপন যেন সব বলা চাই এই মুহূর্তে। আমিও আর চুপচাপ থাকার অবকাশ পেলাম না। হৈ-হুল্লোড় দেখে গাছেরাও মিটিমিটি হেসে উঠে, আর আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি রাতের গায়ে।

রাতের খাবারের সময় খেয়াল করলাম একটা বাচ্চা ছেলে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। ও নাকি টুসুর বর, নাম ভিকি। কী আশ্চর্য এইটুকু মেয়ের আবার বর! ওদের একটা মেয়েও আছে, টুসুর মায়ের কাছে থাকে।

রিসোর্টের একাংশ

রাতে যে আকাশজুড়ে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে চুলের বাঁধন এলিয়ে পড়ে থাকে আকাশের আঙিনায় তা এমন স্বচ্ছ রাত না হলে জানতেই পারতাম না। কটেজ থেকে এগিয়ে শিষামারার বাঁকে দাঁড়ালে আকাশ কথা বলা শুরু করে। আমাদের মাঝে রাধা হলো চাঁদতারা বিশেষজ্ঞ। আমি এসব কিছুই বুঝি না। গ্যালাক্সিকে মিল্কিওয়ে আর সপ্তর্ষিকে আকাশগঙ্গা নামে অনায়াসে চালিয়ে দেবার মতো বোকামি করে বসি। আমি শুধু দেখি তারাদের রূপ। এত লক্ষ কোটি তারা যে দেখে মনে হয় রাতের আকাশ চকমকি চুমকি পাথর হয়ে মৃদু আলো জ্বেলে রেখেছে। থোকায় থোকায় ফুটে ওঠে তারাদের ফুল, কখনো মনে হয় বসন্তদিনের ফুলতলা, কখনো বা গাছের শাখা জুড়ে থাকা উদাস বেলা। এত তারা, এত ঐশ্বর্য কখনোই অন্য কোন আকাশের কোল আমাকে দেখায়নি।

মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে তারা দেখার ইচ্ছে প্রবল, কিন্তু দলের সঙ্গে চলে যেতে হলো। জঙ্গলে বাঘ, হাতি, গন্ডার আছে। তাই বিপদজনক৷

দুটো আলাদা কটেজে আটজনের থাকার ব্যবস্থা, তবু মনে হয় যেন একটি কটেজেই গাদাগাদি করে সবাই থেকে যাই। কারণ এখনও রাত অনেক বাকি, এখনই কথার ফুল ফুটে সুবাস ছড়াচ্ছে। আমাদের কটেজের দোতলায় এক রুমে স্বাতী আর রাধা, অন্য রুমে আমি আর মৌমিতা। এত মিষ্টি মেয়ে মৌমিতা, আমার মতো অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে থেকে একটুও বিরক্ত হয়নি। কটেজের তিনতলাটা ছাদের আড়ালে চারপাশে পুরোটাই খোলা। এখানে বসে, দাঁড়িয়ে বনের গভীরে চোখে আবেশ আনা যায়। অন্য কটেজের এক রুমে মাধবী আর সম্পা। অন্য রুমে জয়ন্তী, হৈমন্তি, ওরা দুই বোন।

চলবে...

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন