ইয়েমেনের রাত ও সাহস যাচাই

২০২০ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝির দিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ইয়েমেনের এক গ্রামে। আমার দুই দিনের ঝটিকা ভ্রমণে মজার এবং ভয়ের কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, আজকের লেখায় সেটাই পাঠকের কাছে তুলে ধরবো।

নুসরাত শাহীন, ইয়েমেন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2021, 06:32 PM
Updated : 30 March 2021, 06:32 PM

আমাদের গন্তব্য ছিল ব্যাজিল নামের প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো ছবির মতোই সুন্দর একটা গ্রাম। গ্রামের একপাশে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি ঝরনা, ছোট-বড় পাহাড় আর হরেকরকমের বাগান সব মিলিয়ে ছিল অপূর্ব পরিবেশ। খুবই আনন্দদায়ক ছিল ভ্রমণটা। ১৪ জনের একটি দলের অংশ হয়ে আমরা তিন বান্ধবী রওনা দিয়েছিলাম। আমার সফর সঙ্গী পাকিস্তানি ও ইয়েমেনি বান্ধবীর কাছে পুরো ভ্রমণটা ক্লান্তিকর লেগেছে।

সকালে রওনা দিয়েছিলাম, রাত ৯টা গিয়ে পৌঁছেছি। মাঝখানে সকাল আর বিকালের চা-পান বিরতি, দুপুরের খাবার আর টয়লেটে যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় হয়েছে। প্রায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমাদের গাড়ি মেইনরোড থেকে গ্রামের কাচা রাস্তার দিকে টার্ন নেয়। সেদিন ছিল ভরা জ্যোৎস্না তাই চারপাশের সব কিছু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। রাস্তার দুই পাশে ছিল গমের ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝখানে দুই-তিন হাত দূরত্বে বেশ বড় বড় আম গাছ! আমাদের গাড়ি মেঠোপথের ধূলো উড়িয়ে যখন ফার্ম হাউসের উঠোনে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৯টা ছুঁইছুঁই।

আমাদেরকে দেখে বাড়ির তিন কেয়ারটেকার যেন একটু অবাক হলো, অথচ তাদেরকে একদিন আগেই আমাদের যাওয়ার ব্যাপারে জানিয়ে রাখা হয়েছিল।

এখানে ইয়েমেনিদের সম্পর্কে আমি একটু বলে রাখি। সেটা হচ্ছে সবকিছুতেই তারা- ‘আল্লাহ তাওক্কাল’, অর্থাৎ যখন সময় আসবে , তখন দেখা যাবে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা খুব উদাসীন। আপনি তাদেরকে কোনও দায়িত্ব দিয়ে যদি সেটা সময়মত ফলোআপ না করেন তাহলে কাজটা আপনার ভেস্তে গেল আর কি। তবে মানুষ হিসেবে তারা একেবারে খুব ভালো। সেটা নিয়ে না-হয় অন্য আরেকদিন লিখবো।

তিনজন কেয়ারটেকার আমাদের সামনে কিছুটা লজ্জিত হয়ে আধঘণ্টা সময় চেয়ে নিল, কক্ষগুলো পরিষ্কারের জন্য। ততক্ষণে তাদের ব্যবস্থায় উঠোনে বিছিয়ে দেওয়া চেয়ারে আমি শরীর এলিয়ে দিলাম। বাকিরা এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে খামারবাড়িটা দেখছে। ঘরদোর পরিষ্কার হলো, সৌর বিদ্যুতের সৌজন্যে রুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। দোতলা বাড়ির নিচের অংশে বেড রুম ছিল তিনটা। আমরা নারী আর পুরুষরা আলাদা হয়ে তিনটা রুম ভাগাভাগি করে নিলাম! টয়লেট ছিল মাত্র একটা, তাই লম্বা লাইনে আমার সুযোগ আসতে তখন রাত ১০টার বেশি বেজে গেল। ফ্রেশ হয়ে ওজু করে সব কাজা নামাজ শেষ করে বসে গেলাম ডিনারে। রাতের খাবার আমরা ঘর থেকেই তৈরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভাগে পড়েছিল চিকেনের যেকোন,ও আইটেম, একজনের ভাগে সবজি, আরেকজনের ভাগে রাইস। আমি চিকেন কড়াই মসলা রান্না করে নিয়েছিলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া পোর্টেবল গ্যাসের চুলোতে গরম করে নিলাম। রাত প্রায় তখন পৌনে ১১টায় আমাদের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো।

খাওয়া শেষে যে যার মতো করে সময় পার করছে, আমি আমার দুই বান্ধবীকে বললাম- চল আমরা বাহিরে একটু হেঁটে আসি। দুইজনই অসম্মতি জানালো! এতোটাই টায়ার্ড ছিল যে তাদের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আর আমারও তাদের বিরস আলাপ শুনতে ভালো লাগছিল না! এমন পরিবেশ পেয়ে আমি ঘরে বসে থাকার মানুষও না। তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি নিজেই বের হয়ে গেলাম আমার দস্যিপনায় মাততে।

রাত ১১টা, কানে আমার ইয়ারফোন লাগানো মোবাইলে বাজছে প্রিয় গানটা।

আমি হাঁটছি আর বাড়ির চারপাশটা ঘুরেঘুরে দেখছি। বাড়ির এক কোণায় পাঁচিল ঘেষে বিশাল এ একটা আম গাছ। গাছের আকৃতিটাই এমন যে দূর থেকে দেখে মনে হয় বিশাল এক দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গাছের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম। হ

ঠাৎ আমার শরীরটা কেমন যেন ছমছম করে উঠলো। হালকা একটা ঝাঁকি খেলাম, হাতের লোমকূপগুলো দাঁড়িয়ে গেল। বুঝলাম না ভয় পেয়েছি, নাকি মনের অজান্তেই এমন হলো। যাই হোক, আমি শান্তই ছিলাম। খুব ধীরে আস্তে আস্তে পা ফেলে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

মাথার উপরে বিশাল চাঁদটাই আমার একমাত্র ভরসা। আর সঙ্গী ছিল নিজের ছায়া। আমি হাঁটছি তো হাঁটছি, কোনও খেয়াল নেই। কেউ যেন আমাকে মন্ত্র পড়ে সম্মোহিত করে ফেলেছে। জ্যোৎস্না রাত নিয়ে কমবেশি প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা রোমান্টিকতা কাজ করে। তবে আমার উপর মনে হয় একটু বেশিই পাগলামো ভর করে। তাই বলে ভাববেন না আমি লুনাটিক।

এটা আমার সাথে তখনই হয় যখন আমি জগৎ সংসার ভুলে সম্পূর্ণ ওই পরিবেশের মধ্যে ডুবে যাই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন গান, কুয়াশা ভেজা গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ, হালকা মিষ্টি বাতাস... আহ্ সব মিলিয়ে পরিবেশটা ছিল দারুণ। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার নাকের ডগা ছুঁয়ে কিছু একটা সাঁই করে উড়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়ে,পাত্তা না দিয়ে আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। আবার আরেক পাশ থেকে একই ব্যাপার ঘটলো। এবার একটু ভয় পেলাম। নিজেই নিজেকে বলে উঠলাম, কি ছিলোরে নুসরাত?

এ রহস্যের সমাধান করার জন্য আমার মধ্যে একটা জেদ চেপে বসলো। তবে চাঁদের আলোতে সেটা সম্ভবও না। আর মোবাইলের ক্ষীণ আলোতে তো একবারেই না। দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম কী করা যায়! ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম ফার্মহাউসে গিয়ে লাইট নিয়ে আসবো। এই বয়সে এসেও নিজেকে তিন গোয়েন্দার কোন ক্যারেক্টার ভেবে ভেতরে ভেতরে একটা ফ্যান্টাসি কাজ করছিল।

যেই ভাবা সেই কাজ, অনেকদূর হেঁটে আবার ফার্মহাউসে গিয়ে আমার ইয়েমেনি বান্ধবীর কাছ থেকে লাইট ধার করলাম। কপালে লাইট-টা লাগিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ঠিক একই জায়গায় এসে যখন দাঁড়ালাম দেখলাম বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বাঁদুড় এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে।

ফার্মহাউসে ফিরে এসে বান্ধবীদের কাছে পুরো ঘটনা যখন বয়ান করলাম, তখন ওরা তো আমার সাহস দেখে শিউরে উঠল। আমার ইয়েমেনি বান্ধবীর খুব রাগ হলো আমার উপর।

- তোর এমনটি করা মোটেও ঠিক হয়নি। বুঝলাম তুই অনেক সাহসী কিন্তু যদি হায়েনা আসতো।

- জীবনকে উপভোগ করার জন্য সাহস লাগে হাবিবী, আমি তাকে আরবীতে বললাম।

আমার এ উত্তরে সে আরো রেগে গেল।

যা-ই হোক তার কাছ থেকে ওইদিন জানতে পারলাম মাঝরাতে কখনো কখনো সেখানে হায়েনাদের আনাগোনা থাকে। তবে আমার কাছে মনে হলো শেয়ালকেই তারা হায়েনা ভাবে হয়তো।

কথা প্রসঙ্গে আমার ইয়েমেনি বান্ধবী এবার বলা শুরু করলো তার জীবনে প্রথম জ্বিন দেখার ঘটনা। তবে সে গল্প না-হয় অন্য আরেকদিন শোনাবো।

লেখক: ন্যাচার ফটোগ্রাফার

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!