সুইজারল্যাণ্ড প্রবাসীর চিঠি: আর কোন স্বপ্ন যেন কফিনে বন্দি না হয়

ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘আবিরনকে হত্যার দায়ে সৌদী গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড’

তাহমিনা খাতুন, সুইজার‌ল্যান্ডের জেনিভা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2021, 06:40 PM
Updated : 1 March 2021, 06:40 PM

শিরোনামে এক খবর প্রকাশ হয়। ওই খবরের সূত্র ধরেই এ লেখাটি শুরু করছি।

খবরে বলা হয়, আবিরন বেগম হত্যা মামলায় সৌদি আরবের গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে বাসার কর্তা বাসেম সালেমকে ৩ বছর ২ মাস কারাদণ্ড  এবং ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হয়েছে এবং ওই দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেমকে সাত মাস কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।”

খবরটিতে আরও বলা হয়েছে, খুলনার আবিরন বেগমের সন্তান না হওয়ার অপরাধে বিশ বছর আগে স্বামী তাড়িয়ে দিলে তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। আবিরন বোনদের লেখা-পড়া ও পিতার পরিবারে স্বচ্ছলতা এনে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সরকারিভাবে সৌদি আরবে যান। দুই বছর তিন মাস পর ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ভোরে কফিনে মুড়ে আবিরনের লাশ দেশে আসে। সৌদী আরবের যে বাসায় আবিরন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন সেই বাসার গৃহকর্ত্রীসহ অন্যদের চরম নির্যাতনের শিকার হন আবিরন। তাকে পিটিয়ে, গায়ে গরম পানি ঢেলে, খাবার না দিয়ে নির্যাতন করা হতো। আবিরনের পরিবারের দাবি তাকে যৌন নির্যাতনও করা হতো এবং দুই বছর তিন মাসে তার পরিবার আবিরনের বেতন বাবদ মাত্র ১৬ হাজার টাকা পেয়েছে। বেতনের বাকি অর্থ দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে।

সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, জর্ডান, ওমান তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলিতে গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতন, হত্যার শিকার হওয়া, নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা নতুন কিছু নয় অথবা আবিরনই প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়। আবিরনের তো রীতিমত সৌভাগ্য বলতে হয়, কারণ তার পরিবার অন্তত একটা বিচার পেয়েছে এবং তার প্রতি অন্যায়কারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। বেশিরভাগ ‘আবিরন’দের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে গুমড়ে কেঁদে মরে। নাজমা, কুলসুম, পারভিন আক্তার আরও কত অসংখ্য নাম যাদের স্বপ্ন কফিনবন্দি হয়েছে। তাদের অপরাধ তারা গরীবের ঘরে জন্মেছে, তাদের অপরাধ তারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছে এবং তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ তারা মেয়ে হয়ে জন্মেছে।

আরেকটি জাতীয় দৈনিকের ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের খবর ‘প্রবাসে ৪ বছরে ৪১০ নারীর মৃত্যু’ শিরোনামে খবর রীতিমত শঙ্কা ও ভয় ধরিয়ে দেয়। যে পরিবারের মেয়ে, বোন বা মা বিদেশ বিভুঁইয়ে নারকীয় ঘটনার শিকার হয়ে ‘কফিন বন্দি’ হয়ে দেশে ফেরেন, তাদের পরিবারের মর্মবিদারী কান্না একদিকে যেমন সৌদী আরবের ধনকুবেরের মর্মর পাথরের দেয়াল ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না তেমনি যে সব হতভাগা নারী একটু খানি স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ওই সব ধনকুবেরের প্রাসাদোপম ‘খাঁচায়’ প্রবেশ করে তাদের জীবনের করুণ কাহিনী এবং আর্তচিৎকার ও পাথরের কঠিন দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। ওইসব হতভাগিনীদের অনেকের জীবনই পাষাণ, পাথরের দেয়ালের অভ্যন্তরে অত্যাচার, নিপীড়ণেই শেষ হয়, নয়তো ‘খাঁচার’ বন্দি জীবন থেকে পালাতে গিয়ে তারা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়!

ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন নারী গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেছে, অথচ দুঃখজনকভাবে গৃহকর্মীদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ তা অব্যাহত রেখেছে। আবিরন সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই সৌদি আরবে গিয়েছিল। সরকারী ব্যবস্থাপনাতে গিয়েও আবিরনকে লাশ হয়েই দেশে ফিরতে হয়েছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনাতেও যদি একজন নারীকে কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফিরতে হয়, তবে বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে যারা গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যায় তাদের করুণ অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার কারণেই হয়তো আবিরনের লাশে মৃত্যুর ধরনে ‘হত্যা’ বা ‘মার্ডার’ শব্দটি  লেখা ছিল এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের আন্তরিকতা এবং ব্যাপক তৎপরতায় হত্যা মামলাটি সৌদী আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু অনেক মৃতদেহে মৃত্যুর ধরনে ‘আত্মহত্যা’ লেখা থাকে এবং ‘আত্মহত্যা’ লেখা থাকার কারণে হয়তো তাদের পক্ষ হয়ে কেউ আদালত পর্যন্ত যেতে পারেনা।

একজন হতদরিদ্র, নিরক্ষর মানুষ, যে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা জগতে পাড়ি জমানোর মতো ঝুঁকি নেয়, সে কেন স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নিবে? অত্যাচার, নির্যাতনের মাত্রা কতটা ভয়ঙ্কর হলে একজন মানুষ উপায়ন্তরহীন হয়ে ‘আত্মহত্যার’ মাধ্যমে মুক্তির উপায় খোঁজে, তা সহজেই অনুমেয়। নৃশংস নির্যাতনের মাধ্যমে ‘হত্যার’ কারণে এবং সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সংবাদমাধ্যম ও ব্র্যাকের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে পাষণ্ড সৌদি গৃহকর্ত্রী, তার স্বামী ও তাদের ছেলেকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং আবিরনের পরিবার বিচার পেয়েছে। কিন্তু আরও অসংখ্য আবিরন ও তাদের পরিবার বিচার না পেয়ে কেঁদে ফিরছে, কারা তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তা খুঁজে বের করা এবং এসব মানবরূপী হৃদয়হীন পাষণ্ডদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং কঠোর, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

অনেক সময়ই বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার নারীরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের শিকার হয়ে পাশবিক, শারিরীক, মানসিক ও আর্থিক শোষণ, নির্যাতনের শিকার হন এবং শেষ পর্যন্ত তারা লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। ওই সমস্ত রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধেও জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

আরও একটি খবরে বলা হয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কেবল সৌদি আরব থেকেই লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন ১৩১ জন নারী গৃহকর্মী। সাধারণত হতদরিদ্র পরিবারের নারীরাই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশেগুলোতে যান এবং তাদের মানবেতর জীবনের বিনিময়ে এবং শ্রম,ঘাম আর কষ্টে  অর্জন করে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অগ্রগতিতে অনেক বড় অবদান রাখে। দেশের অগ্রযাত্রায় বিশাল ভূমিকা রাখা এসব নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ‘কফিনবন্দি’ হয়ে দেশে ফেরত আসা একদিকে যেমন হৃদয়বিদারক, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য, অন্যদিকে এ ধরনের ঘটনাগুলো বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নারী গৃহকর্মীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যা সারা দুনিয়াকে এ বার্তাই দেয়- মানুষের জীবন নয়, বরং তাদের জীবনের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই মুখ্য- এ অবস্থা চলা উচিত নয়। এ বিষয়ে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে ততই মঙ্গল।

লেখক: আইনজীবী, প্রাক্তন উপপরিচালক বিএনডব্লিউএলএ

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!