ভ্রমণ কাহিনি: ডালাসের পাখি জুড়াবে আঁখি

গত মধ্য নভেম্বরে গিয়েছিলাম পাখি দেখতে। মহামারীর প্রকোপে কাবু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মাস্ক, স্যানিটাইজার ও প্রয়োজনীয় সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে রওনা হলাম ‘হাজারম্যান ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ রিফিউজি’ এর উদ্দেশ্যে।

ফাহমিদা পারভীন, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2021, 06:49 AM
Updated : 5 Jan 2021, 05:14 PM

আমাদের ডালাস শহর থেকে ২ ঘণ্টা ড্রাইভ। ছেলেকে বললাম অফ রোড দিয়ে যেতে। শহরের ব্যস্ত সড়ক পার হয়ে গ্রাম্য পথ শুরু হোলো। ডালাসের বিশাল আকাশ, বিস্তীর্ণ ভূমি ও বন। গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশে মেঘের খেলা দেখতে লাগলাম। একভাবে তাকিয়ে থাকলে আকাশের গায়ে যেন নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে ইচ্ছেমতো ছবি আঁকা যায়।

রাস্তার পাশের বনগুলোতে নাম না জানা অজস্র ছোট-বড়-মাঝারি গাছ। এই গাছগুলোর মধ্যে আমার দেশের আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারিকে খুঁজি। এক একটা গাছকে হঠাৎ আমগাছ ভাবতে ইচ্ছে করে! গাছের পাতাগুলো কোনটা ধূসর হয়ে, কোনোটা হলুদ হয়ে শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। শরতে গাছের পাতা আগুন ঝরানো লাল রং ধারণ করে। কি যে অপূর্ব দৃশ্য!

তীর বেগে ছুটে চলছে গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে একরের পর একর জমি। আমাদের দেশের মতো এসব জমির মধ্যে কোন আইল নেই। কোন জমি একশ একর, কোনটা দুশো, কোনটা আবার তিনশ ছাড়িয়েছে। কিছু জমিতে বিক্রির জন্যে ‘ফর সেইল’ লিখা। ছেলে মজা করে বললো কিনবা নাকি মা? শুনেছি

ছবি: মো. জাহিদ হোসেইন

টেক্সাসে নাকি কৃষিজমির ট্যাক্স নেই। কে জানে, ইচ্ছে আর সামর্থ্য এক না হওয়া পর্যন্ত হয়তো জানতেও পারবো না। যেতে যেতে কিছু র‍্যাঞ্চও দেখলাম। স্বাস্থ্যবান গরু, ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে, মনের সুখে খাচ্ছে। কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা, কাঠের গেটে লিখা তাদের নাম। সে যে কি সুন্দর দেখতে! কি যে বিশালতা সেগুলোর!

যাওয়ার পথে অল্প কয়েকটি বাড়ি নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম দেখছি। সেসব গ্রামে গির্জা, স্কুল, পেট্রল পাম্প, গ্রোসারি শপ, কারখানা, ডাক্তার সবই আছে। কোথাও ভুট্টা ক্ষেত, কোথাও খড় প্যাচিয়ে রোল করা। বাড়িগুলো সব কাঠের। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকার মতো চমৎকার সব বাড়ি। বাড়ির মালিক নিজের মনের সব সৌন্দর্য ঢেলে বাড়ির ভেতর বাহির সাজিয়েছেন। ফুল, মূর্তি, আরও কত কি!

কিছু বাড়ির সামনে ট্রাক, কার বা জিপের পাশাপাশি আরভি বা ক্যাম্পারও রাখা আছে। এসব আরভিতে বেড, কিচেন, বাথরুম সবই থাকে। যে কোন ছুটি-ছাটায় পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়। হোটেল বা রেস্তোরাঁর প্রয়োজন নেই।

তবে প্রয়োজন হলে খোলা জনশূন্য প্রান্তরেও সব প্রকার দোকান আছে। সেখানে আইসক্রিম, জুস, মিল্কশেক এর দোকান ‘সনিক’ দেখতে পেলাম। লম্বা পথ গাড়ি চালানোর পর ক্লান্ত যাত্রীদের জন্য কিছুক্ষণ পরপরই বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা করে দেওয়া। পথ হারানোর গল্প এখানে রূপকথার মতই।

ছবি: মো. জাহিদ হোসেইন

এভাবে দেখতে দেখতে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বিশাল লেকের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দলগতভাবে সাদা-কালো অজস্র পাখির কলকাকলি। বেশির ভাগ কানাডাগুস প্রকৃতির পাখি। লেকটাকে যেন গাড়ির পেট্রল-পাম্পের মতই বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা করে ফেলেছে তারা। অনেকক্ষণ বসে থাকা একদল পাখি হঠাৎ ওড়া শুরু করলো।

সে কি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা তাদের মধ্যে! কোন দল মালার মত উড়ছে, কোন দল সার বেঁধে লাইন দিয়ে উড়ছে। দলের বাকি সবাই দলনেতাকে অনুসরণ করছে। কেউ কেউ তারে বসে আছে নিজস্ব দূরত্ব মেনে, মনে হচ্ছে মহামারী বুঝতে পেরে ছয় ফিট দূরত্ব বজিয়ে রেখেছে। ভাবলে অবাক লাগে সৃষ্টিকর্তার কি চমৎকার বিধান। পাখিরা মানে, আমরা মানুষ হয়েও মানি না।

সন্ধ্যে নেমে আসছিল। পাখিরা দল বেঁধে উড়ে চলে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যের দিকে। একদল উড়ে গেলে আরেক দল উড়ছে। মনে হচ্ছিলো অ্যায়ারপোর্টের মতো এদেরও বোধ হয় এসব নীতিমালা মেনে চলতেই হবে। কলকল, প্যাকপ্যাক ধ্বনিতে মুখরিত পুরো এলাকা। অসম্ভব রকমের এক ভালো লাগা নিয়ে আমরাও তাদের মতো বাড়ির পথ ধরলাম। সব পাখিকেই ঘরে ফিরতে হয়।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!