পারস্যের টিউলিপে পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধি

টিউলিপ, অনিন্দ্য সুন্দর একটি ফুল। রং, রূপ আর আকৃতির কারণে টিউলিপ পৃথিবীর সেরা কয়েকটি ফুলের মধ্যে অন্যতম।

মোমিনুল আজম, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2020, 04:48 AM
Updated : 9 Nov 2020, 04:48 AM

শীতপ্রধান দেশে বসন্তের ফুল টিউলিপ। এটি সবসময় প্রস্ফুটিত অবস্থায় থাকে না। সূর্যের আলোয় নিজেকে মেলে ধরলেও আলো চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিউলিপ নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অবগুন্ঠনের প্রতি মানুষের সহজাত একটি আকর্ষণ আছে। এ কারণে টিউলিপের আবেদন সম্ভবত আরও বেশি।

টিউলিপের আদি বাসস্থান পারস্যে। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সম্রাজ্যের সুলতানদের সময় তুরস্ক ও ইরানে টিউলিপের চাষ বিস্তার লাভ করে। তখন মূলত অভিজাত এবং রাজ পরিবারের সদস্যরা এ ফুলের চাষ করতো। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ ও নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ ছড়িয়ে পড়ে।

১৫৯০ সালে ক্যারোলাস ক্লুসিয়াস  ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন উদ্যান ‘হর্টাস বোটানিকাস’ এর ডাইরেক্টর নিয়োজিত হন। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তখন কনসট্যান্টিনোপলের (বর্তমানের ইস্তানবুল) রাষ্ট্রদূত। রাজপ্রাসাদের টিউলিপ দেখে চমৎকৃত হয়ে তিনি এর কিছু বাল্ব পাঠিয়ে দেন তার বন্ধু ক্লুসিয়াসের কাছে। আজ যে আমরা দেখি সারা বিশ্বে টিউলিপ ফুল আর এর বাল্ব বিক্রিতে নেদারল্যান্ডসের জয়জয়াকার তা শুরু হয়েছিল ক্যারোলাস ক্লুসিয়াসের হাত দিয়ে।

নেদারল্যাল্ডসের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই ফুল এবং এর বাল্ব। প্রতি বছর মার্চে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী তাদের টিউলিপ বিক্রি। প্রতিদিন তারা বিক্রি করে ৩০ মিলিয়ন টিউলিপ ফুল। আট সপ্তাবব্যাপী এই ফুল বিক্রি করে আয় করে ৭ বিলিয়ন ইউরো। এছাড়া দেশটির আয়ের একটি বড় অংশ আসে টিউলিপ বাল্ব বিক্রি করে। বছরে তারা প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন বিভিন্ন ধরনের বাল্ব উৎপন্ন করে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করে।

আমস্টারডামের কোকেনহফ টিউলিপ বাগান বিশ্বসেরা। প্রতি বছর বিশ্বের ১.৫ মিলিয়ন পর্যটক দর্শনীর বিনিময়ে এই টিউলিপ বাগান পরিদর্শন করে। যে পারস্য ছিলো টিউলিপের উৎপত্তিস্থল তারাও এর ধারে কাছে নেই। বিশ্বব্যাপী টিউলিপ নিয়ে যে মাতামাতি তার অনেকটাই নেদারল্যান্ডসে।

প্রায় বেশিরভাগ ফুলের সঙ্গে গ্রিক মিথলজি জড়িত, টিউলিপের ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে পার্সিয়ান মিথলজি। ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে ফরহাদ নামের এক তরুণ প্রেমে পড়ে শিরিন নামক এক রাজকন্যার। শিরিনের পিতা অবস্থা বেগতিক দেখে এক শর্ত আরোপ করে। যদি সে পাহাড়ের পাথর কেটে সিঁড়ি তৈরি করতে পারে তবেই সে পাবে শিরিনকে।

রাজকন্যার বাবা জানতেন কাজটি অসাধ্য। ভালোবাসার তেজে বলিয়ান হয়ে যুবক সিঁড়ি তৈরির কাজে লেগে যায়। বহু পরিশ্রমে সে কাজটি যখন শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসে শিরিনের পিতা পড়ে যায় বিপাকে। তখন তিনি কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ফরহাদের কাছে খবর পাঠায়, শিরি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এমন খবরে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ফরহাদ। নিজের ভালবাসার মানুষকে না পেয়ে নিজের কুঠার দিয়ে আত্মহত্যা করে সে পড়ে যায় পাহাড় থেকে নিচে।

এ খবর শুনে শিরিন রাজপ্রাসাদের বেড়াজাল ভেঙে চলে আসে সে পাহাড়ে। সেও পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে ফরহাদের পাশে নিজেকে উৎসর্গ করে। তাদের মিলিত রক্ত মাটিতে মিশে গিয়ে ফোটে লাল টিউলিপ। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী যে ‘শাহনামা’ রচনা করেছিলেন সেখানেও এ কাহিনি বর্ননা করা আছে। শিরিন এবং ফরহাদের এ কাহিনি অজস্রভাবে বর্ণিত যা একটার থেকে আরেকটা ভিন্ন। তবে ভালবাসার আত্মত্যাগের ফসল যে লাল টিউলিপ তা সব আখ্যানে প্রতিষ্ঠিত।

পারস্যের কবি হাফিজ, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, ফেরদৌসীর  অনেক লেখায় টিউলিপের কথা এসেছে। তুরস্কের লোকজন টিউলিপ বাগানকে স্বর্গের উদ্যানের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। এটি তাদের জাতীয় ফুলও। তাদের জাতীয় বিমান সংস্থা ‘তার্কিস এয়ার’ এর মনোগ্রামে গ্রে টিউলিপ স্থান পেয়েছে। ইরানের জাতীয় মনোগ্রামে আরবি ‘আল্লাহ’ শব্দটি টিউলিপ ফুলের আদলে তৈরি। পারস্যে লাল টিউলিপকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। লাল টিউলিপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কালো অংশের মাধ্যমে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ভেঙ্গে খানখান ও কয়লার ন্যায় পুড়ে যাওয়া বোঝায়।

ফরাসি লেখক আলেকডান্ডার ডুমাসের একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ব্লাক টিউলিপ’। উপন্যাসটির পটভূমি যদিও নেদারল্যান্ডসের তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি, তারপর বইটির একটি বড় অংশজুড়ে স্থান পেয়েছে পারস্য থেকে নিয়ে আসা টিউলিপ চাষের কাহিনি যা ‘টিউলিপ ম্যানিয়ার’ একটি অংশ।

ষোড়শ শতকের শুরুতে পারস্য থেকে নিয়ে আসা টিউলিপ চাষ নিয়ে নেদারল্যান্ডসে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। ধনী-গরিব সবাই নেমে পড়ে টিউলিপ চাষে। এক একটি টিউলিপ বাল্ব হয়ে যায় সোনার চেয়েও দামি। অবস্থা এমন গিয়ে দাঁড়াল যে যে টিউলিপের বাল্ব মাটির নিচে, তা হাতবদল হতে থাকে দলিলের মাধ্যমে। লোকজন বাড়িঘর সহায় সম্পত্তির বিনিময়ে সে দলিল কেনাবেচা করতে থাকে। ১৬৩৬ সালে স্টক এক্সচেঞ্জ শুরু হয় শেয়ার বাজারে টিউলিপ বাল্ব কেনাবেচা। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে বিরল প্রজাতির এক একটি বাল্ব কেনাবেচা হতে থাকলো পাঁচ হাজার গিল্ডার্সে, যা দিয়ে সেসময়ে একটি বিলাসবহুল বাড়ি কেনা যেত।

কিছুদিন পর নেদারল্যান্ডসের লোকজন বুঝতে পারে যে দামি এ জিনিসটি এতোটা দামি নয়। সবাই টিউলিপ বাল্ব উৎপাদনে নেমে পড়ায় এর চাহিদাও ব্যাপক কমে যায়। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে এসে এই টিউলিপ বাল্বের চূড়ান্ত দরপতন হয়। ছিয়াত্তর হাজার গিল্ডার্স মূল্যের টিউলিপ বাল্বের দাম নেমে যায় এক গিল্ডার্সে। এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকজন সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। ইতিহাসে এটি ‘টিউলিপ ম্যানিয়া’ নামে পরিচিত। ইতিহাসে এটি শেয়ার মার্কেটের প্রথম ধ্বস যার প্রভাব পড়ে জার্মানি ও ব্রিটেনের শেয়ার বাজারে।

উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বড় টিউলিপ ফ্যাস্টিভ্যাল হয় কানাডায়। অটোয়ার টিউলিপ ফ্যাস্টিভাল নিয়ে মজার একটি গল্প আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের রাজপরিবার আশ্রয় নিয়েছিলো কানাডায়। নির্বাসনকালে ১৯৪৩ এর ১৯ জানুয়ারি রাজার কন্যা জুলিয়ানা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। রাজপরিবারের সদস্য যদি অন্য দেশে জন্মায় তাহলে সে জন্মসূত্রে ভিন দেশের নাগরিক হয়ে যাবে। তখন কানাডা সরকার অটোয়া সিভিক হসপিটালে প্রিন্সেস মার্গারিয়েটের জন্মকক্ষটিকে নেদারল্যান্ডসের পতাকা উড়িয়ে কক্ষটিকে নেদারল্যান্ডস ঘোষণা করে। এর ফলে দৃশ্যত কানাডায় জন্মগ্রহণ করেও মার্গারিয়েট ডাচ নাগরিকই থাকলো। এমনকি ডুয়েল সিটিজেনশিপের ঝামেলায়ও পড়তে হলো না রাজপরিবারের উত্তরাধিকারকে।

যুদ্ধ শেষে বাবা মায়ের সঙ্গে নেদারল্যান্ডস ফিরে যাবার পর রাজকন্যা বড় হতে  থাকে। বড় হয়ে একদিন সে জানতে পারে তার জন্মের সময় কানাডার গভীর মমতা আর ভালোবাসার গল্পটি। কিশোরী রাজকন্যা এরপর প্রতি বছর টিউলিপ ফোটার মৌসুমে একগুচ্ছ টিউলিপের চারা পাঠিয়ে দিতেন। কানাডাও সেই উপহার গ্রহণ করতো আনন্দচিত্তে এবং সেই চারাগুলো রোপন করে ফুল ফোটাতো। ধীরে ধীরে এটা একটা বাৎসরিক আচারে পরিণত হলো। বছর বছর বাড়তে থাকলো টিউলিপের চারার সংখ্যা। এক পর্যায়ে রাজকন্যার পাঠানো টিউলিপের চারা ফোটানোর মৌসুমটা পরিণত হলো ‘টিউলিপ ফেস্টিভালে’।

বিশ্বসেরা এই টিউলিপ ফুল আমাদের মত নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলিতে না হওয়ার কারণ আছে। এটি মূলত শীতের দেশের ফুল। শীতের সময় মাটির নিচে এর বাল্বের ভিতর একটি শরীরতাত্ত্বিক পরিবর্তন হয় যাকে ‘ভার্নালাইজেশন’ বলে। রোপনের আগে বাল্বে এই শীতের চিলিংটুকু কৃত্রিমভাবে করে নিতে পারলে আমাদের দেশেও এর ফুল ফোটানো সম্ভব। এর জন্য রেফ্রিজারেটরে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ১০-১৬ সপ্তাহ চিলিং করে নিতে হবে। রেফ্রিজারেটর থেকে বাল্ব বের করে বছরের সবচেয়ে শীতের সময়ে তা রোপন করলে চার থেকে ছয় সপ্তাহে ফুল পাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশে ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতে দেশে টিউলিপের বাণিজ্যিক উৎপাদনের একটি প্রকল্প চলমান আছে। তারা প্রায় ২০ প্রজাতির টিউলিপের জার্মপ্রাজম সংগ্রহ করে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়ানোর লক্ষ্যে গবেষণা করছে।

ইতোমধ্যে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক দেলোয়ার হোসেন তার বাগানে টিউলিপ ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি রেফ্রিজারেটরে কৃত্রিমভাবে টিউলিপ বাল্বে চিলিং করে এই সফলতা অর্জন করেছেন। টিউলিপ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত থাকলে আমাদের দেশেও হয়তো একদিন হেসে উঠবে শীতের দেশের মোহনীয় টিউলিপ।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!