কবি নজরুলের নার্গিস ও গ্রিক পুরাণের নার্সিসাস

শীতপ্রধান দেশে বরফের প্রকোপ কমে এলে পাথরমাটি ভেদ করে প্রথম যে গাছটি মাথা বের করে প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করে সেটি ড্যাফোডিল।

মোমিনুল আজমমোমিনুল আজমকানাডা থেকে
Published : 31 Oct 2020, 07:45 AM
Updated : 2 Nov 2020, 06:56 AM

তার ক’দিন পরেই ছয় পাপড়ির সাদা হলুদ ফুল শীতল হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানায়। দেখে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তারা বলছে- ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’ এ ফুলের আগমন দেখেই উত্তর আমেরিকার লোকজন বাগানের কাজ শুরু করে, দীর্ঘ শীতের পর বাগানের আবর্জনা পরিষ্কারে লেগে যায়।

ড্যাফোডিল নার্সিসাস গোত্রের ফুল। এর আদি নিবাস ইউরোপের মেডিটেরিয়ান এলাকায় হলেও পুরো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী এ ফুলের প্রায় পঞ্চাশটি প্রজাতি আছে, আছে হাজার খানেক হাইব্রিড জাত। মূলত হলুদ সাদা রংয়ের আধিক্য থাকলেও এখন লাল কমলা রংয়ের ড্যাফোডিলের দেখা পাওয়া যায়।

নিসর্গপ্রিয় কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ড্যাফোডিলের সৌন্দর্যে মজে গিয়ে আস্ত একটি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। এ কবিতাটি আমাদের সময়ে একাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ছিলো। আরেক ইংরেজ কবি রবার্ট হেরিক তার ‘টু ড্যাফোডিল’ কবিতায় এর ক্ষণস্থায়ী রূপে হতাশা প্রকাশ করে মানুষের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন- ড্যাফোডিলের জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও নির্দিষ্ট সময় তার পৃথিবীতে থাকার নিশ্চয়তা আছে, কিন্তু মানুষের জীবনের সে নিশ্চয়তাটুকুও নেই।

গ্রিক মিথে এ ফুলের নাম নার্সিসাস। প্রেম প্রত্যাখ্যানের করুণ মৃত্য থেকে এ ফুলের জন্ম হয় বলে মিথলজিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নার্সিসাস ছিলো অসম্ভব সুন্দর একটি ছেলে। জলপরী, বনপরী, ঝর্নাপরী, সুন্দরী মেয়ে এমনকি ছেলেরাও তার সঙ্গে প্রেম করতে চাইতো। সে ছিলো কিছুটা দাম্ভিক প্রকৃতির। প্রায়শই বলতো- তোমরা কেউ আমার যোগ্য নও। বনপরী ‘ইকো’ তো তাকে না পেয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছিলো।

নার্সিসাস সবাইকে কাছে টানতো, কিন্তু কাউকে আপন করে নিতো না। এভাবে অনেক পরী তার কাছে প্রতারিত হয়। এক পরী প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসকে বলেছিল- ‘নার্সিসাস যেন কোনদিন ভালবাসা না পায়।’ পরীর কথা নেমেসিস শুনেছিলেন এবং তিনি নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।

একদিন নার্সিসাস পানি খাবার জন্য জলাধারে এসেছিল। সে ঝুঁকে পানি পান করার সময় তার প্রতিবিম্ব পড়ে জলে। সে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে বুঝতে পারেনি এটা তার প্রতিবিম্ব। সে মনে করেছিল জলদেবী তার প্রেমে পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। যখনই সে তাকে আলিঙ্গন করতে জলে নামলো অমনি তা চলে যায়।

এই প্রথম নার্সিসাস কাউকে আপন করে পেতে চায়। তাকে না পেয়ে হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। সে নড়াচড়া করতো না, খেতো না, কোন কিছু পান করতো না। হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকলো। অলীক প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকলো, তার সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকলো। এভাবে ভুগতে ভুগতে একসময় নার্সিসাস মারা গেল। ধীরে ধীরে তার শরীর মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সেখান থেকেই জন্ম নিল নার্সিসাস ফুল।

নজরুলের কবিতায় এ ফুলের নাম এসেছে গ্রিক মিথের কাহিনির আদলে। ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরে এক অচেনা পল্লী বালিকার প্রেমে পড়েন নজরুল। সেই পল্লীবালার নাম ছিল নার্গিস। দুই মাসের মধ্যে নজরুল নিজ হাতে সেই প্রেম হত্যা করে কুমিল্লা ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। মিশে গেলেন কলকাতার কোলাহল আর কর্মস্রোতে। কিন্তু নজরুলের এ প্রেম কখনো হারায়নি। ধীরে ধীরে সেই নিহত প্রেমের শবদেহে জন্মাতে লাগল নজরুলের কবিতা ও গান।  তিনি লিখলেন- ‘বুলবুলি নিরব নার্গিস বনে/ ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে।’ নার্সিসাস ফুলের আরেক নাম নার্গিস। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে এ নামটি বেশি পরিচিত।

এ ফুলের চাষাবাদ খুব সহজ। এর জন্য আলাদা কোন যত্নের প্রয়োজন হয় না। মোটামুটি জৈবসার সমৃদ্ধ ভালো পানি নিষ্কাশনযোগ্য মাটি হলেই চলে। শীতপ্রধান দেশে বরফ পড়ার আগে মাটির চার থেকে ছয় ইঞ্চি গভীরে এর পেঁয়াজসদৃশ্য কন্দ লাগাতে হয়। রোপনের গভীরতা এর চেয়ে কম হলেও অসুবিধা নেই, তবে সে ক্ষেত্রে স্কোয়ারেল কিংবা খরগোশ জাতীয় প্রাণী রোপণের পর কন্দ উপড়ে ফেলতে পারে।

বিষাক্ত হওয়ার কারণে খরগোশ কিংবা স্কোয়ারেল এর চারা সাধারণত নষ্ট করে না। শীতের আগে এর কন্দ লাগানোর মূল কারণ হলো ফুল ফোটার জন্য ঠান্ডায় কন্দের ভিতর শরীরতত্ত্বীয় পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। মাটির নিচে থেকে বরফ কঠিন শীতে এটা প্রাকৃতিকভাবে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ ফুল ফোটানোর জন্য কন্দের এই চিলিংটি কৃত্রিমভাবে করতে হয়। সাধারণ রেফ্রিজারেটরে (ফ্রিজারে নয়) সর্বোচ্চ চার ডিগ্রি তাপমাত্রায় দশ থেকে ষোল সপ্তাহ ধরে এই চিলিং প্রক্রিয়া চালাতে হয়।

রেফ্রিজ্রেটর থেকে বের করে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এ কন্দ বেডে লাগালে চার থেকে ছয় সপ্তাহে ড্যাফোডিল ফুল পাওয়া সম্ভব। প্রতি বছর এই চিলিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রয়োজন হয় বিধায় এ ফুলের চাষ আমাদের মত ট্রপিকাল দেশগুলোতে বেশ কষ্টসাধ্য।

মোটামুটি অগাস্ট থেকেই উত্তর আমেরিকার গ্রোসারি স্টোরগুলোতে ড্যাফোডিলের কন্দ কিনতে পাওয়া যায়। একবার কন্দ রোপণ করলে প্রতি বছর সে স্থান থেকে চারা বের হয়। চারা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। চার পাঁচ বছর পরপর ড্যাফোডিলের কন্দ তুলে অন্য স্থানে লাগানো যায় বা প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবের কাছে বিতরণ করা যায়। গাছ বেশি ঘন হলে ভালো ফুল পাওয়া যায় না।

আর একটি ছোট তথ্য, দেখতে সুন্দর হলেও এর শরীর বিষে পরিপূর্ণ। এটি মানবদেহে প্রবেশ করলে প্রথমে ঝিমুনিভাব, পরে পেট ব্যাথা ও বমি শুরু হয়। বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেললে মৃত্য পর্যন্ত হতে পারে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!