কবে কখন কিভাবে দুর্গাপূজার চলন হয়েছিলো আমরা সে গবেষণায় যাচ্ছি না, বরং দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে বাঙালি জীবনে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয় আমরা সেদিকেই মনযোগ দিবো। সেই মহালয়া থেকে শুরু করে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী হয়ে বিজয়া দশমীতে যেয়ে পূজা শেষ হয়। এর মধ্যে অনেক আনুষ্ঠানিকতা আছে।
প্রত্যেকটা আনুষ্ঠানিতার সঙ্গেই আবার দিনের বিশেষ লগ্ন বা ক্ষণ জড়িত। লগ্ন বা ক্ষণ মেনে পূজা পালনের পাশাপাশি চলে উৎসবের আমেজ। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ দুর্গাদেবীকে দর্শণ করতে আসেন বলেই হয়তোবা দুর্গাপূজাকে সার্বজনীন দুর্গাপূজা বলা হয়।
আবার ঈদগাহে নামাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় মিষ্টান্ন কেনার চল আছে আবহমান গ্রাম বাংলায়। আমরা ছোটরা কিনতাম পাঁপড় ভাজা। ঈদগাহের বাইরে রাস্তার পাশে সারধরে এ দোকানগুলো বসতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব দোকানগুলো ছিলো আমাদের পাড়ার হিন্দু পালেদের দোকান। পাড়ার গান বাজনা থেকে শুরু করে থিয়েটারের চর্চা চলতো হিন্দু বরগীদের বাড়িতে।
দুর্গাপূজা আসলেই বরগী বাড়িতে ব্যস্ততা বেড়ে যেতো।
কুষ্টিয়া শহরের অনেক প্রতিমা তৈরি হতো বরগী বাড়িতে। এছাড়া নিজেদের জন্যও একটা প্রতিমা আলাদা করে রাখা হতো। শুরুতেই বাঁশের সঙ্গে বিচালি বেঁধে প্রতিমার একটা প্রাথমিক আকার দেওয়া হতো। এরপর তার উপর কাদা লেপে প্রতিমা তৈরি করা হতো। আমরা ছোটরা যেয়ে বরগী কাকাদের পাশে বসে বসে উনাদের নিপুণ হাতের কারুকাজ দেখতাম। কিভাবে সামান্য বাঁশ, বিচালি আর কাদা থেকে একটা মূর্তি তৈরি হচ্ছে। একেবারে রুটিন করে প্রতিদিন সকালে উঠে যেয়ে বসে থাকতাম আমরা। আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম কোন মূর্তিটার কতখানি অগ্রগতি হয়েছে বা এরপর কোন মূর্তিটার কোন অংশ তৈরি হবে।
মাঝেমধ্যে কাকারা আমাদের কাছে এটা সেটা এগিয়ে চাইলে আমরা খুবই খুশি হতাম। এভাবে পুরো পাড়াময় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো। পাশেই সাহা পাড়াতেও মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন চলতো। বাঁশের সাঁকোয় খাল পার হয়ে আমরা দেখতে যেতাম চৌড়হাঁসের পূজা। এই তিনটা পূজায় আমরা পালা করে দেখতাম, তবে আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বরগীদের বাড়ি। কারণ ওখানে বাড়তি পাওনা হিসেবে প্রতিমা গড়া দেখা যেতো। পূজা শুরু হলে সারা পাড়া ঢাক আর কাঁসার তালে যেন নেচে উঠতো। ধূপের গন্ধে সারা পাড়া ঢাকা পড়ে যেতো।
কুষ্টিয়া থেকে ফিরে আসি সিডনিতে। বাংলাদেশিরা বিশ্বের যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই একটা ছোট বাংলাদেশ তৈরি করে নিয়েছেন আর পালন করে চলেছেন বাঙালির সব রকমের উৎসব। সিডনি আসার পর আমরা সব ধরণের উৎসব পালন করলেও দুর্গাপূজা আর ঢাক-কাঁসার বাদ্যটা খুব করে অনুভব করছিলাম। হঠাৎই একদিন সন্ধান পেয়েছিলাম পাশের সবার্ব গ্লেনফিল্ডে আগমণী অস্ট্রেলিয়ার দুর্গাপূজার। গত বছর থেকে শঙ্খনাদ নামের আরো একটা সংগঠন ক্যাম্পবেলটাউন এলাকায় দুর্গোৎসব পালন করে যাচ্ছে এবং আমরা যথারীতি এ মণ্ডপ থেকে সে মণ্ডপে দলবেঁধে পূজা দেখে বেড়াই।
পূজার সময় অফিস থেকে বাসায় ফিরে প্রথম কাজ বাচ্চা দুটোকে নিয়ে দুই মণ্ডপে ঢুঁ মারা এবং প্রসাদ খাওয়া ছিলো আমাদের নিত্যদিনের রুটিন। কিন্ত মহামারীকালে এবার আর সেটা সম্ভব হয়নি। এবার সব উৎসব বাতিল করা হয়েছে। দুর্গাপূজাও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কাটা অস্ট্রেলিয়া বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কাটাতে একটু বেশামাল হয়ে গিয়েছিলো। অবশেষে সেটাও এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে বলা চলে। সব ধরণের জনসমাগম নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়াতে হল বুকিং বাতিল করে দেওয়া হয়েছিলো।
কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন বিধি নিষেধের শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়। প্রত্যেকটা মণ্ডপেই জনসমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়। মণ্ডপের বাইরে ছিলো শরীরের তাপমাত্রা মাপার মাস্ক সরবরাহের ব্যবস্থা। এভাবেই এবার পূজা পালন করেছে অস্ট্রেলিয়ায় ‘বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন’, ‘আগমণী অস্ট্রেলিয়া’ এবং ‘শঙ্খনাদ’। অবশ্য ‘আগমণী অস্ট্রেলিয়ার’ প্রতিমা স্থাপনের অনুমতি ছিলো না তাই বলে পূজার আনন্দে কোন ভাটা পড়েনি।
মণ্ডপের ভিতরে ঢুকেই কানের তালা লেগে গেলো ঢাক আর কাঁসার বাদ্যে। অন্য কোন শব্দে কানে তালা লেগে গেলে অস্থির থাকে, কিন্তু ঢাক আর কাঁসার বাদ্যে কিছু একটা আছে যেটা সারা শরীর মনে এক ধরণের দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়। বাদ্যের তালে তালে চলছে দলবেঁধে নৃত্য। কখনও ছেলেরা আবার কখনও মেয়েরা দলবেঁধে নৃত্য করার পর ছেলেরা ধুপের ধুনি হাতে নিয়ে নাচলো। বাসায় ফেরার তাড়া থাকাতে আমরা প্রসাদ নিয়ে চলে আসলাম। এভাবেই শেষ হলো আমাদের এবারের দুর্গাপূজা।
সময়ের অভাবে এবার আর ‘আগমণীর’ পূজা মণ্ডপে যেতে পারিনি। এছাড়া ‘বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের’ পূজা মণ্ডপ আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে হওয়াতে আর যাওয়া সম্ভব হয়নি। জনসমাগম এড়াতে এবার অনেকেই পারিবারিকভাবে পূজা পালন করেছেন। পাল পরিবার, সেন পরিবার পারিবারিকভাবে এই প্রথমবার পূজা পালন করেছেন। অবশ্য তাতে সব ধরণের আনুষ্ঠানিকতায় যতদূর সম্ভব পালন করা হয়েছে। সব পূজাতেই মহামারী পেরিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক সময়ের জন্য দেবী দুর্গার কাছে প্রাথর্না করা হয়েছে।
প্ৰত্যেবার পূজা উপলক্ষেই প্রকাশ করা হয় পূজা স্মরণিকা। ‘শঙ্খনাদ’ এবার তাদের স্মরণিকাটা প্রকাশ করেছে অনলাইনে, তবে যে কেউ চাইলে সেটা ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে পড়তে পারবেন। এভাবেই সীমিত পরিসরে পূজার সব আনুষ্ঠানিকতা যতদূর সম্ভব সম্পন্ন করা হয়েছে। দেবী দুর্গা বিজয়া দশমীতে যেমন অসুরকে পরাজিত করে দুষ্টের দমন শিষ্টের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তেমনি এবার সবাই দেবী দুর্গার কাছে ভাইরাস থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন।
আমরাও আশা করি খুব শিঘ্রই মহামারীর এই দীর্ঘ দমবন্ধ পরিবেশ পেরিয়ে বইবে শরৎকালের স্নিগ্ধ বাতাস। যে বাতাসে গাছ থেকে দলে দলে ঝরে পড়বে শিউলি আর গ্রাম্য কিশোরী ফুলের ডালি কাখে নিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে আনবে দুর্গাপূজার জন্য। বাতাসে দুলে উঠবে কাশের ফুল যেমন ঢাকের কোণায় দোলে কাপড়ের তৈরি কাশফুল। আর আকাশে উড়ে বেড়াবে পেঁজা তুলোর দুরন্ত মেঘ। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা। দেবী দুর্গা আমাদের সবার মঙ্গল করুন।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |