ভ্রমণ কাহিনি: নগররাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটিতে

পর্যটকদের সহজে চলাচলের সুবিধার্থে ইতালির রোম নগরীতে ‘হপ অন হপ অফ’ বাস সার্ভিস রয়েছে। মূলত দ্বিতল এ বাসগুলোতে ছাদ নেই, তাই পর্যটকরা সহজেই বিভিন্ন স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট দেখে দেখে পুরো নগর ভ্রমণ করে থাকেন। আর যেখানে মন চায় সেখানে নেমে যান।

মোহাম্মদ আজিজুল মওলা, ইতালি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2020, 09:40 AM
Updated : 13 Oct 2020, 09:40 AM

আমাদের বাস ভ্যাটিকান সিটির প্রবেশমুখে আসতেই নেমে পড়লাম চটপট। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে ক্লাস সিক্সে থাকতে এ দেশটির নাম আমি শুনেছিলাম। সেই থেকে মনে মনে এ দেশটি ভ্রমণের সংকল্প আমাকে পেয়ে বসেছিল। যা হোক, ইতালিতে এসে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম নগররাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগটি হাতছাড়া করলাম না।

টিবার নদীর কূল ঘেঁষে ভ্যাটিকান সিটি অবস্থিত। এ নদীটি পুরো রোম নগরীর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটি। এ দেশটি আসলে খ্রিস্টান ক্যাথলিকদের প্রধান তীর্থস্থান। মাত্র ৪৯ হেক্টর আয়তনের এ ক্ষুদ্র দেশটিতে জনসংখ্যা কমবেশি ৮২৫ এর মতো।

পোপ শাসিত এ দেশটির প্রধান হলেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি জন্মসূত্রে আর্জেন্টাইন। গত ২০১৩ সাল থেকে তিনি খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ২৬৬তম পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯২৯ সালে ইতালির সরকারের সঙ্গে লাতেরান চুক্তির আওতায় এ পোপীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি।

সিটির  প্রবেশমুখের একটু আগে হাতের বা দিকে বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নামে ‘মিউজিও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এক্সপেরিয়েন্স’ নামে একটি গ্যালারি চোখে পড়ল। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি ভ্রাম্যমান দোকান বসিয়েছে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা। তারা সেখানে বিভিন্ন সুভিনিয়র বিক্রি করছে। নগরীর প্রবেশমুখে দাঁড়ালে একটি বিশাল আকৃতির বিল্ডিং চোখে পড়ে। এটি হলো ‘সেন্ট পিটারস বাসিলিকা’, ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান।

কোন পোপ মারা গেলে অথবা অবসরে চলে গেলে এ বিল্ডিং এর ব্যালকনি থেকেই নতুন নির্বাচিত পোপ দেখা দেন। এ দৃশ্যটি দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশনে চোখ রাখেন। আর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতারা এদেশে এসে জড়ো হন। ১৬২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিল্ডিংটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি। প্রায় ২০ হাজার মানুষের সমাগম হতে পারে এ বিল্ডিং-এ। এ বিল্ডিং-এর সামনে যে বিশাল মাঠ, তাকে বলা হয় ‘সেন্ট পিটার্স স্কয়ার’।

এক পাশে রয়েছে মিউজিয়াম আর আরেক পাশে রয়েছে ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টার এবং স্কয়ারের দু’পাশে দুটি বিশাল আকৃতির পানির ফোয়ারা। এই দেশে রয়েছে মাত্র ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র রেলপথ, নাম ‘সিটাডেল ভ্যাটিকানো’। তবে এ রেল কোন যাত্রী বহন করে না, শুধু মালামাল বহন করে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের নারী-পুরুষ-শিশু যুবা এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটি পরিদর্শনে। প্রতি বছর এ দেশটিতে ভ্রমণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে আসা প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ।

আমাদের পেছনে কিছু ধর্মীয় যাজককে দেখলাম। তারা দর্শনার্থীদের আশীর্বাদ করে দিচ্ছেন। দেশটি খুব ক্ষুদ্র হতে পারে, কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে যা যা থাকা দরকার প্রায় সবকিছুই এদেশে আছে। আছে নিজস্ব পতাকা, মানচিত্র, নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও। পৃথিবীর প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তাদের রেডিও থেকে ধর্মীয় বাণী প্রচার করা হয়। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যাথলিক গির্জাগুলো এ পোপীয় রাষ্ট্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ভ্যাটিকান সিটি নগররাষ্ট্রটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয়, কিন্তু সেনজেনভুক্ত। এ ধরনের আরও চারটি রাষ্ট্র রয়েছে- অ্যানডোরা, মোনাকো, সান ম্যারিনো ও লিশটেনস্টাইন। এ দেশগুলোতে প্রবেশ করতে নতুন করে কোন ভিসা লাগবে না। তবে দেশটি ২০০৪ সাল থেকে ইউরোকে তাদের মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করেছে আর অফিশিয়াল ভাষা হচ্ছে লাতিন, মানে ইতালিয়।

সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার একপাশে দেখলাম দুজন সুইচ গার্ডের সদস্যকে। লাল, হলুদ ও নীল এ তিনটি বর্ণ দিয়ে তৈরি একটি অদ্ভুত ইউনিফর্ম পরা ২৫-৩০ বছরের যুবক। একটি বিষয় আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি, ভ্যাটিকান সিটির যারা নিরাপত্তা দেয় তাদেরকে বলা হয় ‘সুইচ গার্ড’। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর দল এটি, মাত্র ১৩৫ জন সদস্য সংখ্যা।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ‘সুইচ গার্ড’ এর সব সদস্য সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া যুবক। প্রায় আধ ঘণ্টা পর খেয়াল করলাম, সুইচ গার্ডের কয়েকজন সদস্য একজন দলনেতার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে আসছেন গার্ড রুমের পাশ থেকে, আমি ছবি তুলতে চাইছিলাম আমার বন্ধু বারণ করল, অনুমতি ছাড়া ওদের ছবি তোলা ঠিক হবে না।

লেখক

ভ্যাটিকান সিটিতে রয়েছে সুন্দর একটি গার্ডেন। সবুজের মাঝে বিভিন্ন রঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে বাগানে। দর্শনার্থীরা বসে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আর ভ্যাটিকানের বিখ্যাত মিউজিয়ামে রয়েছে ইতালিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন চিত্রকরের আঁকা ছবি, বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম, নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে এটি ঘুরে দেখতে।

হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে গেল। একটু দূরে দেখলাম বিভিন্ন রঙের ফুল দিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করছে। বিক্রেতাকে একটু বয়সি মনে হল। মনে হয় অনেকদিন ধরে এখানে সে আইসক্রিম বিক্রি করছে। ৬ ইউরো দিয়ে দুটি আইসক্রিম হাতে নিয়ে দুই বন্ধু ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম তাদের বিভিন্ন স্থাপনা।

লেখক পরিচিতি: ডেপুটি সেক্রেটারি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!