ভ্রমণ কাহিনি: বাবা দিবসে বৃষ্টির বনে

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে পৃথিবীব্যাপী স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত। অস্ট্রেলিয়াতেও তার ধাক্কা এসে লেগেছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া মহামারীর প্রথম ধাক্কাটা খুব ভালো মোকাবিলা করেছে।

মো. ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2020, 04:36 AM
Updated : 11 Sept 2020, 04:36 AM

কিন্তু যখন বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকেরা ফিরে আসতে শুরু করলো তখন এসে লাগলো দ্বিতীয় ধাক্কা। বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা অস্ট্রেলিয়ানরা এসে শুরুতে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নে চৌদ্দ দিন কাটিয়েছে কোয়ারেন্টিনে, তারপর নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই এসেছিলো করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়ে।

এছাড়া অনেকদিন নিয়ম-কানুন মেনে চলার ফলেই হয়তোবা মেলবোর্নের মানুষ একটু বেপরোয়া হয়ে উঠছিলো। পথে ঘাটে দোকানপাটে কোন প্রকার সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলায় একসময় একদিনে করোনাভাইরাস শনাক্তের সংখ্যা সাতশ ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য এখন বেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।

এর ফলশ্রুতিতে নিউ সাউথ ওয়েলসেও বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে বর্ডার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আবারও চলাফেরাতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এভাবেই এখন পর্যন্ত চলছে অস্ট্রেলিয়ার জনজীবন এবং সাম্প্রতিক খবরে বলা হচ্ছে অনেকদিন পর অস্ট্রেলিয়া আবার আর্থিক মন্দার শিকার হতে যাচ্ছে।

যাই হোক, তবু জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মেই। দেখতে দেখতে অস্ট্রেলিয়াতে ‘বাবা দিবস’ চলে এলো। ‘বাবা দিবস’ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দিনে পালন করা হয়। অস্ট্রেলিয়াতে এবার পালন করা হলো ৬ সেপ্টেম্বর, রোববার। সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো, কারণ আগের রাতে ঘুমাতে যেতে দেরি হয়েছিলো।

ঘুম ভাঙলো আমার ছেলে রায়ানের ডাকাডাকিতে। সে দেখে ফেলেছে তার মা এবং বোন মিলে কিছু একটা আয়োজন করছে, কিন্তু আমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। তাই ডেকে তোলা। আমি টেবিলে যেয়ে দেখি আমার জন্য নাশতা এবং উপহার রেডি। ওদের উপহারগুলো খুলে খুলে দেখলাম, তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে নাশতা করলাম আর ভাবছিলাম বাচ্চাদেরকেও একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়। বাবা দিবসের এই অছিলায় কোথাও থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়!

ফেইসবুক এখন যেমন শো-অফের জায়গা ঠিক তেমনি অনেক কাজেরও জায়গা। আমার মতে ফেইসবুক এখন নাগরিক সমাজের দর্পন। আগের দিন পিউ আপু সপরিবারে ‘মিনামারা রেইন ফরেস্টে’ বেড়াতে গিয়ে ছবি পোস্ট করেছিলেন। দেখে খুবই মনে ধরেছিলো। একেবারে নির্জন জায়গা, ঝুলন্ত সেতু, টলটলে পরিষ্কার পানির ঝর্ণা। বেড়ানোর জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা।

রেইন ফরেস্টের ঝুলন্ত সেতুতে পিউ

পিউ আপুর সঙ্গে পরিচয় অস্ট্রেলিয়া আসার পর। বাপ্পি ভাইদের বাসায় উনি নাকি আমাকে দেখেছিলেন, কিন্তু আমি খেয়াল করিনি। পরে একদিন বাংলা স্কুলের মেলায় বিভিন্ন জিনিসপত্র আনা নেওয়া করতে যেয়ে আমাকে বারবার গাড়ি পার্ক করতে হচ্ছিলো। একবার দুই গাড়ির মাঝখানে পার্ক করতে যেয়ে আমার অবস্থা মোটামুটি জেরবার। পিউ আপু দূর থেকে সেটা দেখে এগিয়ে এসে বললেন- ভাই হেল্প লাগবে নাকি? আমি বললাম- তাহলে তো খুবই ভালো হয়। উনি খুবই সহজে গাড়িটা পার্ক করে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কি আমাকে চেনেন? উনি বললেন- বাপ্পি ভাইদের বাসায় আমাকে নাকি দেখেছিলেন।

এ সামান্য পরিচয়ে উনি আমাকে মনে রেখেছেন এবং আমার বিপদ দেখে এগিয়ে এসেছেন ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করলো। উনি বললেন- আপনার হাসির কথা আমার মনে আছে। এই প্রথম সরাসরি উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনার হাসিও অপার্থিব সুন্দর। হাসলে উনার গজদন্ত দেখা যায়। সত্যি কথা বলতে হাসলে যাদের গজদন্ত দেখা যায় এমন মানুষদের আমি মনে মনে ঈর্ষা করি।

যাই হোক, উনি গায়ে পরে আমার উপকার করতে এসেছেন এটা থেকেই বুঝে গেলাম মানুষ হিসেবে উনি ঠিক কতটা উন্নত মনের। উনার অনেক গুণ, সুন্দর গান করেন। আছে গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। এছাড়া দুর্দান্ত সব ছবি তুলেন। পরে মেলা প্রাঙ্গণে উনার সঙ্গে আবারও দেখা হয়ে গেলো। উনি বললেন- ইয়াকুব ভাই আপনার ছবি তুলে দিই। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। উনি আমার কিছু দুর্র্ধষ ছবি তুলে দিলেন। সেই থেকে উনার সঙ্গে দারুণ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পরবর্তিতে শ্যালক আদনান বললেন- পিউ আপু সম্পর্কে উনার মামী হন, তাই আমিও এখন মাঝে মধ্যে ঠাট্টাচ্ছলে উনাকে মামী বলেই ডাকি।

পিউ আপুও প্রকৃতি প্রেমিক। উনার এই ছবিগুলো দেখে তাই মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেললাম পরেরদিন ‘বাবা দিবসে’ বাচ্চাদের নিয়ে ওখানে বেড়াতে গেলে কেমন হয়। আমাদের বাসা মিন্টো থেকে ঘণ্টা দেড়েক আর সিডনি শহর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের ড্রাইভ। হুট করেই পরিকল্পনা করা, তাই একটা ব্যাকপ্যাকে এক প্যাকেট ড্ৰাই কেক আর এক বোতল কোক নিয়ে নিলাম। এরপর যাত্রা শুরু করলাম। ছেলে রায়ান আর মেয়ে তাহিয়া পথেই ঘুমিয়ে পড়লো। আমি দুপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতে শুরু করলাম। এর আগে যখন এদিক দিয়ে গেছি তখন বুশ ফায়ার হচ্ছিলো চারদিকে, তাই আশপাশের স্থলভাগ ছিলো একেবারে বাদামি বর্ণের বিরানভূমি।

কিন্তু এবার সেইসব খোলা জায়গা গাঢ় সবুজে ঢাকা। তার মধ্যেই কোথাও গরু, কোথাও ভেড়া, কোথাও ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। আরো কিছু দূর যাওয়ার পর শুরু হয় পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তাটা কখনও পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আবার কখনও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে। যাওয়ার সময় অন্যপাশে তাকালে সত্যি বলতে কিছুটা ভয়ই লাগে। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় আমরা রাস্তা থেকে সমুদ্র দেখতে পেলাম। ততক্ষণে তাহিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তাহিয়াকে বললাম দেখো সামনের জায়গাটা নিচু, কিন্তু সমুদ্র পানি আমাদের উচ্চতায় আছে। তবু স্থলভাগে এসে পড়ছে, কি অদ্ভুত ভূগোল তাই না? সেও খুবই অবাক হলো।

এরপর একসময় পৌঁছে গেলাম 'মিনামারা রেইন ফরেস্ট' এর প্রবেশদ্বারে। আমাদের সামনে আরো তিনটা গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। ভিতর থেকে একটা একটা করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিলো আর সেটা হিসাব করে একটা একটা গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিলো, কারণ পার্কিং তখন পুরোপুরি ভর্তি। আমাদের বেলা আসলে দায়িত্বরত মহিলা বললেন- তোমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ পার্কিং ফুল। ভিতরে গেলে দেখবে পার্কিংয়ের পাশেই টিকেট কাউন্টার, সেখান থেকে সারাদিনের জন্য একটা বারো ডলারের টিকেট কিনে নিয়ো, ব্যাস হয়ে গেলো। এরপর তোমরা রেইনফরেস্ট বা ঝর্ণাতে ঘুরে বেড়াতে পারবে। আর আমরা খুবই দুঃখিত যে আমাদের রেস্তোরাঁটা কোভিড-১৯ এর জন্য আপাতত বন্ধ রয়েছে।

উনাকে পার করে আরো একটু এগিয়ে যেতেই আরো একজন মহিলা আমাদের তিন বাপ-বেটা-বেটিকে দেখে বললেন- হ্যাপি ফাদারস ডে। তোমরা খুবই ভালো দিনে এসেছো। এখানে একটু অপেক্ষা করো, ভিতর থেকে একটা গাড়ি বের হলেই তোমাদের ঢুকতে দেবো। একটু পরেই পরপর তিনটা গাড়ি বেরিয়ে আসলো। উনি বললেন- এবার তোমরা ঢুকে পড়ো।  আমরা উনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পার্কিংয়ে ঢুকে পড়লাম।

গাড়ি পার্কিং করে একটা টিকেট নিয়ে এসে বনেটে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমার কাঁধে ব্যাকপ্যাক আর সবার আগে রায়ান, তারপর আমি আর তাহিয়া। রায়ানকে সবসময়ই সবার আগে যেতে দিতে হবে, না হলে চিৎকার করে আমাদের যাওয়া পণ্ড করে দিবে। প্রবেশপথের বা পাশেই রেস্তোরাঁ আর তার নিচের তলায় প্রসাধনকক্ষ। আর বা দিকে আরো একটু নেমে গেলে গাছে ঢাকা ছায়া সুনিবিড় পিকনিক স্পট। এখন যেহেতু রেস্তোরাঁ বন্ধ তাই অনেকেই খাবার নিয়ে এসে পিকনিক স্পটে বসে খাওয়া দাওয়া সেরে নিচ্ছেন। আমরা রেস্তোরাঁকে পাশ কাটিয়ে বনে প্রবেশ করলাম।

বনে প্রবেশমুখে তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো আছে কোন দিকে যেতে হবে। তাহিয়া ভুল করে শেষ থেকে শুরু করলো, অবশ্য এতে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হলো না। কারণ পুরো ওয়াকটা একটা লুপ, আপনি যেদিক দিয়েই যান না কেন আবার শুরুতেই ফিরে আসবেন। মূল রেইন ফরেস্ট ওয়াকের লুপটা এক দশমিক ছয় কিলোমিটার আর মূল লুপ থেকে একটা শাখা বেরিয়ে গেছে এক দশমিক তিন কিলোমিটার দীর্ঘ যেটা শেষ হয়েছে একটা সুন্দর ঝর্ণাতে যেয়ে। তার মানে আপনাকে পুরো ওয়াকটা শেষ করতে হলে মোট চার দশমিক দুই কিলোমিটার হাঁটতে হবে।

মূল লুপটার গ্রেড হলো তিন আর ঝর্ণাতে যাওয়ার ওয়াকটার গ্রেড হলো চার। এখানে বলে রাখা ভালো গ্রেড যত বেশি হবে হাঁটা তত কঠিন হবে। গ্রেড আসলে রাস্তার স্লোপের সঙ্গে সম্পর্কিত। গ্রেড বেশি মানে আপনাকে বেশ উঁচু স্লোপ দিয়ে হাঁটতে হবে। আমরা যেহেতু উল্টো দিক দিয়ে এসেছি, তাই আমাদের সামনে আগে পড়লো ঝর্ণাতে যাওয়ার শাখা রাস্তাটা। আমরা সেদিকে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর তাহিয়া ক্লান্ত হয়ে গেলো খাড়া রাস্তায় হাঁটার কারণে। কিন্তু রায়ানের কোন ক্লান্তি নেই। সে দৌড়ে দৌড়ে একটা করে বাঁক পার হচ্ছিলো।

 প্রত্যেকটা বাঁকের শেষে একটা করে বেঞ্চ রাখা আছে বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। আমি তারই একটাতে বসিয়ে দুজনকে ব্যাকপ্যাক থেকে কেক আর কোক বের করে খাইয়ে দিলাম। বললাম- বেশি খেয়ো না তাহলে আবার হাঁটতে বেশি কষ্ট হবে। একটা বেঞ্চে দেখলাম তাহিয়ার বয়সী একজন মেয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে আর পাশে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে আমরা বললাম- আর কতদূর। মেয়েটা বলল- তোমরা সবে অর্ধেক এসেছো। আর বাবাটা বললেন- তুমি যাওয়ার সময় বা পাশে পায়ের কাছে খেয়াল করে দেখো খুবই ছোট স্কোয়ার আকারের বাক্সে মাইলেজ দেওয়া আছে। 

আমরা আবারো হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটার রাস্তাটা থেকে গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোকর দিয়ে অন্যপাশের পাহাড়ের গায়ের সবুজ দেখা যাচ্ছে। আর দুই পাহাড়ের মাঝে দিয়ে বয়ে গেছে ঝর্ণা, অবশ্য আমরা তখনও ঝর্ণার টিকিটার দেখা পায়নি। কারণ সেটা অনেক নিচে অবস্থিত। আমি তাহিয়াকে বললাম- এখানে পুরো পাহাড়টা সবুজে ঢাকা। শুনে তাহিয়া বলল- রেইন ফরেস্ট তো,  তাই সবসময়ই কোন না কোন গাছপালা জন্মাতে থাকে মনে হয়। আমি কান পেতে এক ধরনের শব্দ শুনতে পেয়ে বললাম- বৃষ্টি শুরু হলো নাকি? তাহিয়া বলল- না, আসলে এখানে সবসময় এমন শব্দ হয় বলেই হয়তো এই বনের এমন নামকরণ।

রেইন ফরেস্টের গাছগুলো যেমন বয়স্ক ঠিক তেমনি অনেক উঁচু। আর সেইসব উঁচু গাছের গায়ে আবার বাসা বেঁধেছে অনেক পরগাছার ঝাড়। এই পরগাছাগুলোর বিশেষত্ব হলো এগুলো অনেকটা আঠার মতো গাছের গায়ে লেগে আছে আর সেখান থেকে গাঢ় সবুজ পাতা বেরিয়ে যেয়ে ছোট ঝাড়ে পরিণত হয়েছে। এছাড়া অনেক লতা গাছের মাথা অবধি চলে গেছে। লতাগুলো এতোই বয়স্ক যে দেখে আলাদা গাছ বলে ভ্রম হয়। অনেকগুলো লতা আমাদের হাঁটার রাস্তায় ঝুলে ছিলো। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে লতা ধরে ঝুলে টারজানের মতো ভঙ্গি করে ছবি তুলে নিলাম।

এভাবে চলতে চলতে একসময় আমরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছে গেলাম। হাঁটার সময় ভাবছিলাম এতো কষ্ট করে হাঁটছি, কিন্তু ঝর্ণাটা যদি সুন্দর না হয় তাহলে সব পরিশ্রমই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু ঝর্ণার কাছে যাওয়ার পর আমাদের প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। একেতো ঝর্ণার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, অন্যদিকে ঝর্ণার পানির কারণে সেখানকার শীতল পরিবেশ। তাহিয়া মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল- বাবা দেখো শীতকালের মতো সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে মুখ থেকে। তাহিয়ার দেখাদেখি রায়ানও ধোঁয়া বের করে আমাকে দেখালো। ঝর্ণাটা অনেক উঁচু থেকে পড়েছে। ঝর্ণাটার দু’পাশে আবার উঁচু গাছ। সেই গাছের মাথায় থাকাতে হলে আপনাকে পুরোপুরি ঘাড় কাত করতে হবে।

এতক্ষণ হাঁটার সময় আমরা কোন আকাশ দেখনি। ঝর্ণার ওখানে একটা ছোট গোলাকৃতি আকাশের দেখা পেলাম। ঝর্ণার পানিতে নামা নিষেধ, আমরা তাই সামনে দাঁড়িয়ে একজনকে দিয়ে ছবি তুলে নিলাম। ঝর্ণার ঠিক বা পাশেই  একটা লুকআউট। সেখানে দাঁড়ালে নিচের প্রবাহটা দেখা যায়। ঝর্ণাটা পাহাড়ের ফাঁক গোলে ঘুরে ঘুরে অনেক নিচে যেয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকালে শিউরে উঠতে হয়।

ঝর্ণাটা এতটাই সুন্দর যে আমরা আর ফিরতে চাইছিলাম না। কিন্তু আমাদেরকে ফিরতে হবে। ঝর্ণার ওয়াকের মাঝপথে এসে লুৎফা ভাবীদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। উনারাও সেদিন গেছেন সপরিবারে। লুৎফা ভাবী বললেন- ভাই আর কতদূর? আমি বললাম- আপনারা কঠিন রাস্তাটা পার করে এসেছেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করেন। উনাদের একটু পিছনেই ভাইয়াকে দেখলাম ছোট বাচ্চাটাকে স্টলারে নিয়ে এগিয়ে আসছেন। ভাইয়াকে দেখেই বললাম- হ্যাপি ফাদারস ডে। শুনেই উনি হেসে কুটিকুটি। এই মানুষটাকে আমি কখনও গম্ভীর মুখে দেখিনি। এসময়ে এমন মানুষ পাওয়া বিরল ঘটনা।

আমরা ঝর্ণার লুপ থেকে বেরিয়ে মূল লুপে প্রবেশ করলাম। মূল লুপটা আরো বেশি সুন্দর। এখানে খাড়া রাস্তা নেই, উপরন্তু প্রায় পুরো রাস্তাটাই পাটাতনের, তাই হাঁটা সহজ। আর বাড়তি আনন্দের উপকরণ হিসেবে আছে দুটো ঝুলন্ত সেতু। পায়ের নিচ দিয়ে কাকচক্ষু জলের ঝর্ণা বয়ে চলেছে কুলকুল শব্দে আর মাথার উপর সবুজের বেস্টনি। সেই এক অতি প্রাকৃতিক অনুভূতি।

আগেই বলেছিলাম এখানে পাহাড়ের গায়ের পাথরগুলো পর্যন্ত সবুজ। পাথরের গায়েও এক ধরণের সবুজ শ্যাওলা জন্মে সেগুলোকে সবুজের রূপ দিয়েছে। তাহিয়াকে সেতুগুলোর উপর দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে নিলাম। আর রায়ান তো দৌড়ে দৌড়ে সেতুগুলো পার হচ্ছিলো। একটা সেতুর উপর এসে দোল দিয়ে আবার আমাদেরকে ভয়ও দেখানোর চেষ্টা করলো। সেতুর উপর থেকে নিচে ঝর্ণার কাকচক্ষু জল দেখে তাহিয়া বলল- বাবা আমি এতো পরিষ্কার পানি এর আগে দেখিনি। সেদিকে তাকিয়ে আমাকেও স্বীকার করতে হলো আসলেই পানি অনেক পরিষ্কার, একেবারে তলা পর্যন্ত দেখা যায়।

এভাবেই একসময় আমাদের হাঁটা শেষ হলো। ফিরে এসে প্রসাধন কক্ষে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা আবারও একটু খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। এবার ফেরার পালা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো হতো। আসলে এসব জায়গায় হাঁটার চেয়ে দৃশ্য উপভোগ করাটাই জরুরি। আর আপনি যত বেশি দৃশ্য উপভোগ করবেন ততবেশি এ জায়গাটার প্রেমে পরে যাবেন।

এখানে কিছু কথা বলে রাখা জরুরি। এ জায়গাটাতে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, তাই সেটা পরিবার পরিজনকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখা ভালো। আর এখানে আসার উপযুক্ত সময় শীত ছাড়া যে কোন সময়, তাহলে পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। আপনিও চাইলে নাগরিক কোলাহল থেকে একেবারে প্রকৃতির সুনিবিড় কোলে একটা দিন পার করে আসতে পারেন। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি আপনি প্রকৃতিপ্রেমিক না হলেও সবুজের এ স্পর্শ আপনার ভালো লাগবেই। একটা দিনের জন্য হলেও আপনি নাগরিক ক্লান্তি থেকে অনেক দূরে চলে যাবেন। আপনার বারবারই মনে হবে জীবনটা এমন সহজ হলেও পারতো।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!