মহালয়াকে সামনে রেখে ফেইসবুকে অনুষ্ঠান করেছে লন্ডনভিত্তিক কলাকার আর্টস

শনি ও রোববার ফেইসবুকে মিউজিকের মাধ্যমে ওই অনুষ্ঠানটি হয়, যার মূল ভাবনা, পাণ্ডুলিপি ও পরিচালনায় ছিলেন চন্দ্রা চক্রবর্তী এবং প্রযোজনায় কলাকার আর্টস, ইউকে।

দোদুল এআর, ঢাকা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2020, 09:37 PM
Updated : 9 Sept 2020, 09:37 PM

কলাকারের ৪০তম এ পর্বে অংশ নেন চারজন নতুন সঙ্গীত প্রতিভাবান শিল্পী। তবলায় রোহেন বোস, সেতারে কৌস্তভ মজুমদার, নৃত্যে সঙ্গীতা চ্যাটার্জি, ক্ল্যাসিকাল ভোকালিস্ট রননজয় কুলকার্নি। শ্রী দুর্গা কাহিনীর ইংরেজি ধারাভাষ্যে ছিলেন শ্রীমতি চন্দ্রা চক্রবর্তী। 

দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ও প্রাণের ধর্মীয় উৎসব। দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলে তাকে দুর্গা বলা হয়। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে যে দেবীর জন্ম হয় তিনিই দুর্গা। মহিষমর্দিনী দশপ্রহরণধারিণী দেবীর আবাহন অর্থাৎ মহালয়া। দিনটি এ বছর ১৭ সেপ্টেম্বর। আশ্বিনের শারদ প্রাতে জগতের দুঃখ-ক্লেশ-তাপ, সকল নৈরাজ্য, অন্যায়-অনাচার, হিংসা-দ্বেষ এবং সকল সংকট থেকে মানুষের মুক্তির জন্য দুর্গতিনাশিনী দুর্গাকে স্মরণ করে প্রার্থনা করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ।

শুরুতেই ধ্যান-শ্লোকের সাথে নাচ দিয়ে শ্রী শ্রী দুর্গার আবাহন শুরু হয়। সঙ্গীতা চ্যাটার্জী শ্রী দুর্গার প্রতিভাস হয়েই নাচে রূপ দিয়েছেন। মনে হচ্ছিল ত্রিনয়নী মা দুর্গা নিজেই আবির্ভূত হয়েছেন। নাচে এই গুণী শিল্পীর সাথে সঙ্গ দিয়েছেন তারই দুই ছাত্রী কবিতা বসাক ও স্নেহা বোসলে।

পৌরাণিক মতে দুর্গার সাথে মহিষাসুরের যুদ্ধের যে তাণ্ডব চিত্র দেখা যায়, আজকের অনুষ্ঠানে তা ফুটিয়ে তোলা হয় তবলা দিয়ে। কলকাতা থেকে রোহেন বোস মহিষাসুরের চরম উগ্রতা ও ধৃষ্টতার সেই পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তবলার বোল দিয়ে । তবলার  প্রথিতযশা বোস পরিবারের ছেলে রোহেন তার প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন।

মহিষাসুরকে বধ করতে সকল দেবতাদের প্রার্থনায় মা দুর্গা মর্ত্যে নেমে আসেন। সেই কাহিনীর মর্মকথা তুলে ধরা হয় কলকাতার ছেলে কৌস্তভ মজুমদারের সেতারে রাগ মালকোষে। ললিত সুরের মূর্চ্ছনা এতটাই প্রবল ছিল যে, শ্রোতারা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অমিয় ধারায় তার এ বাজনা নিকট ভবিষ্যতে তাকে আরো বড় সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাবে।

দুর্গার যুদ্ধের প্রস্তুতিকল্পের সংকল্প রূপদান করেছে মুম্বাই থেকে রননজয় কুলকার্নি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে 'হে চণ্ডী দুঃখ খণ্ডি...' গানটিকে  রণজয়ের সিংহদ্বারে নিয়ে গেছেন তার মায়াবী কণ্ঠের জাদু দিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রোতারা সাময়িক ইন্দ্রজালে বন্দি হয়ে পড়েছেন।

এবার মহিষাসুর বধের পালা। দুর্গা যুদ্ধের ময়দানে নামলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের নবম তিথিতে  (ষষ্ঠী থেকে নবমী) দুর্গা মহিষাসুরকে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন। সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠল। দেবী চরণে সকলের প্রণতি, "সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।" সমাপ্তির এ চিত্রটি চিত্রিত হয়েছে সঙ্গীতা চ্যাটার্জীর নাচের মধ্য দিয়ে। সর্বাত্মক মেধা উজাড় করে দিয়ে তিনি চিত্রকল্পটি ফুটিয়ে তুলেছেন। নাচের মুদ্রা, অঙ্গভঙ্গি এবং ক্রমিক গতি বা চলন অর্থাৎ সব মিলিয়ে শ্রোতাদের এই গুণী শিল্পী বিমোহিত করে রেখেছেন।

শ্রী দুর্গার জন্ম বৃত্তান্ত চন্দ্রা চক্রবর্তী গ্লোবাল অডিয়েন্সের কারণে ইংরেজিতে দিয়েছেন। দুর্গার যে তেজোময় ভাব, ঠিক সেই ভাবটিই তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। তেজোদীপ্তভাবে কণ্ঠ থেকে প্রতিটি শব্দ বের হয়ে এসেছিল। ধারাবাহিক বর্ণনার সাথে সাথে প্রতিটি দৃশ্যের রূপায়ন অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। অগণিত দর্শক শ্রোতা আজকের পর্বে যুক্ত হয়েছেন। লাইক শেয়ার কমেন্টও অগণিত। যদিও এটি অনলাইন তথাপিও এতে বোঝা যায় অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের কাছে ভীষণ ভাল লেগেছে। এমন অনুষ্ঠান স্টেজে পারফর্ম করতে পারলে আরো অনেক বেশি ভাল করা যেত। সংক্ষিপ্ত আকারে এমন অনলাইন মিউজিক শো দিয়ে একটি মিথকে তুলে ধরার মতো সৃষ্টিশীল কাজ ভার্চুয়াল জগতে এ প্রথম। এমন সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি হিসাবে কলাকার আর্টস নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে।

৫ সেপ্টেম্বর প্রথম পর্বের দুটো সেশন ছিল। প্রথম সেশনে দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা। দ্বিতীয় সেশনে ছিল এই চার শিল্পীর একক পরিবেশনা। একক পরিবেশনাটিও খুবই চমৎকার ছিল। প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। এ পর্বের ব্যাপ্তিকাল ছিল সাড়ে তিন ঘণ্টা।

৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় পর্বে কলকাতা থেকে শ্রী দেবপ্রিয় ও শ্রী সমন্বয় যোগ দেন। যুগলবন্দি সুরবাহার ও শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পীর অপূর্ব সমন্বয়ে কাত্যায়নী স্তুতি এক স্বর্গীয় আবেশ সৃষ্টি করে। তারপর একে একে আরো অনেক ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এ দুইজন শিল্পীর এতো বেশি বোঝাপড়া ছিল যা না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, ওরা কত উঁচু মানের শিল্পী! যেমন কণ্ঠের জাদু ঠিক তেমনি সুরবাহারের বাজনা! যাকে বলে সোনায় সোহাগা। উল্লেখ্য এ দুইজন বেনারস ও লাক্ষ্ণৌ ঘরানার শিল্পী।

উদীয়মান তরুণ তবলা বাদক শ্রী আয়ুষ্মান মজুমদার বয়সে তরুণ হলেও বাজনায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন ঠিক বড়দের মতো। তবলায় হাতের কারুকাজ ছিলো দৃষ্টিনন্দন।

কলাকারের প্রতিটি পর্বই শতভাগ সফল ও সার্থক। 'দ্য গডসেন্ডস' নামে  ধারাবাহিক মাসিক অনলাইন অধিবেশনে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দুটো অনুষ্ঠান ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত তথা জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েরাও যে তাদের স্ব -স্ব ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল কাজের অংশীদার হতে পারে তারই পরিচয় এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়।

দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের সহায়তা করতে ইউনিসেফ এর সাথে কাজ করেছে কলাকার। এ কারণে গত ১৪ অগাস্ট ভারতীয় স্বাধীনতা দিবসে ইস্ট-ওয়েস্ট মিউজিক্যাল ব্যান্ড- 'মিউজিক্যাল মাস্ক' নামে একটি অনবদ্য অনুষ্ঠান করেছে তারা। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিশোর-কিশোরী। এ অনুষ্ঠানে যে অর্থ পাওয়া গেছে তার পুরোটাই ইউনিসেফ এর তহবিলে জমা হয়েছে।

৪০তম পর্বও অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। একটি মিথকে মিউজিক দিয়ে ফুটিয়ে তুলে শ্রোতাদের তার রসাস্বাদন করানো একজন বিদুষী শিল্পীর প্রকৃত শিল্পীসত্ত্বার পরিচয় প্রমাণ করে। সৃষ্টিশীল শিল্পের প্রতি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর যে  আবেগ ও উচ্ছ্বাস সেটাই কলাকার সার্থকভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে পুরো পৃথিবী স্তব্ধ। কোভিড-১৯ এর লকডাউনে থাকা প্রতিভাবান তরুণ সঙ্গীত শিল্পীদের কাজের অভাবে বেশ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ স্থবির সময়ে তাদের পাশে থাকার কথা কলাকার আর্টস, ইউকে হৃদয় থেকে তাগিদ অনুভব করেছে। তাই তাদেরকে উৎসাহ প্রদানের জন্য কলাকারের প্রধান নির্বাহী, বিদুষী শ্রীমতি চন্দ্রা চক্রবর্তী বিশ্বজুড়ে এই তরুণ প্রতিভাবানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করছেন এবং তাদের অংশগ্রহণের জন্য একটি ফি প্রদান করছেন। শ্রীমতি চন্দ্রা চক্রবর্তী নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এ প্রণোদনার কাজটি করে চলেছেন।

এ বছর ১৮ জুন চন্দ্রা চক্রবর্তীর গুরু পণ্ডিত এ কানন-এর জন্মশতবার্ষিকী। তিনি বলতেন, "মানবতার দায় অপরিসীম। তাই মানুষকে ভালবাসলে, মানুষের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায়। একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে এটাই বড় মানবিকতা।"

এমন মানবতাবাদী বাণীকে স্মরণ করেই চন্দ্রা চক্রবর্তী গুরু পণ্ডিত এ. কাননের জন্মশতবর্ষে একের পর এক সর্বোচ্চমানের অনুষ্ঠান করে চলেছেন ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ ধারাকে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গীত পিপাসুদের কাছে পৌঁছে দিতে। এটা গুরুর প্রতি শিষ্যের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ্য। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ফেইসবুকে উস্তাদ শাহিদ পারভেজ, উস্তাদ মাশকুর আলী খান, উস্তাদ মুরাদ আলী খান, উস্তাদ সুজাত খান, উস্তাদ রাশিদ খান, পণ্ডিত তন্ময় বোস, পণ্ডিত গৌরব মজুমদার, পণ্ডিত রূপক কুলকার্নি, পণ্ডিত স্বপন শিবা, পণ্ডিত বিজয় কিসলু, পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোস, পণ্ডিত হিন্দোল মজুমদার, পণ্ডিত সঞ্জু সাহাই, পণ্ডিত দেবাশীষ ভট্টাচার্য, আচার্য্য পণ্ডিত জয়ন্ত বোস, পণ্ডিত কুমার বোস, পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জী, পণ্ডিত ধরম্বির সিনহা, পণ্ডিত তুষার দত্ত, পণ্ডিত রণজিৎ সেনগুপ্ত, পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, বিদূষী শুভ্রা গুহা, বিদুষী সুমিত্রা গুহ, অনুপ জালোটা, ড. রাধিকা চোপড়া, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, ড. মানসী মজুমদার,  বিদুষী রাজশ্রী ঘোষ, আরশাদ আলী খান, শ্রী অনুপ কুমার বিশ্বাস, শ্রীমতি শিরিন সেনগুপ্তা, শ্রীমতি শ্রাবনী সেন, শ্রীমতি বর্ণালী চট্টোপাধ্যায়,  শ্রীমতি সুপ্রিয়া দত্ত, শ্রীমতি ইন্দ্রানী দত্ত, শ্রীমতি শতরূপা ঘোষ, লাইসা আহমেদ লিসা, উর্বী অধরা, পূর্বা মধুরা, রৌনক পাল, আর্চিক ব্যানার্জী, আয়ুষ্মান মজুমদার, রাজশ্রী সেনগুপ্তা, রিম্পা শিবা, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্য সহ আরও বিখ্যাত সব সঙ্গীতজ্ঞ এবং নতুন প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান শিল্পীরা উপস্থিত হয়েছেন কলাকারের আয়োজনে।

চন্দ্রা চক্রবর্তী, নন্দিত এই ভারতীয় ধ্রুপদী কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত এ.কানন, শ্রীমতি মালবিকা কানন এবং ঠুমরি রানী খ্যাত পদ্মবিভূষণ শ্রীমতি গিরিজা দেবীর কাছে সঙ্গীতের ইতিবৃত্ত ও ধ্রুপদী  শিক্ষা নেন। তিনি 'সঙ্গীত  গবেষণা একাডেমি'-তে বিশেষ সম্মানে ভূষিত শিক্ষার্থী ছিলেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও'র জাতীয় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এবং ন্যাশনাল স্কলার । দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়টারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক (সঙ্গীতে ইতিহাস, সমাজ ও উন্নত গবেষণা) ছিলেন। বর্তমানে লন্ডনে বরা অভ্ মেরটনের একটি লাইব্রেরি ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছেন।

তিনি কলাকার আর্টস, ইউকে'র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। তার মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে কলাকার আর্টস, ইউকে অনলাইন দুনিয়াতে স্বল্প সময়ে ভূয়সী প্রশংসা লাভে সমর্থ হয়েছে।

(প্রবাসীদের এ অনুষ্ঠানটি দোদুল এআর ফেইসবুকে দেখে ঢাকা থেকে রিভিউ করেছেন।)  

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!