ভ্রমণ কাহিনি: জাপানে গিয়ে কী শিখলাম

আমাদের তীব্র পানি তৃষ্ণা পেয়েছিল হাকাতা স্টেশনে পৌঁছার পর। সুন্দর ঝকঝকে তকতকে রেল স্টেশন, তবে কোন মানুষ চোখে দেখলাম না।

মোহাম্মদ আজিজুল মওলা, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2020, 02:18 AM
Updated : 22 August 2020, 02:18 AM

চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি আর সফরসঙ্গী আমার স্যার ছাড়া স্টেশনে কোন জনমানব নেই। মনে মনে একটু একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মিনিট দশেক পরে দেখলাম এক ভদ্রমহিলা একটি ছোট্ট দোকানের শাটার খুলছেন।

বলছিলাম জীবনে প্রথম জাপান সফরের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা। জীবনে প্রথমবার যখন জাপান যাই আমার কাছে ওদের সবকিছুই নতুন মনে হয়েছে। ফুকুওকা, ইয়ামাগুচিছি, হিরোশিমা একেকটা শহরের সেটআপ একেক রকম।

জাপান যাওয়ার আগে বুলেট ট্রেনের নাম শুনেছি, কখনো দেখিনি। ফুকুওকা এয়ারপোর্ট থেকে ইমিগ্রেশন শেষ করে ডলার ভাঙিয়ে ট্যাক্সিক্যাবে উঠলাম। ১০ মিনিট চলার পর ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম, নাম হাকাতা স্টেশন। জাপানের ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া এবং দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন শিনকানসেনের ভাড়া একটু বেশি মনে হল। ট্রেনের সিস্টেম দুই প্রকার, একটা রিজার্ভ সিস্টেম- ভাড়া বেশি আর আপনার জন্য সিট বরাদ্দ থাকবে, আরেকটা হল জেনারেল। 

জাপানিদের সততা, ভদ্রতা, মানুষকে শ্রদ্ধা ও সাহায্য করার প্রবণতা প্রশংসনীয়। জাপানিদের শুধু একটি দুর্বলতা আমার চোখে পড়েছে, সেটা হলো ল্যাঙ্গুয়েজ স্কিল বা কমিউনিকেশন স্কিল। খুব কম সংখ্যক জাপানি ইংরেজি শিখে, বুঝে এবং কথা বলতে পারেন, আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে।

যা হোক, আমরা দুজনই গেলাম ওই ভদ্রমহিলার কাছে। ইংরেজিতে বললাম আমাদের পানি দরকার। তিনি সেলফে রাখা কিছু স্বচ্ছ কাচের বোতল দেখালেন। আমরা দুটি বোতল নিলাম আর সঙ্গে কিছু বাদাম, জাপানি নোট দিলাম। তিনি জাপানি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন আমাদের ছোট নোট আছে কিনা! মাথা নেড়ে বললাম আমাদের কাছে এর চেয়ে ছোট নোট নেই, আমরা আজই এসেছি জাপানে।

স্বচ্ছ কাচের বোতলগুলো আমার হাতে দিয়ে, ভ্রু কুঁচকে কষ্ট করে অনেকগুলো কয়েন ও ছোট নোট ফেরত দিলেন। একটি বোতল খুলে খাওয়া শুরু করলাম, দেখি এটি স্পার্ক্লিং ওয়াটার। খেয়ে শান্তি লাগলো না। আবার গিয়ে অন্য বোতলটি ফেরত দিয়ে বললাম আমাদের পিউর ওয়াটার দরকার। তিনি হাসিমুখে বোতলটি ফেরত নিয়ে প্লাস্টিকের দুই বোতল পানি দিলেন।

ঝটপট হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি দৌড়ে এগিয়ে আসলেন। তিনি বললেন ইশারায়, সাথে কিছু ভাঙা ইংরেজি শব্দ আর জাপানি শব্দের মিশ্রণে। আরো কিছু কয়েন ফেরত দিলেন। আমার কাছে বিষয়টি একটু অদ্ভুতই লেগেছে।

যা হোক, আরো ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম। হঠাৎ করে কোত্থেকে একটা ট্রেন এসে হাজির । দুই-এক মিনিট যেতে না যেতেই দেখলাম প্যান্ট এবং শার্ট একসাথে বিশেষ ভাবে তৈরি সাদা রঙের ইউনিফর্ম পরে ১২-১৫ জনের একটা টিম। ওরা আসলে ট্রেনের কামরা পরিষ্কার করতে এসেছে। প্রায় ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন রেডি। আর পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই কয়েকশ লোক হাজির। আমার কাছে সবকিছু অদ্ভুত লাগছিল। রিজার্ভে টিকেট সংগ্রহ করে বুলেট ট্রেন শিনকানসেনে চেপে বসলাম।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চার মিনিট পর ট্রেন ছেড়ে দিল। সে এক অন্যরকম ভাললাগা অনুভূতি। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলাম বাইরের জগত আর ট্রেনের ভিতরের দৃশ্য। দুর্বার গতিতে ট্রেন ছুটে চলল ইয়ামাগুচিসির দিকে। মোবাইল অন করে ভিডিও করতে থাকলাম দুই-এক মিনিটের জন্য। ট্রেনের স্পিড উঠছে তো উঠছে ৪৩০ কিলোমিটার পার আওয়ার গিয়ে ঠেকলো।

ডিসপ্লেতে সব দেখা যাচ্ছে, কত স্পিডে চলছে, কোন স্টেশনে পৌঁছলো  আর সামনে কোন স্টেশন আছে। ট্রেনের ভিতরের মানুষগুলোর কোন সাড়াশব্দ নেই, নেই কোন ট্রেন চলার শব্দ, শুধু বাতাসের একটি শব্দ কানে বাজছে। চুপচাপ বসে কেউ বই পড়ছে, কেউ করছে ল্যাপটপে কাজ, আর কেউ পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।

হিরোশিমা শহরে আসার দ্বিতীয় দিনে আমাদের জাপানি মুদ্রা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডলার ভাঙাতে ব্যাংক খুঁজছি দুজন মিলে, পরিশেষে একটি ব্যাংক পেয়ে গেলাম। ঢুকে দেখি বড় একটি ব্রাঞ্চে টোটাল মানুষ আছে চারজন। একজন দারোয়ান কাম গাইড, আরেকজন ক্যাশ অফিসার, একজন কাস্টমার সার্ভিস অফিসার কাম আইটি অফিসার এবং আরেকজন ম্যানেজার।

এখানে দুইটা সিস্টেম আছে, অটো এবং ম্যানুয়াল সার্ভিস। একটি মেশিন দেওয়া আছে, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ওই মেশিনটা চিনতে পারে। আপনি কমান্ড দিবেন জাপানি মুদ্রা বের হবে ওইদিন ওই সময়ে এক্সচেঞ্জ রেট যত সে হিসাবে। আপনার যদি জাপানের কোন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে তবে ওই একই মেশিন দিয়ে টাকা জমা করতে পারবেন, কোন ক্যাশ অফিসার প্রয়োজন নেই, সবকিছু আপনি করবেন নিজে নিজে। আপনার করতে যদি অসুবিধা হয় সহযোগিতা করার জন্য ওই দারোয়ান কাম গাইড আপনাকে সহায়তা করবে।

আমরা ম্যানুয়াল সিস্টেমে গেলাম, কাস্টমার সার্ভিস অফিসারকে আমাদের পরিচয় দিলাম এবং পাসপোর্ট দেখালাম। তিনি জাপানি ভাষায় আমাদেরকে অভিবাদন জানালেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে সার্ভিস শেষ করে মাথা নেড়ে বিদায় জানালেন।

ব্যাংক থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, চারদিক দেখতে থাকলাম। দেশে-বিদেশে নতুন কোন শহরে আসলে আমি প্রায় সময়ই হেঁটে হেঁটে শহরের বিভিন্ন স্থাপনা দেখে কিছুটা সময় পার করতে পছন্দ করি।

হিরোশিমা শহরটি অনেক পুরাতন। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত একটি শহর। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন প্রায় শেষের পথে, তখন অগাস্টের ৬ এবং ৯ তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

সবগুলো হোটেল এবং রাস্তাঘাট বিদেশি পর্যটক ও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক দলের লোকজনে লোকারণ্য। আমরা হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন স্থাপনা দেখছি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। জাপানিরা ছবি তুলতে খুব একটা চায় না। তবে একটা সুন্দর কালচার আছে, সেটি হল কেউ যখন ছবি তুলে তখন তার সামনে দিয়ে কেউ যাবে না, যদি কেউ হেঁটে বা সাইকেল নিয়েও যায় সে দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই ব্যক্তির ছবি তোলা শেষ হবে। এই সময়টিকে তারা সময় নষ্ট মনে করে না, বরং তারা সম্মান করে অতিথিদের।

সন্ধ্যায় কিছু ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিস কেনার জন্য বের হয়েছি হোটেল থেকে। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম সারি সারি ইলেকট্রনিক্সের দোকান আর কিছু বিশ্ব-বিখ্যাত চেইন শপ। একটাতে ঢুকে পড়লাম, এটিতে টোটাল ফ্লোর সাতটি। একটা কোম্পানির সেলস অ্যান্ড ডিসপ্লে সেন্টার এটি। আবারও অবাক হলাম, ক্রেতা আছে অনেক কিন্তু বিক্রেতা আছে প্রতি ফ্লোরে মাত্র দুই জন করে। সেই হিসাবে পুরা সেলস সেন্টারে মানুষ আছে ১৪ জন।

এত কম লোক দিয়ে এত বড় একটা সেলস সেন্টার জাপানিরা চালাচ্ছে। এখানে দুটি কারণ থাকতে পারে এখানে আইনশৃঙ্খলা খুবই ভালো, কারণ মানুষগুলো ভালো। কেউ কারো জিনিস বা টাকা-পয়সা ছুঁয়েও দেখে না, নেওয়া তো দূরের কথা। আরেকটি কারণ হতে পারে এটি প্রযুক্তিনির্ভর দেশ, এখান থেকে কেউ কোনো কিছু নিয়ে পালানোর কোন সুযোগ নেই।

তখন মনে পড়ল আমাদের চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমুন্ডি লেনের সারি সারি দোকান আর মার্কেটের কথা, একেকটি ছোট দোকানে কমপক্ষে তিন থেকে চারজন ক্ষেত্র বিশেষে ৬/৭ জন কাজ করে। ঈদের মৌসুমে আসলে মনে হবে বড় কোনো মেজবান বা মেলায় এসেছেন।

আমাদের কেনাকাটা শেষ করে একদম নিচের ফ্লোরে ক্যাশ কাউন্টারে এসে পেমেন্টের জন্য দাঁড়ালাম। আমাদের চেহারা দেখেই ম্যানেজার বুঝতে পারলেন আমরা জাপানে থাকি না। ম্যানেজার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমাদের পাসপোর্ট আছে কিনা সঙ্গে। বললেন আপনারা ট্যাক্স রিটার্ন পাবেন, যদি পাসপোর্ট শো করেন। আমরা পাসপোর্ট দেখালাম তাকে। তিনি আমাদের ব্লু পাসপোর্ট তার হাতে নেওয়ামাত্র অভিবাদন জানালেন।

বিদায় নেওয়ার সময় তিনি তার সেলস সেন্টারের শেষ দরজা অবধি এসে আমাদের পুনরায় জাপানি স্টাইলে মাথা নিচু করে বিদায় অভিবাদন জানালেন। কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ করে ট্যাক্স রিটার্ন পাওয়ায় এমনিতে মনের মধ্যে একটা খুশি আসলো, তার ওপর এ ধরনের সম্মান একটি বাড়তি পাওয়া। বিদেশের মাটিতে আমার দেশের সরকারি পাসপোর্ট (নেভিব্লু অফিসিয়াল পাসপোর্ট) এর প্রতি সম্মান জানানো ভদ্রলোকটির চেহারা এখনো আমার চোখে ভেসে আছে।

লেখক পরিচিতি: ডেপুটি সেক্রেটারি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!