ঘুরে এলাম সুইডেনের উত্তরবঙ্গে

সুইডেনে থাকি, এবারের ঈদে ইচ্ছা ছিল দেশে যাবো। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ফ্লাইট বাতিল হলে। ‘প্ল্যান বি’ হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আশপাশের দেশে যাবো, কিন্তু তারাও লাল পতাকা দেখালো।

ফরহাদ প্রধান, সুইডেন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2020, 07:27 AM
Updated : 5 August 2020, 07:27 AM

রাগে দুঃখে সিদ্ধান্ত নিলাম গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যাবো, যেদিকে দু’চোখ যায়।  সুইডেনের উত্তর দিকের রাস্তা হলো একদম সোজা, যাকে বলে ইউরোপিয়ান হাইওয়ে। যেতে যেতে শহরগুলো দেখবো, কারো বাসাতে রাতে থাকবো না।

বউ বললো, আবহাওয়া কেমন থাকবে? আমি বললাম, প্রচণ্ড গরম থাকবে। এটি বলার কারণ বউ যাতে বেশি কাপড় বা সুটকেস না নেয়। ২৩ জুলাই যাত্রা হলো।  প্রথমেই গাড়িতে তেল নিয়ে আমি বউ এবং আমাদের দুই সন্তানকে নিয়ে রওনা দিলাম। ইনভিকেন নামক জায়গাতে নদীর ধারে প্রথমে দাঁড়ালাম।

একটু চা খাবো ভেবেছিলাম। আমাদের সবার পরনে হাফপ্যান্ট জাতীয় পোশাক! তবে ঠান্ডায় মনে হলো সব জমে যাবে, সঙ্গে আছে প্রচণ্ড বাতাস। হালকা জ্যাকেট পরেও কাজ হলো না। চা না খেয়েই একটানে চলে গেলাম বলনাস নামক জায়গাতে। বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট মালিক আমার পরিচিত বন্ধু মানুষ।  বিনা পয়সায় হেভি খানাদানা হলো।

আরো কয়েকটি ছোটখাট ব্রেক নিয়ে পৌঁছে গেলাম সুন্ডসবল। ছোট শহর হলেও অৰ্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এখানে আছে সুইডেনের চতুর্থ লম্বা সেতু, যা প্রায় ৭ হাজার ফুট লম্বা। এই ব্রিজে উঠতে আলাদা করে টোল দিতে হয় সবাইকে। গাড়ির মালিকের বাসায় টোলের বিল চিঠি হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখানে বুকিং দিয়েছি পুরাতন একটি সামার কটেজ। এটি দেখে মাথা নষ্ট অবস্থা, ৮০ বছরের পুরনো বাড়ি, না আছে টয়লেট না আছে পানি।

ঠিক এর পাশেই একই মালিকের আছে চমৎকার একটি আধুনিক সামার কটেজ। তবে দাম একটু বেশি। কোন কিছু চিন্তা না করেই পুরাতনটি বাদ দিয়ে বেশি টাকায় নতুনটিতেই উঠে পরলাম। সন্ধ্যায় মাটফর্স নামে একটি পিচ্চি পুরাতন শহর ঘুরে বেড়ালাম।  খুব সুন্দর ছোটখাট ছিমছাম শহর। প্রায় সব বাসা জুনগান নদীর পারে ঘেঁষে, বেহেশতি আবহাওয়া।

২৪ জুলাই সকালে শুরু হলো বৃষ্টি। ফলে রুমেই বউয়ের সঙ্গে ‘আলু কেন গোল’ আলোচনা করলাম। দুপুরে গেলাম মূল শহর দেখতে। খুব সুন্দর রঙিন বিল্ডিং। দেখার মত হলেও মূল সিটি আসলে ছোট এরিয়া। হেঁটে হেঁটেই ঘুরে দেখা যায়। বিকেলের দিকে বিশাল একটি ব্ৰিজ পার হয়ে গেলাম বির্স্টা সিটি শপিং সেন্টারে। বাকিটা ইতিহাস! প্রায় ১০ বছর আগে নির্মিত সুইডেনের এ বিখ্যাত শপিং মলে নব্বইটির বেশি ব্রান্ডের দোকান আছে। এর আশপাশে আরো কিছু বড় বড় ব্রান্ডের দোকান আছে। 

২৫ জুলাই। একটানে উমিও শহরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম তাজমহলে।  দিল্লির তাজমহল দেখিনি, তবে এখানের খাবারের মান মোটামুটি। তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম ফেলেপ্তিও শহরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে আবাসিক হোটেলে থাকবো। শনিবার রাত, তাই বাচ্চাদের রুমে রেখে আমি আর বউ রাতের শহর দেখতে বের হলাম। শহরের মাঝে একটি জায়গা মনে হলো রেড লাইট এলাকা। বেশি টাকা ও চমৎকার লোকেশন হলেও হোটেলটিকে ভালো লাগেনি। কিছুটা অপরিষ্কার মনে হয়েছে। হালকা বৃষ্টির কারণে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারিনি।   

২৬ জুলাই। আজকে রোদ চমৎকার লাগছে। সকালেই হোটেল ছেড়ে দিয়ে শহরের নদীর পাশে মডেল ফটোশুট করলাম। সরকারিভাবেই অনেক কিছু তৈরি করা হয়েছে। যাতে সবার মন ভালো হয়ে যায়, আছে ছবি তোলার জায়গা, নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেও পারবেন। এরপর মিউজিয়াম ও নামকরা বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং দেখলাম, এরপর গেলাম বনস্তান দেখতে।

প্রায় ২০০ বছর বা তারও আগে এটি নির্মিত হয় একটি চার্চকে ঘিরে। দূর দূরান্ত থেকে মূলত নৌপথে এ চার্চে এলে সাময়িক থাকা খাওয়ার জন্য ৩০০ সামার কটেজ তৈরি করা হয়। পুরাতন আমলের পাড়া, ছোট ছোট অনেকগুলো বাড়ি।  কি একটা অজানা আকর্ষণ আছে এ বাড়িগুলোর দিকে তাকালে। অনেকগুলো বাড়ির সামনে চেয়ার টেবিল রাখা আছে, যে কেউ সেগুলোতে বসে আড্ডা দিতে পারে, পুরো এলাকা ফ্রি। দেখতে যেতে পারেন, খারাপ লাগবে না।

এরপর ছোট্ট একটি ঝুলন্ত সেতু হেঁটে পার হয়ে গেলাম ক্যরখলমেন ক্যাফে। আহামরি কোন খাবার না হলেও দাম বেশি না। ভালোই লাগলো। এরপর ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে গেলাম জাভি লাইটহাউজ দেখতে। আমি এবং ছোট ছেলে সিঁড়ি বেয়ে লাইটহাউসের একদম উপরে উঠলাম। প্রচণ্ড বাতাস, তবে মজা আছে। প্রচুর ট্যুরিস্ট থাকায় আর দেরি করিনি। তাড়াতাড়ি আবার রওনা হলাম পিতি শহরে। এটাও ছোট্ট শহর। হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। সুন্দর গোছানো। এখানে পিজ্জা খেলাম। এরপর আরো ঘুরে গেলাম লুতি শহর থেকে একটু দূরে সামার কটেজে। এ শহরে বসবাসকারী ডাক্তার ভাবি অনেক অনেক খাবার পাঠিয়েছেন।

২৭ জুলাই। সকালে নাস্তা খেয়েই গেলাম লুতি স্টরফরসেন দেখতে। এটিকে ইউরোপের খুব সুন্দর জায়গা বলা হয়। এটি আসলে একটি বিশাল ঝর্ণা। মূল ঝর্ণার পাশেই আবার পাথরের উপর গ্রিল করা, গোসল করা ইত্যাদি সব সুযোগ সুবিধা আছে। সত্যি চমৎকার একটি জায়গা। অনেক অনেক ছবি তুলেছি।  এখান থেকে ফিরতে মন না চাইলেও কিছু করার নেই। বিকেলে গেলাম শহর দেখতে। সেখানে মূল শহর লুতি’র হার্ট এর জায়গা দেখলাম। সেখান থেকে গেলাম এ শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা যেখান থেকে পুরোটা শহর দেখা যায়।

এরপর গেলাম ইউনিভার্সিটি দেখতে। সেখান থেকে গেলাম ফেইসবুকের সার্ভার বা ডাটা সেন্টার দেখতে। যদিও ভিতরে ঢুকতে দেয়নি, তবে বাহির থেকে যেটুকু দেখা যায় তাই দেখলাম। এরপর লঞ্চে করে ফিরে এলাম কটেজে। সঙ্গে ছিলেন এ শহরে বসবাসকারী সাঈদ ভাই। রাতে আড্ডাও হলো কিছুক্ষণ। খুব ভালো একটি সময় কাটলো।

২৮ জুলাই। আজ আবার বৃষ্টি। দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ফলে গাড়ি নিয়ে গেলাম ব্রান্ডন লজ, বোয়েন্দি ও আপলেভেলসার দেখতে। এলাকাটি ভালো। পরবর্তী গন্তব্য ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ গামেস্টাডেন। হাজার বছরের পুরনো একটি চার্চ এবং তাকে ঘিরে ঘরে উঠা এ গ্রামটি এখন মিউজিয়ামের মতো করা হয়েছে। অতীতের গ্রামের বাসাগুলো এখন এক একটি দোকান। হেঁটে হেঁটে ঘুরতে হবে। বেশ সুন্দর এবং দেখার মত জায়গা। ভুলেও কিছু খাবেন না এখানে। সব খাবারের ১০ গুণ দাম! 

২৯ জুলাই। আজ থেকে ফিরতি পথে চলা শুরু হলো। গাড়ি চালিয়ে চলে আসলাম পিট হ্যাভসবেড এলাকায়। এটি একটি আলাদা জগত। সমুদ্রের সাথে লাগানো অনেক অনেক কটেজ আছে। আছে বাচ্চাদের জন্য সত্যিকার থিম পার্ক।  আছে ইনডোর সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট আরো কত কি! পরেরবার আসলে এখানে থাকার চেষ্টা করবো। এখানে এলে সময় কীভাবে কেটে যাবে টের পাবেন না। অসাধারণ একটি জায়গা। বিশাল বিরতি নিয়ে উমিও শহরে যেতে যেতে রাত হয়ে গেলো। এখানে ফাস্ট ক্যাম্প নামক জায়গাতে কটেজ নিয়েছি।  

৩০ জুলাই। আজ বেশ ঠান্ডা এবং বৃষ্টি। তবু ঘুরতে বের হলাম, বিচ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দুপুরে ক্যাম্পে ফিরে আমরা আড্ডা দিলাম, বাচ্চারা সাইকেল চালালো। সময়টা বেশ ভালোই কেটেছে। বিকেলে গেলাম গান্ধী রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে। তাড়াতাড়ি খেয়ে এরপর শুভ এর বাসাতে গেলাম, কারণ আমার লাইভ অনুষ্ঠান ছিল। রাতে ক্যাম্পে ফিরে ঘুম।

৩১ জুলাই। আজ ঈদের দিন। তবে মসজিদে নামাজ পরতে যাওয়া হলো না, কারণ সরকারি বাধা নিষেধ। যাই হোক, ১০টার দিকে গেলাম সর্মজল হ্যাভসবেড সমুদ্রের লোনা পানিতে, ছেলেরা দুই ঘণ্টা ধরে সাঁতার কাটলো।  আমিও সাথে ছিলাম, বউ কিছুটা পানিতে নেমেছিল। পরে ক্যাম্পে ফিরে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে গেলাম শ্রাবণ ভাইয়ের বাসাতে ঈদের দুপুরের ভুরিভোজ করতে। খেয়ে আড্ডা দিয়ে এরপর গেলাম শুভ এর বাসায়। সেখানে কাঠের বল জাতীয় একটি বিশেষ খেলা খেলে ক্লান্ত হলে পরে তার বাসাতে রাতের ভুরিভোজ, সঙ্গে অফুরন্ত আড্ডা হলো। অনেক রাতে ক্যাম্পে ফিরে এলাম।

পহেলা অগাস্ট। সকালে নাস্তা খেয়ে ক্যাম্প থেকে চেক আউট করলাম। এরপর গেলাম সোজা হোজা কুস্টেন, এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে। হোটেল হাই কোস্টে আছে ফ্রি পার্কিং, টয়লেট, কিছু দোকান, রেস্টুরেন্ট, খেলার জায়গা এবং ঝর্ণা। সাথে আছে বিশাল ব্রিজের ছবি তোলার অপূর্ব সুযোগ। এখানেই কেটে গেলো অনেকটা সময়। এরপর গেলাম সুন্ডভ্যাল, সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে এরপর গেলাম গ্যাবল, সেখানে একটি বিশ্রাম নিলাম। এরপর প্রায় ২০ কিলোমিটার গিয়েছি।

হঠাৎ দেখি সামনের গাড়ির ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এক বুড়ো দম্পতি গাড়ি থেকে বের হবার সাথে সাথে পুরো গাড়িতে আগুন ধরে গেলো। একটুপর ফায়ার সার্ভিস এসে হাজির। আমি রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বোকার মত তাকিয়ে আছি। প্রায় ১ ঘণ্টা পর রাস্তা খুলে দিলে একটানে বাসাতে চলে এলাম। আহ শান্তি। 

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!