ভ্রমণকাহিনি: ইতিহাসের অলিতে গলিতে গ্রানাডা

মাঝে মাঝে ইতিহাস জানতে ও পড়তে ভালোই লাগে, কেননা ইতিহাসকে ভিত্তি করেই আজকের বর্তমান। ইউরোপিয় জীবনে এসে সেরকম ঐতিহাসিক এক শহর ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, যার নাম গ্রানাডা।

মাহমুদ হাসান গনী, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2020, 03:45 AM
Updated : 21 July 2020, 03:46 AM

বাস্তবিকে পশ্চিম ইউরোপের ওসমানিয়া আমলের এই শেষ ঐতিহাসিক নগরীর আলহামব্রা কমপ্লেক্স ভ্রমণ করে এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সচক্ষে দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। ছোটবেলায় বাসায় ইসলামের ইতিহাসের মোটা বইগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম। আম্মা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে মাস্টার্স করেছিল বিধায় বাসায় কিছু ইতিহাসের বই ছিল। ভালোই লাগতো ওসমানিয়া, উমাইয়া আমল আর খলিফাদের ইতিহাস জানতে। ওসমানিয়া আমলের গ্রানাডা শহর কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুসলমান আর খ্রিস্টানদের জন্য, তা আমার ভ্রমণ এবং ইতিহাসের সারাংশের ভিত্তিতে তুলে ধরছি।

তখন আমি ইরামুস মুন্ডাস বৃত্তি নিয়ে স্পেনের সেভিলা শহরে অবস্থান করছি পাঁচ মাসের জন্য। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গিয়েছিলাম ঐতিহাসিক গ্রানাডা শহর ভ্রমণে। বলে রাখা ভালো, গ্রানাডা শহরের আলহামব্রা কমপ্লেক্স স্পেনের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় টুরিস্ট আকর্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে আপনাকে মিনিমাম ২ সপ্তাহ আগে অনলাইনে   টিকেট কনফার্ম করতে হয়, যা গ্রীষ্ম মৌসুমে তা প্রায় এক মাস আগে গিয়ে পৌঁছায়।

তারপরও নির্ধারিত দিনে উপস্থিত হয়ে দেখতে পাবেন পর্যটকদের দীর্ঘ সারি। কারণ শুধু নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটকরাই একসাথে ভিতরে যেতে পারে তাদের জন্য নির্ধারিত শিফটে, কারো সকাল বা কারো বিকেলের শিফট, তা টিকেটে উল্লেখ থাকে। আপনার নির্ধারিত শিফটে উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করতে হবে নির্দিষ্ট  দলের সাথে ভিতরে ঢোকার। যেহেতু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা, সবরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান পর্যটকদের চাপ সামলাতে এবং পর্যটকরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে শহরটি ঘুরে দেখতে পারে। 

নবীজির (স) মৃত্যুর পর খলিফারা মনোযোগ দেয় ইউরোপে ইসলামের প্রসারে। তার ফলে সপ্তম শতাব্দীতে (৭১৬ খ্রিস্টাব্দে) উমাইয়ারা হিস্পানিয়া দখল করে নেয় স্পেনের বর্তমান আন্দালুসিয়া অঞ্চল, যা আন্দালুজ সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। আন্দালুসিয়া শব্দটি এসেছে আরবি আল-আন্দালুস থেকে, যা মুসলিম শাসকদের দেওয়া। আন্দালুজ সাম্রাজ্য যেখানে মুরিশবামুর রাজারা শাসন করতো উমাইয়া খলিফাদের অধীনে। মুররা প্রায় ৮০০ বছর, ৮ম-১৫দশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজত্ব করে আন্দালুসিয়া অঞ্চলে।

মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল গ্রানাডা, যেখানে ১১ শতকে শুরু হয় নাস্রিদ সাম্রাজ্য। চারশো বছর পর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডা যুদ্ধে রাজা মোহাম্মদ-১২ পরাজয় দিয়ে ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান হয়। রাজা মোহাম্মাদ-১২ বোআব্দিল নামে পরিচিত ছিলেন। যখন আমি গ্রানাডা ভ্রমণ করছিলাম, কেমন যেন অদ্ভুত শিহরণ খেলে যাচ্ছিল শরীরে ওইসব ইতিহাসের নিদর্শন দেখে। পাহাড়ের উপর আলহামব্রা নামের ছোট শহরটি এখন সযত্নে রক্ষিত পর্যটকদের জন্য। পুরো আলহামব্রা কমপ্লেক্স ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা, অর্থাৎ পরিকল্পিতভাবেই এই ছোট শহরটি সুরক্ষিত করে বানানো হয়েছে পাহাড়ের উপর যাতে শত্রুরা সহজে আক্রমন করতে না পারে।

কমপ্লেক্সে ভিতর পাহাড়ের উপর থেকে চারদিকেই পুরো গ্রানাডা শহর দৃষ্টি সীমার মধ্যে, যাতে শত্রুর আক্রমণের আগেই পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া যায় সহজে। কমপ্লেক্সের ভিতর আবাসিক স্থাপনাগুলো জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস সময়ক্রম অনুযায়ী সাজানো আছে যাতে পর্যটকরা বুঝতে পারে কখন কে শাসন করেছে গ্রানাডা।

গ্রানাডা মধ্যযুগের মুসলিম সাম্রাজ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ শহর যার পতনের মধ্য  দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের শেষ স্বাধীন মুসলিম রাজ্য ও ২০০ বছরের নাস্রিদ সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হয়। না হলে মুসলিমদের আগ্রাসন উত্তর স্পেনসহ ফ্রান্স পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারতো, ইউরোপের ইতিহাসও ভিন্নভাবে লেখা হত। গ্রানাডা যুদ্ধ ছিল খ্রিস্টানদের অস্তিত্বের লড়াই। ১০ বছর চলে গ্রানাডা যুদ্ধ, ক্যাথলিক রাজা ফারদিনান্দ ও রানী ইসবালার কূটকৌশলের কাছে নাস্রিদ সাম্রাজ্যের শেষ রাজা বোআব্দিল পরাজিত হন।

যুদ্ধ ১০ বছর ধরে চললেও, টানা যুদ্ধ হতো না। বসন্তকালে যুদ্ধ শুরু হয়ে শীতকালে বন্ধ হতো, আবার পরের বছর বসন্তে শুরু হতো। এভাবেই প্রায় দশ বছর চলার পর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে রাজা বোআব্দিল খ্রিস্টান সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর আগেও বহু যুদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু খ্রিস্টানরা কখনোই গ্রানাডা দখল করতে পারেনি এবং বিভিন্ন সময়ে উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি ছিল। কিন্তু খ্রিস্টানরা ভয়ে ছিল মুসলিম শাসকদের আগ্রাসন নিয়ে, বিশেষ করে কাস্তিলে ও আরাগন রাজ্য গ্রানাডার পতনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।
সেসময় কাস্তিলে রাজ্যের রানী ইসাবেলা বিয়ে করেন আরাগন রাজ্যের রাজা ফারদিনান্দকে এবং তাদের যৌথ বাহিনী আক্রমণ করে গ্রানাডাকে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই যুদ্ধের শেষ দিকে খ্রিস্টান বাহিনী ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে আট মাস ধরে গ্রানাডা অবরোধ করে রাখে। রাজা ফারদিনান্দ ও রানী ইসবালার একই সাথে রাজা বোআব্দিলের কিছু কাছের লোকদের প্রলোভন দেখিয়ে  নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়, যারা গোপনে খ্রিস্টানদের সহায়তা করতো। এরকম কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতা ও দীর্ঘ অবরোধ মিলিয়ে রাজা বোআব্দিল শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে করতে বাধ্য হয় এবং ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতন হয়।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘুরে দেখেছিলাম আলহামব্রা কমপ্লেক্স এবং এর অসখ্য স্মৃতিস্তম্ভ ও বিভিন্ন রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। ঐতিহাসিক জিনিসপত্র আর স্থাপনাগুলো দেখতে দেখতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকটি ঘণ্টা যেন ঘোরের ভিতর ছিলাম। সবশেষে পাহাড়ের সীমানা থেকে চারদিকের গ্রানাডা শহরের কিছু ছবি নিয়ে বের হয়েছিলাম। পথিমধ্যে এক দোকান থেকে আমার নামটি আরবিতে লিখিয়ে নিয়েছিলাম স্মৃতি হিসেবে প্রফেশনাল হস্তলেখা বিশারদ দ্বারা। পর্যটকদের অনেকেই দেখি যার যার নাম লিখিয়ে নিচ্ছিল ।

অবাক হচ্ছিলাম, ইউরোপের এমন জায়গায় আর বর্তমান কঠিন সময়েও অনেক মুসলিম ঐতিহ্য বিদ্যমান দেখে। আন্দালুছিয়া অঞ্চলের অনেক জায়গায় দেখেছি, স্প্যানিশরা কীভাবে মুরদর ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে চলেছে। ইতিহাস তো সত্যের আয়না যা কোন ধর্মের ছায়ায় মুছে যেতে পারে না।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!