আমিরাতে করোনাভাইরাস: রেমিটেন্স বেশি পাঠানো মানেও ‘অশনিসংকেত’!

কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেই আমিরাত প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম পাঁচমাসে বেশি রেমিটেন্স পাঠালেও সেটাকে ‘অশনিসংকেত’ হিসেবে দেখছেন সেখানকার বাংলাদেশি পেশাজীবী ও কমিউনিটি লিডাররা।

জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 July 2020, 05:22 PM
Updated : 12 July 2020, 05:43 PM

সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসীরা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে ৪২৯ কোটি টাকা জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠান। ২০২০ সালে ওই একই সময়ে দেশে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৫৩৩ কোটি টাকা।

আগের বছরের তুলনায় ১০৪ কোটি টাকা বেশি পাঠানোর পরও জনতা ব্যাংক, ইউএই শাখার অপারেশনের প্রধান নির্বাহী আমিরুল হাসান ঠিক সন্তুষ্ট নন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশে বেশি রেমিটেন্স গেছে এটা অবশ্যই আনন্দের। তবে শঙ্কাটা অন্য জায়গায়। সম্ভবত কাজ হারিয়ে বা ব্যবসা গুটিয়ে যারা দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তারা শেষ সম্বলটুকু রেমিটেন্স আকারে দেশে পাঠিয়ে যাচ্ছেন।  যার, কারণে রেমিটেন্সের এ স্ফীতি।”

আমিরুল হাসান জানান, সরকার করোনাভাইরাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। এজন্য ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য আছে।

আমিরাত প্রবাসীদের সংগঠন বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর আমিরাতে বহু বাংলাদেশি শ্রমিক এখন বেকার হয়ে গেছেন, তাদের কাজকর্ম নেই। আমরা জেনেছি, যে রেমিটেন্স প্রবাহ এখন দেশে যাচ্ছে তা গত বছরের তুলনায় বেশি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এটা হচ্ছে ক্লোজিং রেমিটেন্স।

মোয়াজ্জেম হোসেন

“এখানে সাত-আট লাখ বাংলাদেশি আছেন। সেখান থেকে এক-দুই লাখ লোক চলে গেলে তাদের ফাইনাল সেটেলমেন্ট বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রির অর্থ কিংবা গচ্ছিত টাকা দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেটি রেমিটেন্স হিসেবে এখানে যোগ হয়েছে। এখন তারা শুধু অপেক্ষায় আছেন বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে দেশে ফিরে যাবেন তার জন্য।”

তিনি আরও বলেন, “এ রেমিটেন্সকে কিন্তু কন্টিনিউয়াস প্রবাহ বলে আমরা ধরে নিতে পারি না। আরেকটা কথা হলো, দেশে যারা দীর্ঘমেয়াদী ছুটিতে যাচ্ছেন বা যেতে হচ্ছে তাদের ইস্যুটা। আমিরাতে অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের লোকজন ছুটিতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য আমাদেরকে একটা ফর্মুলা বের করতে হবে। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এদের প্রত্যাবর্তনের জন্য একটা কমিটমেন্ট আদায় করে নিতে হবে।”

“যেমন এই দেশে শ্রমিকদের দেখভাল করে ‘মিনিস্ট্রি অব লেবার’। তাদের মাধ্যমে কমিটমেন্ট আদায় করে নিতে হবে যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিকদেরকে কোনও ভিসা জটিলতা ছাড়াই, যেমন ভিসা এক্সপায়ার্ড হলেও যেন এদেশে ফিরিয়ে আনা যায় এবং আগে যে যেখানে ছিলেন সেখানে কাজ করতে পারেন।”

আবুধাবির শেখ যায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবুল হক খন্দকার বলেন, “রেমিটেন্স এর উপর কোভিড-১৯ এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পড়বে। যদিও স্বল্পমেয়াদে দেখা যাচ্ছে যে এ প্রভাবটা বড় করে পড়ছে না। কিন্তু এর বিশেষ ব্যাখ্যা হতে পারে যে প্রবাসীরা তাদের সেভিংস যা ছিল তারা দেশের স্বার্থে এবং দেশে পরিবার-পরিজনদের সমস্যার সময়ে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এরপরে একটা ঘাটতি দেখা দেবে।”

হাবিবুল হক খন্দকার

 

তবে তার মতে, কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য নির্মাণের কাজ করতেই হবে। সেকারণে বাংলাদেশিদের এ সংকট সাময়িক।  

হাবিবুল বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও নির্মাণ করবে। শ্রমিকের দরকার হবে। তখন বাংলাদেশি শ্রমিকরা আবার কাজে যোগ দিতে পারবেন। অতএব দীর্ঘমেয়াদে করোনাভাইরাসের প্রভাব সামলে উঠার সক্ষমতা আমাদের আছে বলেই মনে হয়।”

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রায়হান জামিল বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের বাংলাদেশিরা প্রকট একটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। আমি অনেককে জানি যারা গত চার মাসে একবারও বেতন পাননি।”

রায়হান জামিল

“তারা কেমন মানবেতর জীবনযাপন করছেন, তাদের সে কষ্টের কথা শুনলে- বিশ্বাস হতে চায় না যে এটা বাস্তবতা। এরকম একটা প্রভাব শ্রমবাজারে পড়েছে বা পড়বে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় যে অবস্থাটা ভালো হওয়ার আগে আরও অনেকখানি খারাপ হবে। সেজন্য আমার মনে হয় যাদের পক্ষে সম্ভব তাদের দেশেই চলে যাওয়া উচিত। এখানে যে কষ্ট করেন, দেশে সেটি করলে আরও ভালো করবেন হয়তো।”

আবুধাবির মাশরেক ব্যাংকের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার মেহেরুন্নেসা দীপা বলেন, “এমনিতেই গত আট বছর ধরে আমিরাতে আমাদের সব ধরনের ভিসা বন্ধ থাকায় আমাদের শ্রমবাজার স্থবির হয়ে ছিল। তার ওপর করোনা সংকট এলো। করোনাভাইরাস সংকটের নেতিবাচক প্রভাব আমিরাতের শ্রমবাজারে পড়বে।”

মেহেরুন্নেসা দীপা

“আমিরাতে কর্মরত বাংলাদেশি ভাইবোনেরা চাকরি হারাবার ভয়ে আছেন। এ সংকটের কারণে প্রবাসীদের যাদের দেশে ফিরে যেতে হবে, তাদেরকে সরকার একটি অর্থনৈতিক সুরক্ষার মধ্যে আনুক এটা আমাদের দাবি।”

দূতাবাসের কাছে স্পষ্ট কোন তথ্য না থাকলেও স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটি লিডার এবং দূতাবাস কর্মকর্তাদের ধারণা করোনাভাইরাস সংকটে এরই মধ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে গেছেন।

আমিরাতের সাথে বাংলাদেশের বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে খাদ্য ও অর্থকষ্টে দিশেহারা কয়েক হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরে যাবার অপেক্ষায় দিন গুণছেন।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!