জার্মানির প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা

জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখতে হলে দেশটির সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত জরুরি। জার্মানিতে যারা বসবাস করেন জার্মান ও বিদেশি তাদেরকে অবশ্যই একটা ঠিকানায় নিবন্ধিত হতে হয়।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2020, 06:28 PM
Updated : 20 June 2020, 06:28 PM

কোনও ঠিকানায় নিবন্ধিত হতে হলে বৈধ ভিসা ও পরিচয়পত্র অবশ্যই থাকতে হবে বিদেশিদের ক্ষেত্রে। এখানে বসবাসকারী প্রতিটা মানুষকে আবাসিক নিবন্ধন কার্যালয়ে আইনভোনারআমট (Einwohneramt)-এ নিবন্ধিত হতে হয়। কোন ঠিকানায় তারা বসবাস করছে, কেউ যখন পরিবারসহ বসবাস করে সে সমস্ত নথিও তাদের কাছে থাকে। পরিবারের কার বয়স কত সবকিছুই এই কার্যালয়ের নখদর্পণে থাকে। আইনভোনারআমট প্রত্যেক অধিবাসীকে একটা করে নিবন্ধন সনদ দিয়ে দেয়। এই নিবন্ধন সনদ খুবই জরুরী। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেই এই সনদের দরকার হয়। টেলিফোন লাইন, গাড়ির নিবন্ধন, বাচ্চাদের স্কুলে নিবন্ধনে দরকার হয়। কারও ঠিকানা পরিবর্তন হলে তিনদিনের মধ্যে এই কার্যালয়কে জানাতে হয়। ব্যতিক্রম হলে যত দেরিতে সে জানাবে ততদিনের সকল সরকারি সুবিধা-বঞ্চিত হতে পারে।

নতুন কোনও বাচ্চার জন্ম হলে বাবা-মাকে তার নিবন্ধন করাতে হয়। তাদের বাচ্চার জন্ম সনদের জন্য। জন্ম সনদ দেয় যুব কল্যাণ কার্যালয় ইউগেন্টআমট (Jugendamt)। কোন এলাকায় কত নতুন বাচ্চার জন্ম হল, সেখানে কিন্ডারগার্টেনের (Kindergarten) সংখ্যা কত, আসন সংখ্যা কত- এসব হিসেব তাদের কাছে থাকে। যদি কোনও এলাকায় শিশুর সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। কয়েক বছর আগে যখন সিরিয়া থেকে শরণার্থীর ঢল নামলো জার্মানিতে তখন কিন্ডারগার্টেন ও বিদ্যালয়ে যথেষ্ঠ আসন ছিল না। সে সময় অনেক জায়গায় দ্রুত কন্টেইনারের মধ্যে কিন্ডারগার্টেন ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রত্যেকটা কার্যালয় সঠিক সময়ে তাদের কাজগুলো সম্পন্ন করে এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যালয়কে অবহিত করে।

একটা শিশু তিন বছর বয়স থেকে কিন্ডারগার্টেনে যেতে পারে, কিন্তু বাধ্য না। কিন্ডারগার্টেন বাধ্যতামূলক শিক্ষা না। জার্মানিতে প্রচুর বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন আছে। এ সব বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোর বেশিরভাগ ধর্মীয় সমিতিগুলোর অধীনে। কোনোটা ক্যাথলিক, কোনোটা প্রোটেস্ট্যান্ট বা অন্য ধর্মীয় দলের। এসব কিন্ডারগার্ডেনগুলোতে বাচ্চারা কিছুটা ধর্মীয় শিক্ষা পেয়ে থাকে। সরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলো ধর্মীয় শিক্ষা মুক্ত। সরকারি বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষা মুক্ত থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে নীতি শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।

জার্মানির একটি বাচ্চাদের স্কুল।

বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা জার্মানিতে খুবই নগণ্য। সরকার বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করে। অবকাঠামোগত সকল শর্ত পূরণ না করে কারও পক্ষে কোনও কিন্ডারগার্টেন বা বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব না। একটা কিন্ডারগার্টেন স্থাপন করতে হলে সেখানে বাচ্চাদের খেলার জন্য মাঠ ও যথেষ্ঠ খেলার সরঞ্জাম থাকতে হবে। এই মাঠ অবশ্যই সেই কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের সংখ্যার অনুপাতে বড় হতে হবে। সেখানে বাচ্চাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বছরের বাচ্চাদের জন্য দুপুরে ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

প্রত্যেকটা কিন্ডারগার্টেনেই প্রায় বাচ্চাদের খেলার জন্য বালুর গাদা থাকে। বালু প্রতি দু'বছর অন্তর নবায়ন করতে হয়। এসব কিছু যুব কল্যাণ কার্যালয় তদারকি করে থাকে। সার্বিক অর্থে কিন্ডারগার্টেনগুলো বাচ্চাদের সেবা দেওয়ার জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু আর্থিক মুনাফার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় না।

আগেই বলেছি কিন্ডারগার্টেন বাধ্যতামূলক শিক্ষা না। বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তারা তাদের বাচ্চাদেরকে কিন্ডারগার্টেনে পাঠাবেন, কি পাঠাবেন না। তবে এরকম ঘটনা বিরল যে কোন বাবা-মা তার বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেনে পাঠায়নি। কারণ জার্মানিতে মায়েরা সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত মাতৃকালীন ছুটি কাটাতে পারে। এই ছুটি যে শুধু মা পেতে পারেন তা নয়, বাবাও ছুটি নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মা কাজ করবেন। তবে কোন মা যদি তিন বছর মাতৃকালীন ছুটিতে থাকেন তিনি পূর্ণাঙ্গ বেতন পান না। আবার কোন বাবা-মা আর্থিক প্রয়োজনে তিন বছরের আগে কাজ শুরু করলে, বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেনের আগের ধাপ কিন্ডারক্রিপে (kinderkrippe) অর্থাৎ বেবি কেয়ার সেন্টারে পাঠাতে পারেন।

জার্মানিতে কিন্ডারগার্টেন ও বিদ্যালয় শুরু হয় প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে। যাদের জন্ম অক্টোবর মাসে তারা ২ বছর ১১ মাস বয়সে কিন্ডারগার্টেনে যেতে পারে। এরপর যাদের জন্ম তাদের সুযোগ কমে যায়। তবে কিন্ডারগার্টেনে আসন খালি থাকলে বছরের যে কোন সময় বাচ্চাদের ভর্তি করার সুযোগ আছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। কিন্ডারগার্টেনে শিশুরা নিয়মমাফিক কোন পড়াশোনা করে না। এমনকি তারা ধরাবাঁধা নিয়মে অক্ষর জ্ঞান লাভ করে না। শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করে, ছবি আঁকে, অভিনয় শেখে, গান শেখে, কাগজ কেটে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন নিয়ম কানুন শেখে যেমন, রাস্তায় কীভাবে চলতে হবে, বিপদ সংকেত আসলে কী করতে হবে, না হবে ইত্যাদি। পুলিশের সাথে কিন্ডারগার্টেনগুলো যোগাযোগ করে কর্মসূচি ঠিক করে। সেই নির্দিষ্ট দিনে পুলিশ এসে বাচ্চাদের ট্রাফিক আইন সম্বন্ধে ধারণা দেয়। দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে। পুলিশ বাচ্চাদের উচ্চ দৃশ্যমান পোষাক পরিয়ে রাস্তায় নিয়ে সব কিছু হাতে কলমে ব্যাখ্যা করে।

কিন্ডারগার্টেনগুলো মাঝে মাঝেই বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যায় কোন খেলার মাঠে, পার্কে, বনে, পাহাড়ে, বিশেষ জাদুঘরে যেগুলো বাচ্চাদের জন্য আনন্দদায়ক। এছাড়াও থিয়েটারে, মিউজিক কনসার্টে, চিড়িয়াখানায়ও নিয়ে যায় শিশুদের। শিশুরা কিছু ইংরেজি শেখে কিন্ডারগার্টেনে, কিন্তু জার্মানির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ইংলিশ শেখানো হয় না। এই ব্যাপারটাকে অনেক অভিভাবকই ভালো চোখে দেখেন না। কারণ এই দুই বছর ইংলিশ না থাকাতে শিশুরা যেমন দ্রুত শেখে, আবার তেমন দ্রুত ভুলেও যায়। তবে সামান্য কিছু বাবা-মা তাদের সন্তানকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংলিশ শেখানো অব্যাহত রাখেন। যাতে তাদের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

কিন্ডারগার্টেনগুলো সকাল সাতটায় শুরু হয়। যেসব মা-বাবারা সকালে কাজে যায় তারা বাচ্চাদের সকাল সাতটায় সেখানে দিয়ে কাজে চলে যায়। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শিশুরা সেখানে থাকতে পারে। একটা শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণ নিয়মানুযায়ী একটা বাচ্চা ছয় বছর বয়স না হলে স্কুল শুরু করতে পারে না। কিন্তু পাঁচ বছর সাত/আট মাস বয়সের কোনো বাচ্চাকে যদি একটা কিন্ডারগার্টেন যথেষ্ঠ পরিপক্ব মনে করে স্কুলের জন্য সুপারিশ করে। এসব ক্ষেত্রে তারা অভিভাবক ও স্কুলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা মায়েরা ৬ বছর বয়সের আগে সন্তানদের স্কুলে পাঠান না।

জার্মানির একটি বাচ্চাদের স্কুল।

যে সব শিশুর বাবা-মা দুজনেই বিদেশি, তাদের বাচ্চাদের স্কুল শুরুর আগে এক বছর সপ্তাহে একদিন স্কুলে প্রস্তুতিমূলক জার্মান ভাষা শিখতে হয়। প্রথম শ্রেণির শিক্ষক সে ভাষা শিক্ষা দেন। এসব ব্যবস্থা কিন্ডারগার্টেন করে। শিশুদের সেই বিশেষ দিনে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসা এবং নিয়ে যাবার দায়িত্ব কিন্ডারগার্টেনের। অভিভাবকের দায়িত্ব বাচ্চাকে কিন্ডারগার্টেনে পৌঁছে দেওয়া এবং সেখান থেকে নিয়ে আসা। মাঝে যে সকল আনুষ্ঠানিকতা এগুলোর দায়িত্ব কিন্ডারগার্টেনের। হর্ট (Hort) কিন্ডারগার্টেনের পরের ধাপ। বিদ্যালয়গামী বাচ্চারা ছুটির পর হর্টে এসে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে। তারপর বাড়ির কাজ শেষ করে খেলাধুলা করে, যতক্ষণ না অভিভাবকরা তাদেরকে বাসায় নিয়ে যায়।

প্রত্যেকটা মহল্লায় একটা করে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ওই নির্দিষ্ট মহল্লার বাসিন্দারাই শুধু সেই বিদ্যালয়ে যেতে পারে। প্রচলিত নিয়মে যদি কোন রাস্তার ২৫ নম্বর বাড়ি পর্যন্ত একটা বিদ্যালয়ের অন্তর্গত হয়, তাহলে ওই রাস্তার ২৬ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা ওই বিদ্যালয়ে যেতে পারবে না। তবে এর কিছু ব্যতিক্রম আছে। কোন বিদ্যালয়ে আসন ফাঁকা থাকেলে অন্য এলাকার শিক্ষার্থীও সেখানে ভর্তি হতে পারবে শর্তসাপেক্ষে। যদি পরের বছর ওই বিদ্যালয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী এসে উপস্থিত হয়, তাহলে অন্য এলাকার শিক্ষার্থীকে সে বিদ্যালয় ছেড়ে যেতে হবে। তবে এক বছর সে সেখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এসব নিয়মের কারণে অভিবাবকরা এজাতীয় ঝামেলায় যান না। সবথেকে বড় কথা প্রত্যেকটা বিদ্যালয়ের মান একই রকম শুধু ভবনের পার্থক্য ছাড়া। শিক্ষার মান নিয়ম-কানুন সব কিছু একই রকম পুরো প্রদেশে। পুরো প্রদেশে বললাম এই কারণে যে জার্মানিতে ষোলটা প্রদেশ আছে। প্রাদেশিক সরকারগুলো নিজ নিজ প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত স্বতন্ত্রভাবে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রদেশের নিয়মকানুনের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়।

বায়ার্ন প্রদেশ ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই কড়াকড়ি করে। যে সকল শিক্ষার্থী বায়ার্নে ২  গ্রেড পায় তারা অনায়াসে অন্য প্রদেশে ১বা ১.৫ গ্রেড পেতে পারে। যারা বায়ার্নে পড়াশোনা করে তারা কাজের ক্ষেত্রে এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু এ পদ্ধতির একটা খারাপ দিকও আছে। জার্মানি এটা জানে বায়ার্নে কী পদ্ধতি অবলম্বন করে। কিন্তু যখন কেউ বিদেশে পড়াশোনা করতে যায় তখন সে দেশ ছাত্র-ছাত্রীদের ফলাফল দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, কোন প্রদেশে কী পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটা দেখে না।

জার্মানিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বলে গ্রুডসুলে (Grundschule)। প্রাথমিক শিক্ষা ৪ বছর, প্রত্যেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্ডারগার্টেনের তৃতীয় বছরের বাচ্চাদের বলা হয় ফোরসুলকিন্ডার (Vorschulkinder) বা প্রাক-বিদ্যালয় শিশু। কিন্ডারগার্টেনে যারা বাচ্চাদের তত্ত্বাবধান করে তাদেরকে বলা হয় শিক্ষাব্রতী, শিক্ষক না। জার্মান ভাষায় বলে এরছিয়ার (Erzieher)। এই সকল শিক্ষাব্রতীরা দশম শ্রেণি শেষ করার পর তিন বছরের একটা ডিপ্লোমা করেন শিক্ষাব্রতী হিসেবে। শিক্ষাব্রতীদের মধ্যেও আবার ভাগ আছে, একেক জন একেক বিষয়ে পারদর্শী। তারা যখন ডিপ্লোমা করেন তখন বিশেষ বিষয় পছন্দ করতে পারেন। কোন বিষয়ে তিনি পারদর্শী হতে চান। কেউ মনে করলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে এই পেশায় আসতে পারে। কিন্ডারগার্টেনের শেষের দিকে বাচ্চাদের একরাত সেখানে শিক্ষাব্রতীদের সাথে কাটাতে হয়। বিভিন্ন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে সেদিন রাতে। বাচ্চারা বাসা থেকে স্লিপিংব্যাগ নিয়ে যায় সে রাতের জন্য।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথমদিনে বিদ্যালয়ে চলে এক মহোৎসবের মত। বাচ্চাদের নতুন পোশাক বিদ্যালয়ের নতুন নতুন সামগ্রী। এসব সামগ্রীগুলো একটা বিশেষ কাগজের ঠোঙার মধ্যে ভরে দেয়। বাচ্চারা প্রথমদিন শ্রেণিকক্ষে বসে গিফটের প্যাকেট খোলে এবং সবাই মিলে উপভোগ করে। এদিন গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। তবে গির্জার এই প্রার্থনায় যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক না। প্রথমদিন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অভিভাবকদের উপস্থিত থাকতে হয় বিদ্যালয়ে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছর ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার কোন নোট (নম্বর বা গ্রেড) দেওয়া হয় না। এত ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষায় নম্বর দেওয়া কোন কার্যকর পদক্ষেপ বলে জার্মান সরকার মনে করে না। এমনকি প্রথম দুই বছর বাচ্চাদের সঠিক বানান রীতিও শেখানো হয় না। তারা যা শোনে ও বোঝে সেভাবেই লেখে। যেমন ক্যাট বানান কোন বাচ্চা Cat কেউ আবার Kat লেখে। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণি থেকে এই মধুচন্দ্রিমার দিন শেষ হয়।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে একজন শিক্ষক সব বিষয় শিক্ষা দেন। সেই একইভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতেও একজন শিক্ষক সব বিষয়ে শিক্ষা দেন। তারা মনে করে এতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোঝাপাড়াটা ভাল হয়। একজন শিক্ষক যথেষ্ট সময় পান তার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বুঝতে এবং বোঝাতে।

জার্মানি শিক্ষাক্ষেত্রেও এখনও ঐতিহ্যগত প্রথাগুলো ধরে রেখেছে। আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি এখানে ঝরনা কলমের (ফাউন্টেন পেন) ব্যবহার শিখতে হয় দ্বিতীয় শ্রেণিতে। কমপক্ষে বেভারিয়া প্রদেশে এটা বাধ্যতামূলক। কলম ব্যবহারের জন্য বাচ্চাদের একটা পরীক্ষার মাধ্যমে সনদ পেতে হয়। কীভাবে কালি ভরতে হবে, কীভাবে কলম ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্ম/নীতিশিক্ষা, জার্মান, গণিত, গার্হস্থ্য ও সাধারণ শিক্ষা, শিল্প, সঙ্গীত, স্পোর্টস বিষয়গুলো শিখতে হয়। বিদ্যালয় সব ঋতুতেই সকাল ৮টায় শুরু হয়। জার্মানরা মনে করে পর্যাপ্ত বিশ্রামের পর সকালে ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তিস্ক ভাল কাজ করে। বিদ্যালয় থেকে অভিভাবকদের পরামর্শ দেওয়া হয় বাচ্চাদেরকে সকালে হাঁটিয়ে স্কুলে পাঠাতে। তাতে সকালে ওঠার পরে বাচ্চাদের মধ্যে ঘুমজনিত যে জড়তা থাকে তা কে্টে যায়, মুক্ত বাতাসে হাঁটার কারণে। তাতে তারা শ্রেণিকক্ষে ভালো মনোযোগ দিতে পারে। আর বিদ্যালয়গুলো সব শিক্ষার্থীর বাসা থেকে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে থাকে। তবে হাঁটিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো বাধ্যতামূলক না।

স্কুলগুলোকে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের কথা মাথায় রাখতে হয়। যদি কোন বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী থাকে সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে লিফটের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অথবা তাদের পাঠদানের ব্যবস্থা এক তলায় করতে হবে। আমার বাচ্চার স্কুলে লিফটের ব্যবস্থা ছিল না। একদিন সে আমাকে প্রশ্ন করেছিল, "বাবা আমাদের বিদ্যালয়ে যদি কোন প্রতিবন্ধী শিশু আসতো তাহলে কী হতো?” চিন্তা করেন প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্রী কতটা তাদের অধিকার সচেতন হলে এমন প্রশ্ন করে। এ শিক্ষাগুলো সে কিন্ডারগার্টেন থেকে পেয়েছিল।

একটা বাচ্চাকে অবশ্যই সকাল ৮টার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হবে। যদি কোন বাচ্চা উপস্থিত না থাকে। এবং অভিভাবকরা সে ব্যাপারে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে, তাহলে কর্তৃপক্ষ পুলিশকে অবহিত করবে। মোটকথা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভেবে নেবে শিক্ষার্থী বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কিন্তু রাস্তায় কোন অঘটন হয়েছে। অতএব তখন সেটা পুলিশের দায়িত্ব ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশ প্রথমে সেই শিক্ষার্থীর বাসায় খোঁজ নিয়ে দেখবে, বাসায় আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। বাচ্চার বাবা-মাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করবে যদি তারা কাজে বা বাইরে থাকে। তারপর তারা খতিয়ে দেখবে শিশুটি হারিয়ে গেছে, না  অপহৃত হয়েছে। তবে এরকম পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সবাই বাসায় ঘুমাচ্ছে। পুলিশ এসে তাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অভিভাবককে জরিমানা দিতে হয়, ঠিক সময়ে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে ঘুমানোর কারণে। আর এজাতীয় ঘটনা বার-বার ঘটলে ইউগিডআমট (Jugendamt) বাচ্চাদের তাদের দায়িত্বে নিয়ে নেবে। অনেক বাবা-মা দায়িত্বহীনতার কারণে সন্তান হারান। আমার এক বাঙালি বন্ধু তাদের দুই মেয়েকে হারিয়েছে। ইউগিডআমট অন্য এক নিঃসন্তান কিন্তু দায়িত্বশীল পরিবারকে মেয়ে দুটোর দায়িত্ব দিয়েছে।

বিদ্যালয় খোলা থাকা অবস্থায় কোন বাচ্চা বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে জার্মানির সীমান্ত পার হতে পারবে না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যদি কারোর আত্মীয় স্বজনের মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে স্কুলের অনুমতি সাপেক্ষে সে সীমান্ত পার হতে পারবে। তবে তার কাছে বৈধ অনুমতিপত্র অবশ্যই থাকতে হবে।

যে সকল বাচ্চা হর্টে নিবন্ধিত তারা তাদেরকে প্রথম শ্রেণির প্রথম দুই মাস বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে এবং ছুটি হলে নিয়ে আসে। তারপরে বাচ্চারা একা একাই হর্ট থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করে। কিন্তু বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি বাচ্চারা হর্টে না ফেরে, তখন হর্ট কতৃপক্ষ এলার্ম বাজিয়ে দেয়। এরপর পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাধীন অবস্থায় বাচ্চারা সাইকেল চালানোর লাইসেন্স নিতে পারে। এটা বাধ্যতামূলক না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে এবং তারা  সকল সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। প্রত্যেকটা বাচ্চার পরীক্ষা নেয় পুলিশ লিখিত ও ব্যবহারিক। তারা ঠিকমত চালাতে পারে কিনা, রাস্তার সকল নিয়ম এবং সংকেতগুলো ঠিকমতো বোঝে কিনা। শুধু পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তারা লাইসেন্স পেয়ে থাকে।

প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রীর জন্য তৃতীয় শ্রেণি থেকে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক। তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন বাচ্চাদেরকে স্কুল থেকে সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্পূর্ণ বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং বিনা খরচে। এছাড়াও প্রত্যেকটা বিদ্যালয়ে একটা পাঠাগার ও ইনডোর খেলার মাঠ বাধ্যতামূলক। যাতে খারাপ আবহাওয়াতেও ক্রীড়া শিক্ষা বাধাগ্রস্ত না হয়। আর প্রত্যেকটা কিন্ডারগার্টেন ও বিদ্যালয়ে জরুরী বহির্গমন থাকাও বাধ্যতামূলক।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটা শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ২৮ জনকে পাঠদান করা যাবে। তবে সাধারণত এটা ১৩ থেকে ২২/২৩ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য শিক্ষক আসন নির্দিষ্ট করে দেন, তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে বসে। বই-পত্রসহ নিজস্ব কিছু সরঞ্জাম শিক্ষার্থীরা সেখানেই রেখে আসে তাদের ডেস্কের মধ্যে। অতএব প্রতিদিন আসন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয় না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় শিক্ষার্থীদের এক দুই বার কৃষিখামারে ও পর্বত আরোহনে নিয়ে যায় তিন দিনের জন্য। এছাড়াও স্থানীয় কৃষিখামারে প্রতিবছর মৌসুমী ফসলের সময় নিয়ে যায় বিদ্যালয় থেকে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের মেধার ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়। সবচেয়ে ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা যায় গিমনেজিউম (Gymnasium) বা হাই স্কুলে। বোঝানোর জন্য বলা যায়, আমাদের দেশের ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয় এ স্কুলগুলোতে।

দ্বিতীয় ধাপ যায় রিয়ালসুলে (Realschule), যেখানে দশমশ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এবং কারিগরিশিক্ষার প্রাধান্য বেশি থাকে। তবে এখান থেকে ফলাফল ভালো করে শিক্ষার্থীদের গিমনেজিউমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকে। আর এর পরের ধাপ যায় মিটেলসুলে (Mittelschule), যেখানে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ার সুযোগ থাকে।

এছাড়াও বিশেষ কিছু বিদ্যালয় আছে অসুস্থ এবং খুব খারাপ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যাদের মাথায় কিছু ঢোকে না। এই মেধার বিচার করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের জার্মান, গণিত ও গার্হস্থ্য ও সাধারণ শিক্ষা বিষয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রাপ্ত গ্রেডের ভিত্তিতে। কোনও সুপারিশ কোনও ছাত্র-ছাত্রীকে  গিমনেজিউমে পাঠাতে পারবে না।

মেধার ভিত্তিতে এই ভাগের অর্থই হল, ভাল এবং খারাপ একসাথে থাকলে উভয়েরই পাঠ গ্রহণে সমস্যা হয়।

ছবি: মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার

লেখক পরিচিতি: গবেষক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি

প্রবাস বিভাগে এ লেখকে অন্যান্য লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!