চীনে মহামারীর দিনগুলোতে প্রবাসী ছাত্রের জীবন

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান শহর থেকে মাত্র ৩৫০ কিলোমিটার দূরে নানচাং শহরে আমার বিশ্ববিদ্যালয়। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমরা নতুন ভাইরাসের কথা জানতে পারি।

ছাইয়েদুল ইসলাম, চীন প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2020, 08:04 AM
Updated : 12 June 2020, 08:04 AM

চিয়াংশি ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স, এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ সর্তকতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। ইউনিভার্সিটি থেকে বলা হয়েছিল যেন আমরা প্রয়োজন ছাড়া রুমের বাইরে বের না হই, সব সময় যেন মাস্ক পরি।

শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার জন্য ফ্রি থার্মোমিটার দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ফ্রি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক দেওয়া হয়েছিল। বারবার হাত ধুতে বলেছে, প্রচুর পানি খেতে বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রবেশদ্বার বন্ধ ছিল। রুমের দরজা জানালা খোলা রেখে বায়ু চলাচলের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে বলা হয়েছিল। কোন বহিরাগত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার কোন সুযোগ ছিল না। মানে যতভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন তারা রুমে রুমে এ সংক্রান্ত নোটিশ দিয়ে গেছে।

ওভারসিজ এডুকেশন স্কুলের পক্ষ থেকে এক মাস সব শিক্ষার্থীদের ফ্রিতে খাবার সরবরাহ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে অ্যাপসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবারের জন্য একদিন আগে অফিস কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখতো। শিক্ষার্থীদের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবার অফিস কর্তৃপক্ষ ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সমন্বয়ে কিনে বিতরণ করা হত। পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা যেন তাদের প্রয়োজনীয় বাজার সেরে নিতে পারে এজন্য চারদিনে একবার বাইরে গিয়ে কেনাকাটা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়া কোন শিক্ষার্থীর যদি জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, সর্দি বা বুকে ব্যথা হয় তাহলে সাথে সাথে এই তথ্য ডর্মেটরির দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক বা স্বেচ্ছাসেবকদের জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্বক্ষণিক খোঁজ নেয়া হচ্ছে যে শিক্ষার্থীরা ঠিক আছি কিনা। তারপরও যদি কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্সে করে আক্রান্ত শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

চীনে আজ সব কিছু স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে বিধি-নিষেধ পালন করতে হয়। মাস্ক নিতে ভুলে গেলে গেটম্যান সামনে এসে বাধা দিয়ে মাস্ক পরিধান করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া প্রতিদিন সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা জানাতে হয়।

করোনাভাইরাসের এ মহামারীর পুরোটা সময় ধরে চীনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে ছিলাম এবং এখনো আছি। দীর্ঘ দুই মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি সুন্দর সবুজ এক নতুন পৃথিবীতে মাত্র পা রেখেছি। আসলে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার মতো দামি আর কিছু নেই।

করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জারিকৃত নির্দেশনা আমি সম্পূর্ণ মেনে চলেছি। লকডাউন শুরু হবার পর থেকে আমি কারো সঙ্গে তেমন মিশিনি। তাপমাত্রা নেগেটিভ রাখার জন্য প্রতিদিন গোসল করি। সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থেকেছি। আলো বাতাসের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য দরজা-জানাল খোলা রাখতাম। রুমের মধ্যে প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম করেছি এবং ভিটামিন সি বেশি পরিমান খেয়েছি। প্রতিদিন নিজে রান্না করে খেয়েছি।

এছাড়া দিনে বারবার হ্যান্ডওয়াস দিয়ে হাত ধুয়েছি। রুমের বাইরে গেলে সবসময় মাস্ক ব্যবহার করেছি। হাঁচি দেওয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করেছি। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি।

আমি এই বছর মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। করোনাকালে আমি আমার ফাইনাল থিসিস নিয়ে অনেক ব্যস্ত সময় পার করেছি। নিয়মিত সুপারভাইজারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। সুপারভাইজার যেসব সংশোধনী দিয়েছিল সেগুলো সংশোধন করে ফাইনাল থিসিস সম্পূর্ণ করেছি। আমাদের প্রিডিফেন্স এবং ফাইনাল ডিফেন্স অনলাইনে হয়েছে। এটা এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে অনলাইনে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা সেশন জটে পড়েনি।

ওভারসিজ এডুকেশন স্কুলের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ভলান্টিয়ার টিমের সদস্য হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহযোগিতায় নিয়োজিত ছিলাম। শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার বিতরণ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মাস্ক বিতরণ, শিক্ষার্থীদের শরীরের নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা, তাছাড়া শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রয়োজনে সহযোগিতা করা এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিয়মিত ইন্টারন্যাশনাল অফিসকে সহযোগিতা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা শিক্ষার্থীরা ফিরে আসলে তাদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছি।

করোনাকালে আমি আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি তা হল সত্য তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চীনের করোনাভাইরাস নিয়ে অনেক ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া মিথ্যা প্রচার করেছে। মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমেও জড়িত আছি।

বাংলাদেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিতে চীনে আছে। করোনাকালে চীনের বিভিন্ন প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক অবস্থা বাংলাদেশি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছি। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীন সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেওয়া পদক্ষেপ তুলে ধরেছি যাতে করে মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়।

চীন করোনাভাইরাস রুখে দিয়ে বিশ্ববাসীর কানে কানে যেন ফিসফিস করে বলেছে, হ্যাঁ, এই করোনা-দানবের সঙ্গেও মল্লযুদ্ধে জেতা সম্ভব। এই দেখো আমরা জিতেছি।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!