লিভারপুলে এনফিল্ডের ডায়েরি

ফুটবল প্রেমিক হিসেবে যুক্তরাজ্যে আসার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে করেই হোক লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের একটা ম্যাচ দেখবো। সেই জেরাডদের সময় থেকে লিভারপুলের খেলা ভালো লাগতো, এরপর ক্লপ এসে তো গত কয়েক বছরে লিভারপুলের খেলার মান অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

সুব্রত মল্লিক, যুক্তরাজ্য থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2020, 05:31 AM
Updated : 12 May 2020, 05:31 AM

যাই হোক, যুক্তরাজ্যে আসার পর অনলাইনে টিকিট খুঁজতে গিয়ে তো চক্ষু চড়ক গাছ! প্রথমে ঠিক করি এনফিল্ডে চেলসি-লিভারপুল ম্যাচ দেখবো, কিন্তু অনলাইনে ঢুঁ দিয়ে দেখি ওই হাই-ভোল্টেজ ম্যাচের টিকিটের সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ২২৫ পাউন্ড! বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো! বড় ম্যাচ দেখার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে এবার ছোট ম্যাচের টিকিট খোঁজার পালা।

অবশেষে ২১২ পাউন্ডে এনফিল্ডে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের লিভারপুল-নাপোলি ম্যাচের টিকিট পেয়ে গেলাম। আমার এক বিসিএস ব্যাচমেটের সঙ্গে বসে অনলাইনে টিকিট কাটার সময় কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম, ভুয়া ওয়েবসাইটের পাল্লায় পড়ে এতগুলো টাকা হারাই কিনা। অবশেষে ওয়েবসাইটে রেটিং এবং ইতিবাচক রিভিউ দেখে মনে সাহস সঞ্চয় করে অনলাইনে টিকিট কেটে ফেলি, যদিও ম্যাচের আগ মুহূর্তে টিকিট হাতে পাওয়া পর্যন্ত কিছুটা ভয়ে ছিলাম।

২৭ নভেম্বর থেকে বাসযোগে লিভারপুলের দিকে যাত্রা করি। এখানে খুব বেশি ট্র্যাফিক জ্যাম নেই, তবে বিকেল সাড়ে চারটার পরের সময়টাকে ‘রাশ আওয়ার’ বলে। ওই সময় শহরে প্রবেশের আগে থেকেই কিছুটা জ্যাম পাওয়া যায়। জ্যামে পড়লেই ভয় লাগছিল নির্ধারিত সময়ের আগে স্টেডিয়ামে পৌঁছাতে পারব কিনা। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসার পর জ্যামে পড়ে আমরা ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম, আমাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দিতে পারবে কিনা। সে শুরুতেই না বলে দিলে আমরা আরেকবার অনুরোধ করতেই সে খানিকটা রেগে গেল।

পরে শান্ত স্বরে আমাদেরকে বুঝিয়ে বলল, যুক্তরাজ্যে নির্দিষ্ট স্টেশন ছাড়া বাস থেকে মানুষ ওঠানো এবং নামানোর কোন নিয়ম নেই। এটি করলেই বাস স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বেই সিসি টিভিতে ফুটেজ দেখে হাইওয়ে পুলিশ ড্রাইভারের নামে জরিমানার কাগজ পাঠিয়ে দিবে। এই জরিমানার ব্যবস্থা এবং কঠোর আইনের প্রয়োগের কারণেই এখানে শৃঙ্খলা অনেক বেশি, তাই চাইলেও কোন ড্রাইভার নির্ধারিত গতির ওপরে গাড়ি চালাতে পারে না, ফলে এখানে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কম।

যাই হোক, জ্যাম পেরিয়ে আমরা ঠিক সময়ে লিভারপুল বাস স্টেশনে নামলাম। স্টেশন থেকে এনফিল্ডের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার মতো হবে, তখনো ম্যাচ শুরু হতে ঘণ্টা দুয়েক বাকি। আমরা অগত্যা উবার ডাকলাম, কিন্তু এবার প্রাইম টাইমের পাল্লায় পড়লাম। শহরের বড় অংশের মানুষের গন্তব্য তখন এনফিল্ড। ফলে ৫ পাউন্ড এর উবার ভাড়া ৩০ পাউন্ড এ পৌঁছে গেছে। অগত্যা মন খারাপ করে উবারে উঠে বসলাম।

উবার চালক ছেলেটির বাড়ি রোমানিয়া, বয়সে তরুণ এবং অত্যন্ত সপ্রতিভ। আমাদের সঙ্গে আলাপকালে সে বলে যে, যুক্তরাজ্যে আসার পর তার উপলব্ধি হয়েছে যে যুক্তরাজ্যের তুলনায় রোমানিয়া কত গরীব! ওর কথা শুনে আমরা দুজন হেসে দিলাম। ছেলেটিও লিভারপুলের ফ্যান, জিজ্ঞেস করলাম ও মাঠে গিয়ে খেলা দেখে কিনা? প্রতি উত্তরে বলল, টিকিটের দাম অনেক বেশি। ফলে ও নিজের টাকায় খেলা দেখতে মাঠে পা বাড়ায় না, তবে একটা সুবিধে হল, ওর গার্লফ্রেন্ড এর লিভারপুল ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড আছে। ফলে ওর গার্লফ্রেন্ড যেদিন খেলা দেখতে না যায় সেদিন ও সুযোগটা গ্রহণ করে। আমরা ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে বলি ভাই তুমি পারফেক্ট গার্লফ্রেন্ড বেছে নিয়েছ।

অবশেষে জ্যাম পেরিয়ে আমরা টিকিট সংগ্রহের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলাম। আসলে যুক্তরাজ্যে ফুটবল ম্যাচের টিকিট নিয়ে এক অলিখিত জুয়া চলে। ক্লাব অন্তপ্রাণ সমর্থকরা নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে ক্লাবের মেম্বার হিসেবে নিবন্ধিত হয় এবং একটি করে মেম্বারশিপ কার্ড পায়। মেম্বারশিপ কার্ড থাকলে একজন সমর্থক পুরো সিজনের সবকয়টি ম্যাচের টিকিট অনেক কম দামে কিনতে পারে। তবে ক্লাবের মাথায়ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি কম না। ওরা হাই ভোল্টেজ ম্যাচের টিকিটগুলোর দাম অনেক বেশি রাখে। ফলে সব ম্যাচের টিকিটের দাম সমান হয় না।

মেম্বাররা সিজন টিকিট কিনে এবার জুয়া শুরু করে। ওরা অনলাইনে চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে। অনলাইনে টিকিট বিক্রির বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে। যার কাছে টিকিট আছে সে মাঠের সিট নম্বরসহ ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয় এবং টিকিট বিক্রির একটা অংশ ওই ওয়েবসাইটের স্বত্বাধিকারীও পায়। ফলে এখানে কয়েক পক্ষ জড়িত থাকে। অনলাইনে টিকিট কেনার সময় রেটিং এবং ফিডব্যাক দেখে নেয়া খুব জরুরি। ভালভাবে পরখ করে না নিলে ভুয়া ওয়েবসাইটের পাল্লায় পড়ে টাকা খোয়ানোর সম্ভাবনা অনেক। আর তাই ডেবিট কার্ড থেকে এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেক সাবধান থাকে।

যাই হোক টিকিট হাতে পাওয়ার পর যখন দেখলাম মাত্র ৯ পাউন্ডের টিকিট ২১২ পাউন্ড দিয়ে কিনেছি, তখন ক্ষণিকের জন্য মনটা খারাপ হয়েছিল। হাই ভোল্টেজ ম্যাচে এ টিকিটের দাম সাড়ে তিন হাজার পাউন্ড পর্যন্ত উঠে যায়, এটা ভেবে মনটাকে একটু সান্ত্বনা দিলাম।

এনফিল্ডের আশেপাশে প্রচুর পাব ও বারের দেখা মেলে। পাব ও বারের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে, সেটি হলো পাবে শুধু অ্যালকোহলিক ও কোমল পানীয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে বারে উভয় প্রকারের পানীয়ের সঙ্গে ফাস্ট ফুডের সরবরাহ থাকে। এখানে ম্যাচের দিন প্রচণ্ড ভিড় থাকে, ফলে চেয়ার-টেবিলে বসে গ্লাস হাতে বড় পর্দায় খেলা দেখতে চাইলে আগে থেকে বুকিং দিতে হয়। খরচ খুব বেশি না, দুই থেকে পাঁচ পাউন্ডের আশপাশেই থাকে। ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই পাব ও বারগুলো লিভারপুল সমর্থকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। সবার গায়ে লিভারপুলের জার্সি, গলায় ক্লাবের মাফলার, হাতে গ্লাস ভর্তি বিয়ার।

মূল রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা এনফিল্ডের দিকে। রাস্তার দুইপাশ জুড়ে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের জার্সি, মাফলারসহ অন্যান্য জিনিসের বিকিকিনি চলছে পুরো দমে। কেউ আবার রাস্তার পাশে অস্থায়ীভাবে আমাদের দেশের হকারদের মতো ছোট ছোট দোকান সাজিয়ে বসেছে। ভেবেছিলাম লিভারপুলের লাল জার্সি পরে মাঠে ঢুকবো, কিন্তু জার্সির চড়া দাম দেখে আর ডেবিট কার্ডে হাত দিতে ইচ্ছে করলো না। ক্লাব কিটসের পাশাপাশি প্রচুর খাবারের দোকান। মূলত ফাস্ট ফুডের দোকানই বেশি। মাঠের ভেতরে খাবার নেয়ার অনুমতি নেই বলে সবাই মাঠে ঢোকার আগে নাস্তা করে নেয়।

আমরাও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উদরপূর্তি করে মাঠের দিকে রওনা দিলাম। স্টেডিয়ামের চারপাশ জুড়ে নিরাপত্তা কর্মীদের সরব উপস্থিতি। আমরা আমাদের স্ট্যান্ড কোন দিকে সেটি অনুমান করতে পারছিলাম না। অগত্যা এক লেডি পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করতেই সে হাসিমুখে আমাদের গন্তব্য দেখিয়ে দিল। আমরা ধন্যবাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম।

পুলিশ অফিসারের কথামত আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের স্ট্যান্ডের দিকে। স্টেডিয়ামের সাথেই অনেকটা জায়গাজুড়ে ফ্যান পার্ক গড়ে তুলেছে। ফ্যান পার্কের স্টেজে চমৎকার আলোকসজ্জা করা এবং তার সাথেই বড় পর্দার ব্যবস্থা। ফ্যান পার্কের স্টেজে দেখলাম সঙ্গীতের লাইভ শো হচ্ছে এবং আমুদে সমর্থকরা খেলা শুরুর আগে সঙ্গীতের মূর্ছনায় মেতে উঠেছে। লিভারপুলের যেসব সমর্থক টিকিট কাটতে পারে না, তাদের জন্য স্টেডিয়ামের বাইরে ক্লাবের এ চমৎকার আয়োজন ক্লাব অন্তপ্রাণ সমর্থকদের সাথে ক্লাবের আত্মিক বন্ধনটা আরও সুদৃঢ় করে।

কারণ এ খ্যাপাটে ফুটবল পাগল দর্শকরাই হলো ক্লাবের অক্সিজেন। ফ্যান পার্ক পেরিয়ে আমরা এনফিল্ডের মূল প্রবেশপথের সামনে গেলাম, যেখানে সোনালী অক্ষরে জ্বলজ্বল করে শোভা বর্ধন করছে লিভারপুল ক্লাবের জাদুকরী স্লোগান ‘ইউ উইল নেভা ওয়াক অ্যালোন’। গেট পেরিয়ে চেকিং শেষে চলমান লিফটে চড়ে সাততলায় ওঠার পর এনফিল্ডের লাল-সবুজের ফুটবল রাজ্যে প্রবেশের পর বুঝতে পারলাম ক্লাবের স্লোগানের আসল মাহাত্ম।

সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের গতিময় এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় ফুটবলের একজন একান্ত অনুসারী হিসেবে এনফিল্ডের লাল-সবুজের মায়ার জগতে প্রবেশ করাটা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। একেবারে মেইন স্ট্যান্ড থেকে পুরো মাঠের ছবিটা চমৎকার ভাবে দেখা যায়। এনফিল্ডের চারদিকে লালের ছোঁয়া, পুরো গ্যালারি থেকে শুরু করে প্রতিটা সিট সবই লালের আবেশে আবেশিত। সাততলা সমান উঁচুতে পাওয়া সিটের সামনে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই মনে হয় যেন লাল সমুদ্রের মাঝে সবুজের আবাহনে ফুটবলের নির্যাস মন্থনে আমরা হাজির হয়েছি।

আমরা ম্যাচ শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে মাঠে ঢুকি। তখন দর্শকরা ধীরে ধীরে মাঠে ঢুকছে। ম্যাচ শুরুর প্রায় আধা ঘণ্টা আগে লিভারপুলের খেলোয়াড়রা মাঠে প্রবেশ করতেই উপস্থিত দর্শকরা তুমুল করতালির মাঝে তাদেরকে স্বাগত জানালো। মাঠে প্রবেশ করে খেলোয়াড়রা ওয়ার্ম আপ শুরু করলো। ম্যাচ শুরুর বিশ মিনিট আগেও গ্যালারির প্রায় অর্ধেক আসন ফাঁকা দেখে মনে হল দর্শকে ভর্তি সেই চিরায়ত টইটম্বুর পরিবেশে বোধহয় খেলা দেখার ফ্লেভার নিতে পারব না।

কিন্তু আমাদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে ম্যাচ শুরুর পাঁচ মিনিট আগে দেখি এনফিল্ড আমাদের সেই চিরচেনা রূপে সেজে উঠেছে। পুরো মাঠ জুড়ে শুরু হয়ে গেছে লাল সেনানীদের সেই জাদুকরী গর্জন। ওয়ার্ম আপ শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে দুই দল মাঠে একসাথে মাঠে প্রবেশ করতেই তুমুল হর্ষধ্বনিতে পুরো স্টেডিয়াম মুখরিত হয়ে উঠলো।

অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে গোল হয়ে মাঠের সবুজ গালিচার মাঝে রাখা ফুটবল সদৃশ উয়েফার পতাকা নাড়িয়ে ঢেউ তুলে চলেছে, খেলোয়াড়, স্টাফরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে উয়েফার থিম সঙয়ের সাথে গলা মেলালো। গান শেষ হতেই তুমুল করতালির বৃষ্টিতে পুরো স্টেডিয়াম যেন ভিজে গেল।

রেফারির বাঁশি বাজতেই খেলা শুরু হয়ে গেল। লিভারপুল শুরুতেই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করলো। আমাদের গ্যালারি স্ট্যান্ডের দিকে মানে এবং ফিরমিনোর পজিশন ছিল। সালাহ ছিল অন্য প্রান্তে। অত উঁচুতে বসে খেলোয়াড়দের অবয়বটি দেখা যায়, কিন্তু স্পষ্ট চেহারা দেখা যায় না। তবে পুরো মাঠ জুড়ে খেলার নান্দনিকতা চমৎকার ভাবে উপলব্ধি করা যায়। বিশেষ করে ছোট-ছোট পাসের পসরা সাজিয়ে যখন একেবারে গোলপোস্টের সামনে থেকে খেলা বিল্ডআপ করে, মাঝ মাঠ পেরিয়ে বিপক্ষ দলের অর্ধে প্রবেশ করে আচমকা গতি বাড়িয়ে ডি বক্সে ঢুকে পড়ে কিংবা ডি বক্সের সামনে থেকে বল কেড়ে নিয়ে প্রতি-আক্রমণে মুহূর্তের মধ্যে তিন চার টাচে চিতাবাঘের গতিতে দৌড়ে বিপক্ষ দলের গোলপোস্টের সামনে চলে যায় তখন পুরো মাঠের ছবিটা যে এত স্পষ্ট ভাবে ধরা দেয় সেটি ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

সাদিও মানের অসম্ভব গতি দেখে ভালো লাগলো। মানেকে ডি বক্সের সামনে অত্যন্ত সপ্রতিভ লাগলো। বিশেষত ইনসাইড আউট করে দুই তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে তীব্র গতিতে যেভাবে ডি বক্সে ঢুকে পড়তে দেখলাম সেটি এক কথায় অনবদ্য। মাঝে ফিরমিনোর একটা ব্যাকহিল দেখে ব্রাজিলিয়ান ঝলকের সাক্ষী হলাম। ডান প্রান্তে সালাহ সেদিন কেমন যেন নিজের ছন্দে ছিলেন না। ভ্যান ডিককে ডিফেন্সে অসাধারণ লাগলো। প্রথম হাফের মাঝের দিকে মাঝমাঠ থেকে আচমকা এক নিখুঁত পাস পেয়ে নাপোলি গোল করে লিড নিল। পুরো স্টেডিয়াম যেন শোকের সাগরে স্তব্ধ। লিভারপুলের সমর্থকদের স্ট্যান্ডগুলোতে পিন পতন নীরবতা। ওদিকে নাপোলির কয়েক হাজার সমর্থক গলা ফাটিয়ে চলেছে। পুলিশ ওদের দিকে ফিরে সবকিছুর দিকে নজর রাখছে।

গোল খাওয়ার পর শুরু হলো লিভারপুল সর্থকদের আসল খেলা। যখনই লিভারপুল বল নিয়ে নাপোলির ডি বক্সের দিকে যায় তখনই পুরো স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করে, 'ওয়ে ওয়ে লিভারপুল, উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন’। মাঝে মাঝে সবাই মিলে গাইছে ‘উই নেভা ওয়াক অ্যালোন’। দলের একটা ভালো মুভমেন্ট পেলেই দর্শকরা চিৎকার করে, হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। রেফারি বিপক্ষে বাঁশি বাজালে পুরো স্টেডিয়াম গর্জন করে উঠছে। সমানে গালি দিচ্ছে। আবার নাপোলির গোলকিপার বল ধরলেই পুরো স্টেডিয়াম উ উ করে শব্দ করছে। এ এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ।

৬৫ মিনিটের দিকে লিভারপুল গোল শোধ করতেই পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে যেন লাল সমুদ্রের গর্জন। এবার দর্শকরা আরো বেশি অ্যাকটিভ। দলকে জেতানোর দায়িত্ব যেন সমর্থকদের কাঁধেই বেশি। মাঠে আপনি ততক্ষণই বসে খেলা দেখতে পারবেন যতক্ষণ বল নিজেদের অর্ধে বিপক্ষের পায়ে থাকবে। বল নিজেদের খেলোয়াড় মাঝ মাঠ পেরিয়ে বিপক্ষের ডি বক্সের দিকে এগিয়ে যেতেই পুরো স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়াবে, গান শুরু করবে, ‘ওয়ে ওয়ে লিভারপুল, উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন’।

একটা বিষয় খুব ভালো লাগলো যে সমর্থকরা মাঠে দলের খুব ছোট ছোট বিষয়কে অনেক গুরুত্ব দেয়। কোনো খেলোয়াড় মাঠ ছেড়ে গেলে, নতুন খেলোয়াড় বদলি হয়ে মাঠে ঢুকলে পুরো স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দেয়। শেষের কয়েক মিনিট লিভারপুল অতি আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করলে নাপোলি এক পয়েন্ট ধরে রাখার জন্য পুরো ডিফেন্সিভ মুডে চলে যায়। ওদিকে এনফিল্ডের পুরো দর্শক তখন উঠে দাঁড়িয়ে দলকে উজ্জীবিত করে পুরো তিন পয়েন্ট ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাদের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে গলায় সুর তুলেছে। সে এক অদ্ভুত শিহরণ।

এভাবে দর্শকদের আবেগ-উত্তেজনাকে সঙ্গে নিয়ে ৯০ মিনিটের ফুটবল মহারণের পুরোটা সময় কখন যে টিকটিক করে চলতে থাকা ঘড়ির পিঠে সাওয়ার হয়ে চলে গেছে বুঝতে পারিনি। বুঝবো কী করে ফুটবল নামক এক মহামন্ত্রের মাদকতায় যে মোহাছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যের সাক্ষী হয়ে বুঝেছিলাম, ফুটবল আসলেই জীবনের জলছবি। যেখানে সুখ আছে-দুঃখ আছে, হাসি আছে-আনন্দ আছে, উত্থান আছে-পতন আছে। আর আছে ফুটবলের পরম্পরাকে এগিয়ে নিতে সদা প্রস্তুত একদল পাগলাটে সমর্থক।

এরকম পাগলাটে ফুটবল অন্তপ্রাণ সমর্থক আছে বলেই ফুটবল খেলার এত প্রাণশক্তি, এত প্রাচুর্য। জয়তু ফুটবল, জয়তু ফুটবল সমর্থক!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, (ওএসডি) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা, মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ইউনিভার্সিটি অব বারমিংহাম, যুক্তরাজ্য

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!