কোভিড-১৯: ঘরবন্দি থেকেও কিছু প্রাপ্তি

সর্বশেষ বাসা থেকে কাজের জন্যই বাইরে গিয়েছিলাম ২৩ মার্চ, এরপর আর বের হইনি। ছোটবেলা থেকে এর আগে কখনো একদিনও শুধু ঘরে থেকেই কেটেছিলো কিনা তা মনে নেই, হয়তবা না।

মোহাম্মাদ হুসাইন বেলাল, যুক্তরাজ্য থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2020, 09:33 AM
Updated : 8 May 2020, 09:33 AM

যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর আগের দিনকাল কাটিয়েছি বাপ-দাদার মফস্বলের বাড়িতেই, যেখানে ছিল শ-খানেক মানুষের হৈচৈ আর চেচামেচি। দেশে থাকলে এত এত মানুষের মাঝে থাকতে হয়তো টেরই পাওয়া যেতো না লকডাউন কি। বাড়ির উঠোনে পিচ্চিদের নিয়ে মিনি ক্রিকেট, পেছন দিকে সুপারি গাছের বাগান, ঘরের পাশে শাক-সবজির ক্ষেত, এসব দেখেই কেটে যেত এই দুঃসময়।

পশ্চিম লন্ডনের কোন এক ঘরের দুতলায় এসব ভেবেই কেটেছে আমার পেছনের প্রায় ৪৫টি দিন। সবার মতো ঘরে থেকে লম্বা সময় পার করার যে ক্লান্তি তা আমারও হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি মিলিত হওয়ার তৃষ্ণা, কিন্তু কী আর করার। এই দুঃসময়ে ক্লান্তি ভুলেই যে খুঁজতে হবে ভাল থাকার উপায়। তো কী পেলাম খুঁজে?

এই দেশে আসার পর আবিষ্কার করেছিলাম ঘড়ির কাঁটা খুব দ্রুত গতিতে ঘুরে, আসলেই কি তাই? কিছুটা, তবে বিষয়টা ঠিক এভাবে না। পড়ালেখা আর কাজ এই দুইটার মাঝখানে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকানোর সুযোগ কমই পাওয়া যেতো, যার জন্য যখনই সুযোগ পেতাম, তাকিয়ে মনে হতো ঘড়িটাই বুঝি তাড়াহুড়ো করছে।  তো কাজকর্ম এবং পড়ালেখা দুটোই সাময়িক বন্ধ হওয়ায় আমিও আবার ফিরে পেলাম সেই দেশে থাকাকালীন স্লো-মোশনে চলতে থাকা ঘড়ির কাঁটা।

এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় উপলব্ধি করলাম, এই ঘড়ির কাঁটার গতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দূরুত্ব ও সম্পৃক্ততা বলতে পারেন ভাইস-ভার্সা। যেমন আমি যখন কাজ আর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর খুব কমই নিতে পারতাম। আবার এখন যখন ঘড়ির কাঁটা ধীর গতির, মানে হাতে অনেক সময়, স্বজনরাও খুশি।

সকালবেলা ফযরের নামাজ শেষে বারান্দায় বসে উচ্চস্বরে কোরআন শরিফ তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হতো দিনের কার্যাবলি। আমার বাবা হুজুর ছিলেন বলে যে আমি তা করতাম তা কিন্তু না, আমাদের বয়সি গ্রামের প্রায় সবাই একইভাবে দিন শুরু করতো। দিনের বাকি সব কাজকর্ম মক্তব, স্কুল, খেলাধুলা শেষে, সন্ধ্যার মাগরিবের নামাজ শেষে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে কিছুক্ষণ বসে সান্ধকালীন নাস্তা খাওয়া হতো।

যদিও এই নাস্তা পরবর্তী ধাপটা (আব্বা আর হোম টিচারের রিমান্ড) অনেক কঠিনভাবে পার করতাম। কিছু যান্ত্রিক প্রলোভনে পড়ে ভুলতে বসেছিলাম সেই ছোটবেলায় আমাদের গ্রাম্য পরিবারগুলোর পুরনো রীতি। যাই হোক, লকডাউনে থাকার সুবাদে আবার ফিরে পেলাম সেই পেছনের কিছু অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার সুযোগ। সেই সঙ্গে মাগরিব শেষে ভাই আর ভাবির সঙ্গে সন্ধ্যার নাস্তায় ফিরে পাই সেই ছোটবেলায় ঘরের সবাই মিলে হাসিমুখে কাটানো সময়ের কিছুটা স্বাদ।

বাবা আর হোম টিচার এখানে না থাকায় এই উভয়ের দায়িত্ব পালনের কাজটা আমিই নিলাম, আর আমার জায়গায় পাঠিয়ে দিলাম আমার ভাইয়ের পাঁচ বছরের ছেলে আলবাব আর দুই বছরের মেয়ে আলিফকে। তবে আমি আমার সেই হোম টিচারের মতো নির্দয় হতে তো পারি না, অবশ্য এখনকার আমি (আলিফ আলবাব) আগের আমির চাইতে হাজার গুণ শান্ত, নম্র ভদ্র এবং মেধাও ভালো। তাই টিচার হিসেবে আমার কঠোর হয়ে আর উঠা হয় না।

কাজের ক্ষেত্রে  এবং পড়ালেখায় আমার বেশ কয়েকজন কাছের বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কথাবার্তা, দেখা, আড্ডা হয়। অনেকগুলো কাছের লোকদের মাঝেও দুই-একজন মানুষ একটু বেশি কাছের, মায়ার হয়ে থাকে। এরকমই একটা ফ্রেন্ড আমার যার নাম হাসান। সে একটু বেশি মায়ার, এজন্যই যে দেখতে অনেকটা বাঁশের কঞ্চির মতো খাটো শরীর ওর, মায়া ছাড়া তার প্রতি আর কোন ধরনের অনুভুতি আপনার হবেই না। তো ঘরে থাকার দরুণ সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ নাই।

তাই অনলাইনের মাধ্যমে হাসানকে যখনই ভিডিও কল দিলাম, আমি আরেকটা বিষয় আবিষ্কার করে ফেললাম আর তা হলো আমার ওই অনেক কাছের বন্ধুর চেহারাটাই আমার কাছে অপরিচিত। অবাক হচ্ছেন, আমিও হয়েছিলাম। প্রথম দিন দেখার পর থেকেই তাকে চেনার জন্য তার চেহারাটার দিকে তাকানোর প্রয়োজন ছিলো না, কেন সেটা তো বুঝেই গেছেন। কিন্তু মোবাইল ফোনে তো চেহারা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তো আমিও ভালো করে তার চেহারা দেখে নিলাম আর ভাবলাম, ভাগ্যিস বিষয়টা ক্লিয়ার হলো এই করোনার অছিলায়, না হলে হয়তো কোনদিন কোন বিপাকে পড়তে হতে পারতো।

সব শেষে খুঁজে পেলাম নিজের চিন্তাশক্তি। আসলে আমরা অনেক কিছুই চিন্তা করার ক্ষমতা রাখি, আর সেই ক্ষমতাটাকে আমরা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে কেউ ভালো থাকি, কেউ খারাপ, অসহায়, কেউ ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে থাকি। মানুষের চিন্তাশক্তি হোক আরও ইতিবাচক, কাজে আসুক ভালো থাকার মাধ্যম হিসেবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ার, যুক্তরাজ্য

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!