করোনাভাইরাস: জার্মানিতে পড়তে এসে যেমন আছি

আমি জার্মান সরকারের ভাষা এবং গবেষণা ফেলোশিপ নিয়ে গত মাসে জার্মানিতে এসেছি। এখানে আসার পর আমি গোয়েতে ইনস্টিটিউট মানহাইমে জার্মান ভাষা শিখতে শুরু করি।

মো. জাহিদ হোসেন ভূঁইয়া, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2020, 02:48 AM
Updated : 9 April 2020, 02:48 AM

ক্লাস চলাকালীন আমি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনন্দের সময় কাটিয়েছি। আমরা মানহাইম ও হাইডেলবার্গ শহরের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেছি। তবে করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের নিয়মিত ক্লাস এখন ১৮ মার্চ থেকে অনলাইন ক্লাসে রূপান্তরিত হয়েছে। সেদিন থেকে আমরা কোনও কারণ ছাড়া বাইরে যাওয়া বন্ধ করলাম।

তবে আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে কিছুদিন আগে মানহাইম শহরে গিয়েছিলাম। রাস্তায় আমি খুব কম লোককে দেখেছি। ব্যস্ত শহর এখন শান্ত ও নিস্তব্ধ। লোকেরা ব্যাংকে এবং সুপারমার্কেটে সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করছে। তবে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখনও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। তারা ঘরে থাকতে চায় না, তারা পছন্দ করে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে।

কিছু মানুষ সামাজিক দূরত্ব নীতি অনুসরণ করতে পারছেন না তাদের দারিদ্রের কারণে। ত্রাণ সংগ্রহের জন্য তাদের বাড়ির বাইরে যেতে হয়। খিদের জ্বালা বড় জ্বালা!

এখন জার্মানিতে বসন্ত। জার্মানিতে বসন্ত কেবল গাছ, পাতা এবং ঘাসকে রূপান্তরিত করে না; এটি পুরো দেশকে এবং এর বাসিন্দাদের রূপান্তরিত করে। লোকেরা আরও বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক হয়ে ওঠে। তারা শীতের রুক্ষ আবহাওয়া পার করে বসন্তে বাজারে, পার্কগুলিতে, ব্রিজ এবং হ্রদে যেতে শুরু করে। খাল বা পার্কে কিছু মধ্যাহ্নভোজ নিয়ে ঘাস এবং আবহাওয়া উপভোগ করে। তবে এ বছরের মিষ্টিরোদ পোহানোর বসন্তের দিনগুলি করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ উপভোগ করছে না।

করোনাভাইরাসের কারণে জার্মান সরকার তার বাসিন্দাদের জন্য একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে: লোকেরা তাদের নিজের পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ করবে; জনসাধারণের মধ্যে ন্যূনতম ২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে; সুপারশপ, ডেলিভারি খাবারের দোকান, ব্যাংক, ফার্মেসি ইত্যাদি খোলা রাখা যাবে; হেয়ার ড্রেসার, কসমেটিক স্টুডিওস, ম্যাসাজ পার্লার এবং ট্যাটু স্টুডিওগুলির মতো ব্যক্তিগত যত্নের ক্ষেত্রে পরিসেবা সংস্থাগুলি অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করতে জার্মান কেন্দ্রীয় সরকার এবং ১৬টি রাজ্য প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন ইউরো ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ প্রতিশ্রুতির অধীনে আছে: করোনাভাইরাস সংকটের কারণে ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দিতে না পারলে ভাড়াটেদের আগামী তিনমাসের মধ্যে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া যাবে না এবং যারা বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিযোগাযোগ এবং কিছুক্ষেত্রে সংকটের কারণে পানির বিলগুলি কাটা হবে না; যদি কোনও কর্মীর কাজ না থাকে তখন ফেডারাল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি কর্তৃক তার মজুরির ৬০% অর্থ দেওয়া হবে; একক মালিকানা ব্যবসা, সংগীতশিল্পী, ফটোগ্রাফার, বিকল্প স্বাস্থ্যচিকিৎসাবিদ এবং দশজন কর্মীসহ ছোট সংস্থাগুলো সরাসরি আর্থিক সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারেন।

জার্মান রাষ্ট্রায়ত্ত উন্নয়ন ব্যাংককে এফডাব্লু সমস্ত কোম্পানির জন্য সীমাহীন ঋণ কার্যক্রমের প্রস্তাব দিচ্ছে এবং তারা আর্থিক জরুরি পরিস্থিতিতে করের পেমেন্ট পিছিয়ে দিতে সক্ষম হবে এবং আপাতত অর্জিত মুনাফার একটি অংশ সিএসআর এর আওতায় সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা দিতে হবে না; কৃত্রিম বায়ু চলাচল সরবরাহকারী প্রতিটি নতুন নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের জন্য হাসপাতালগুলি ৫০ হাজার ইউরো পাবে এবং কেন্দ্রীয় সরকার ওষুধ সম্বন্ধীয় পণ্য ও প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম সংগ্রহের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কোনও আর্থিক সহায়তা নেই। অনেক বাংলাদেশি ছাত্র জার্মানিতে পড়াশোনার জন্য এসে খণ্ডকালীন চাকরি করে। এ শিক্ষার্থীরা এখন আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। এসময় জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের উচিত এ শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করা বা খবরাখবর রাখা।

জার্মানির ১৭০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬৬৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সরকার এর বিস্তার কমিয়ে আনার উপায় খুঁজছে। করোনাভাইরাস নির্ধারণের প্রশ্নে একমাত্র উপায় হল ব্যক্তি নমুনা পরীক্ষা করা। জার্মানি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ নমুনা পরীক্ষা করে থাকে। করোনাভাইরাস মহামারীতে রোগীদের থাকার জন্য জার্মানিতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) বেড ১২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে এ ভাইরাসে এখন পযর্ন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১৬৪। বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ২ হাজার ৪১৯ এর (৩ এপ্রিল পর্যন্ত) মতো ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা ও ১ হাজার ১৬৯টি আইসিইউ বেড থাকা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যথেষ্ট নয়। গরিব মানুষের বসবাসে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। দেশের এ কঠিন সময়ে বিত্তশালীরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নির্ণয় করার কিটের ঘাটতি ও আইসিইউ বেডের অপ্রতুলতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হতে পারে। সবাই সুস্থ্য ও নিরাপদ থাকুন।

লেখক: গবেষক, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কম্পারেটিভ পাবলিক ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ল, হাইডেলবার্গ, জার্মানি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!