করোনাভাইরাস: ইতালিতে গৃহবন্দি প্রবাসীর ডায়েরি, পর্ব ৭

২০১৬ সালে আব্বুর হার্ট অ্যাটাক, বাইপাস সার্জারির সময়টা আমাদের জন্য ছিল দুর্বিসহ। তখন থেকেই আমাদের প্রাত্যহিক খাবারের মেন্যুতে পরিবর্তন এসেছে। এই দুর্যোগের সময়ও আমরা খাবার মজুদ করছিনা একদমই।

ফাতেমা আখতার মিতু, ইতালি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2020, 05:29 AM
Updated : 3 April 2020, 05:29 AM

প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর বাজার হাতে পাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ। অন্যান্য অনেক জায়গার চেয়ে আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত সুযোগ সুবিধাগুলো বেশ ভালো পাচ্ছি এটাও আল্লাহর অশেষ রহমত। আমার মেঝমামা থাকেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে। সেখানে অনলাইনে বাজার করতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু অনেক সময় পাঁচটা আইটেমের মধ্যে তিনটা আইটেমই হাতে পাচ্ছেন না, আর ডেলিভারির স্লট খালি পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হচ্ছে তাদের।

তাজা শাকসবজির কথা না হয় বাদই দিলাম, অন্যান্য শুকনো খাবারও পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। আমরা আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত এই সমস্যায় পড়িনি বলে খাদ্যাভ্যাস অপরিবর্তিত রাখতে পেরেছি। যতটুকু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে সেটা যেন কমে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখছি খুব। ‘আহ! দুজনেই বাসায় আছি, বানাই একটু বিরিয়ানি! কাল খিচুড়ি আর ঝাল গরুর মাংস রান্না করে জম্পেশ একটা খাওয়া দিই!’ এসব চিন্তা বহু আগে থেকেই আমাদের জীবনে বাতিলের তালিকায় পড়ে গেছে।

রবি খেতে খুব ভালোবাসে। অনেক কষ্টে তাকে ‘খাওয়ার জন্য বাঁচা’ থিওরি থেকে ‘বাঁচার জন্য খাওয়া’ থিওরিতে চলতে রাজি করিয়েছি। কার্ব বা শর্করা জাতীয় খাবার, চিনি ইত্যাদি আমাদের সবারই পরিমাণের চেয়ে কম খাওয়া উচিত। মিষ্টি কিংবা শর্করাজাতীয় খাবার যেমন- ভাত, আলু, পাস্তা, নুডলস এসব আমাদের শরীরে রক্তের নিউট্রোফিলকে (একধরনের শ্বেত রক্তকণিকা) দুর্বল করে দেয়। দুর্বল নিউট্রোফিল শরীরে ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের রিস্ক বাড়িয়ে দেয়।

আবার ভাইরাসজনিত সংক্রমণে অতিরিক্ত প্রদাহ (ইনফ্লামেশান) এবং টিস্যুক্ষয় ফুসফুসের কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুস অকার্যকর হয়ে যাবার কারণে মৃত্যু ঘটে। ঠিক কোন ধরনের খাদ্য উপাদান করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করবে তা এই মুহূর্তে জোর গলায় বলা কঠিন। তবে সাধারণ সর্দি, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অন্যান্য শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণের (রেস্পিরেটরি ইনফেকশান) ক্ষেত্রে বেশ কিছু খাদ্য উপাদানের প্রভাব রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটা সত্য, এই মহামারির সময় যথাযথ খাবার যোগাড়ের ব্যবস্থা সহজ নয়। তারপরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিয়ে থাকা যায় না।

‘মেডিটেরেনিয়ান স্টাইল অব ইটিং’ হলো বেশি পরিমাণে ফল, শাকসবজি, হৌল গ্রেইন্স বা শস্যদানাযুক্ত এবং ভালো ফ্যাটযুক্ত খাবার। এ ধরনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান যেমন ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, জিংক, ভিটামিন বি৬ এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুর সঙ্গে ফাইট করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট, জিংক, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডকেও।

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি সর্দি, ঠান্ডার মৌসুমে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার, হালকা গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে খাওয়ানোর ব্যাপারে আম্মু খুব তৎপর থাকতো। মায়ের থেকে শেখা বৈজ্ঞানিক টোটকা অবশ্য এখন নিজের সংসারেও প্রয়োগ করি। বৈজ্ঞানিক টোটকা বলছি কারণ, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে ভিটামিন-সি আমাদের ইমিউন সিস্টেম উদ্দীপ্ত করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যেকোনো ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল চাবিকাঠি ‘শ্বেত রক্তকণিকা’ বাড়াতে ভিটামিন সি প্রয়োজন। বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খেলেই যে করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হবেনা তা নয়, তবে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা সহজতর হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য বিভ্রান্তিকর তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী খাওয়া যাবে, কী খাওয়া যাবে না এ ধরনের বিশাল লিস্টও আছে। এখানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। এসব লিস্টের অনেক খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজে লাগে, কিন্তু আবার অনেক কিছু লেখা হচ্ছে যাতে উপকারের থেকে অপকার বেশি। তাই সোশ্যাল মিডিয়াকে অথেনটিক সোর্স হিসেবে না নিয়ে তথ্য যাচাই করে নেওয়া উচিত।

আর কোনোভাবেই সাবধানতা রক্ষা কিংবা ডাক্তারের পরামর্শের অল্টারনেটিভ এগুলো নয়। অনেকের ধারণা যেহেতু করোনাভাইরাস অন্য প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে, তাই মুরগির মাধ্যমেও তা ছড়াতে পারে। টুকটাক পড়াশোনা করে এমন কোনো তথ্য পাইনি যেখানে মুরগির মাংস খাওয়ার সঙ্গে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস আক্রমণের সম্পর্ক পাওয়া যায়। তবে সব প্রকার প্রাণীই যেহেতু জীবাণু বহন করতে পারে, তাই গরু বা মুরগির মাংস ধরার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত।

আমরা সাধারণত যেকোনো খাবার ১০০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় রান্না করে থাকি। উচ্চ তাপমাত্রায় ভালোভাবে রান্না করলে মাংস খেতে সমস্যা নেই। তাছাড়া মুরগির মাংসে ভিটামিন বি৬ আছে যা আমাদের দেহে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

জিংকের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ডাল, শস্যদানাযুক্ত খাবার, বাদাম, সবুজ শাকসবজি যেমন বরবটি, ডিম, দুধ খাদ্য তালিকায় রাখছি। শীতপ্রধান দেশের একটাই সমস্যা, আর কিছু হোক না হোক শীতের সময় পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর অভাবে দেহে ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা দেখা যায়। তাছাড়া আজ ৪২ দিন হয়ে গেলো বাসার বাইরে যাই না। তাই ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে যোগ করছি। এছাড়া কালোজিরা, রসুন কিংবা আদায় অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি বৈশিষ্ট্য আছে এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

আমি মনে করি আমাদের জীবনের সবচাইতে বড় ওষুধ হলো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে আমরা সঠিক খাবার নির্বাচন করতে পারি, যা সরাসরি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ না করলেও পরোক্ষভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। যখন আমরা কোনো বিষয় বা পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করি বা উদ্বেগের মধ্যে থাকি তখন আমাদের শরীর স্ট্রেস হরমোন তৈরি করে যা আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের’ একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম সেদিন। এক গবেষণায় সাধারণ সর্দি কাশি হয়েছে এমন কয়েকজনকে ৫ দিন কোয়ারাইন্টাইন করে রাখার পর দেখা যায়, যেসব রোগী বেশি চিন্তিত ছিলেন, অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আর যেসব রোগী সর্দি কাশিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাচ্ছিলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাচ্ছিলেন, অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা কম করছিলেন তারা বেশ দ্রুত সুস্থ হয়েছেন। জানি স্ট্রেস বা টেনশান করা আমরা চাইলেও জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না, তারপরও এর সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য আমাদের কিছু স্ট্রেটিজি অনুসরণ করা প্রয়োজন। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, মেডিটেশান করেন তাদের রেস্পিরেটরি ইনফেকশান জাতীয় রোগে কম ভোগেন। আর যদি অসুস্থ হয়েও থাকেন, তার মাত্রা থাকে খুবই সামান্য।

আসলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এ পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান কতোটা নাজুক। আমাদের সাধারণ জনস্বাস্থ্য কৌশল, যেমন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভাইরাস শনাক্তকরণ, অসুস্থদের চিকিৎসা ইত্যাদির পাশাপাশি ধৈর্য্য ধারণ করাও শিখতে হবে। বিজ্ঞানীদের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সময়টুকু দিতে হবে। জানি পথটা সহজ নয়, হয়ত আগামি দুই এক বছর পর্যন্ত লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে।

আগের পর্ব

লেখক: পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া প্রদেশের ভিয়া জিওভান্নি তাভাজ্জানি এলাকায়

চলবে…

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!