কোরিয়ার ‘রোগী নম্বর ৩১’ ও করোনাভাইরাসের শিক্ষা

জানুয়ারির ২০ তারিখে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৩৫ বছর বয়স্ক এক নারী উহান থেকে ইনছন বিমানবন্দরে অবতরণ করলে। পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে  কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।

ওমর ফারুক হিমেল, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2020, 05:06 AM
Updated : 1 April 2020, 05:06 AM

পুরো একমাসে কোরিয়ায় মাত্র ৩০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। কিন্তু কাজপাগল জাতি কাজে ব্যস্ত। প্রস্তুতি থাকলেও এটিকে প্রথম থেকে নজর দেয়নি সিউল প্রশাসন। এরপর কোরিয়ার কাহিনী অন্যরকম। ‘রোগী নম্বার ৩১’ যেন এক ‘সুপার স্প্রেডার’। কোরিয়ার রোগতত্ত্ব বিভাগের মতে, দেশটিতে করোনাভাইরাস রোগী বৃদ্ধির পেছনের নায়িকা হলো ‘রোগী নম্বার ৩১’, তিনি সবচেয়ে বেশি এ রোগ ছড়িয়েছেন। অধিক সংখ্যক মানুষের সংসর্গে এসে, পুরো কোরিয়ায় এ রোগ ছড়িয়েছেন। এমনটি জানিয়েছে কোরিয়ান ‘সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’।

এবার শুরু করছি পুরো আদ্যোপান্ত। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে ৬১ বছর বয়সী একজন নারী ট্রাফিক দুর্ঘটনায় পড়ে কোরিয়ার দেগুর এক হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন ফেব্রুয়ারির ৯ ও ১৬ তারিখে তিনি শিওমপঞ্জি সম্প্রদায়ের গির্জায় দুইবার যান, এর মধ্য একবার গিয়েছেন গির্জার এক শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। এর মধ্য ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি তার জ্বর ধরা পড়ে এবং ডাক্তাররা তাকে করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করতে পরমার্শ দেন, একইসঙ্গে সেলফ আইসোলেশনে থাকার জন্যও বলেন।

চিকিৎসকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ওই নারী ১৬ তারিখে গির্জাতে যান, একইসঙ্গে বন্ধুর সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় যান লাঞ্চ বুফে খেতে। এর মাঝে এ নারী উপস্থিত ছিলেন আরও একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেও। ১৭ তারিখে ওই নারীর অবস্থার অবনতি হলে তিনি অবশেষে করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করান। ১৮ তারিখে ফলাফল জানা যায় করোনাভাইরাস পজিটিভ, বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচিত দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাভাইরাস ‘রোগী নম্বর ৩১’।

এরই মাঝে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা রীতিমত জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে, যারা দেগুর সেই গির্জারই সদস্য। যেখানে কোরিয়ার গণমাধ্যমে ‘ক্রেইজি আজুম্মা’ (পাগল চাচী) নামে পরিচিত ওই নারী দুইবার গিয়েছিলেন। তাকে কোরিয়ার গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক  গণমাধ্যম ‘সুপার স্প্রেডার’ বলছে।

কোরিয় ‘সেন্টার ফর ডিজিজ অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ (কেসিডিসি) এর উপাত্ত অনুযায়ী, ‘রোগী নম্বর ৩১’ যে দুইবার গির্জায় গিয়েছিলেন, সে দুইবার মোট ৯ হাজার ৩০০ জন মানুষ ছিলেন সেখানে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ২০০ জনের পরবর্তীতে ফ্লু এর মতো উপসর্গ ধরা পড়ে। কিন্তু ‘রোগী নম্বর ৩১’ যে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন, সেখানে কত মানুষ ছিল সেই হিসাব অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া, এই একই গির্জার বেশকিছু সদস্য জানুয়ারি ৩১ থেকে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখের মাঝে দেগুর পাশেই আরেক শহর ছংদোতে এক হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে।

দেগু আর ছংদো এ দুই শহরেই পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের ৮০ ভাগ। যদি কেসিডিসির উপাত্ত সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বলা যেতে পারে এই যে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাস বিস্ফোরণ, তার পিছনে এই গির্জা এবং বিশেষ করে ‘রোগী নম্বর ৩১’ এর বিশাল হাত রয়েছে।  আরেকটি সরকারি তথ্য এসেছে, করোনাভাইরাস বহন করে মোট চারটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন ওই নারী। একইসঙ্গে যে বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন সেখানেই কতজন লোক ছিল তা জানা যায়নি। কিন্তু বিয়েতে গিয়েছিলেন এমন এক পরিবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত  হয়েছেন, যেখানে একটি ১৭ মাসের শিশু ছিলো। শিশুটিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত  হয়েছে।

ওই পরিবারের তিন সদস্য চিকিৎসা নিয়েছিলেন মিজু হাসপাতাল ও সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। পরিবারটি সুস্থ  হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কোরিয়ার সিউল টাইমসের একটি প্রতিবেদনে এসেছে, খিম্পু সিটি জানিয়েছে, শিশুসহ পরিবারটি পুণরায় করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। ‘রোগী নম্বর ৩১’ এর খামখেয়ালীতে কোরিয়ার মতো প্রযুক্তি নজরদারির দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো।

এদিকে আইরিশ গণমাধ্যমে এসেছে আরেক তথ্য, কোরিয় নেটিজেনরা ‘রোগী নম্বর ৩১’কে তারা ‘ক্রেইজি আজুম্মা’ বলছে। কারণ হিসেবে তারা বলছে, গলা ও জ্বরের মতো লক্ষণ নিয়েও তিনি করোনভাইরাসটির পরীক্ষা করতে দুইবার অস্বীকার করেছিলেন, তার অবস্থা আরও খারাপ হওয়া সত্ত্বেও দুইবার গির্জাতে গিয়েছেন। গাড়ি দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ১০ দিনের জন্য তাকে ওয়ার্ড করা হলেও তিনি নির্দ্বিধায় ঘোরাঘুরি করেছিলেন। একইসঙ্গে ওই নারী বুফে রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করতে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং দেগুর পাশের শহর ছংদোতে জিমজিলবাং-এ সময় কাটিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত করোনাভাইরাস পরীক্ষা দিতে সম্মত হওয়ার আগে তিনি এক স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে এক ঘণ্টা তর্ক করেছিলেন।

জানা যায়, ওই নারী শিমপিওঞ্জি গির্জার অনুসারী। তাদের ধর্মীয় নেতাকে তারা ‘এ যুগের যিশু’ মনে করে। গির্জাটি ধর্মীয় নেতা লি ম্যান-হি ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় এ গির্জার ১২টি শাখা রয়েছে এবং প্রায় ২ লাখ অনুসারী রয়েছেন।

কোরিয়ার এ ঘটনার মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মসজিদ থেকে যে করোনাভাইরাসের জীবাণু ছড়াতে পারে, তা জানা যায় দিল্লীর তাবলীগ জামাতের সাতজনের আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে। একইসঙ্গে কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ার ঘটনা ও  ফিলিস্তিনের গাজার ঘটনা থেকে। এদিকে ঢাকার মিরপুরে যে লোক মারা গিয়েছিল তিনি মাদ্রাসার সাবেক একজন অধ্যক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে তিনিও মসজিদ থেকে সংক্রমিত হয়েছিলেন। আবার তার যে প্রতিবেশি মারা গেছেন, ধারণা করা হচ্ছে তিনি ওই মাদ্রাসা অধ্যক্ষের সংস্পর্শে এসেছিলেন, কিংবা একই মসজিদ থেকে তিনিও সংক্রমিত হয়েছেন।

আবার প্রথমজনের চিকিৎসা যে ডাক্তার করেছিলেন তিনিও এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে আছেন। এখন বুঝতে বাকি নেই, দল বেঁধে মসজিদে যাওয়া, দল বেঁধে পুণ্যস্নানে যাওয়া, জড়ো হয়ে শপিংমলে বা বড় কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় এখন নয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে  দিচ্ছে কোরিয়ার দেগুর গির্জাটি, মালয়েশিয়া, দিল্লী ও ফিলিস্তিনের মসজিদের ঘটনাগুলো।

বাংলাদেশি সবাইকে মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করা হয়েছে, পবিত্র কাবা তাওয়াফ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আগেই মসজিদে জুমার নামাজ বন্ধ করা হয়েছে। খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানে বারান্দা থেকে এখন আর লোক জড়ো করে দীক্ষা দেন না। থাইল্যান্ডের বৌদ্ধমন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখনই সময় ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার, সেটি সহজ হবে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের প্রাণোচ্ছল প্রচেষ্টায়।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!