সুপারশপের শূন্য তাক ও করোনাভাইরাসের শিক্ষা

স্টেশনে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা রাতারাতি একেবারে সিকিভাগে নেমে এসেছে। স্টেশনের কারপার্কও ফাঁকা পড়ে থাকে ইদানিং।

মো. ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 March 2020, 05:23 AM
Updated : 31 March 2020, 05:23 AM

আগে যেখানে পার্কিং পেতে খুব ভোরবেলায় কাজে যেতে হতো এখন সেখানে সারাদিনই অনেকগুলো স্পট খালি পরে থাকে সারাদিন। আগে যেখানে ট্রেনে উঠে সিট কোথায় পাবো সেটা নিয়ে ভাবা লাগতো এখন সেখানে ট্রেনে উঠে ভাবি কোন সিটে বসবো। পুরো বগির প্রায় পুরোটাই ফাঁকা পরে থাকে। এরপরের স্টেশনগুলো থেকে এতো বেশি লোক উঠতো যে নামার সময় হুড়োহুড়ি লেগে যেতো। গেটের কাছে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে মানুষকে নামার জায়গা করে দিতো।

এরপর স্টেশনের সিঁড়িতে শুরু হতো ছুঁচোর দৌড়। তারপর বাসের সামনে বিশাল লম্বা লাইন। বাসে উঠেও বেশিরভাগ মানুষই আমরা সিট পেতাম না, তবে বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা এবং ছোট বাচ্চাসহ নারীদের সিট করে দিতো সবাই নিজেরা দাঁড়িয়ে গিয়ে। তার বিনিময়ে সেই মানুষগুলো এতো মিষ্টি করে ধন্যবাদ দেয় যে মনটায় ভালো হয়ে যায়। সারাটা দিন খারাপ গেলেও এই একটা ধন্যবাদ আপনার মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এটাই সৌজন্যতা, এটাই ভদ্রতা, এটাই মানবতা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে সবখানেই মানুষের পদচারণা উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক কমে গেছে।

এইবার আসি গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি পর্যালোচনায়। করোনার ভয়ে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ শুরুতে সব ধরনের টিস্যু পেপার আর স্যানিটাইজার মার্কেট থেকে কিনে ফেলেছে তার মধ্যে টয়লেট টিস্যু অন্যতম। টয়লেট টিস্যু ফাঁকা করে দেওয়ার পিছনে ঠিক কী কারণ থাকতে পারে আমার জানা নেই। তবে আমাদের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে বলল, বাবা চীন থেকে খুব শীঘ্রই টিস্যু আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবে, তাই সবাই টিস্যু মজুদ করছে। এছাড়া সব ধরনের শুকনো খাবারও শেষ হয়ে যেতে শুরু করলো।

এতো গেলো অস্ট্রেলিয়ার চেইনশপগুলোর হাল। গতকাল আমাদের এক পরিচিত বাংলা দোকানগুলোতে গিয়েও কোন প্রকার দ্রব্য সামগ্রী অবশিষ্ট পাননি। উনি ধারণা করে গিয়েছিলেন দাম বাড়লেও জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। গতরাতে আমাদের এক বাংলাদেশি প্রতিবেশী আমাকে ক্ষুদে বার্তা দিলেন যে উনার বাচ্চার গুড়ো দুধ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কোথায় পাচ্ছেন না। আমি কোনভাবে উনাকে সাহায্য করতে পারি কিনা।

উনার ক্ষুদেবার্তা পড়ে চোখের পানি ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না। আমরা কতটা নিচে নেমে গেছি। আমি যতদূর জানি পশুরাও তাদের সমাজে শিশুদের অগ্রাধিকার দেয় সে যার শিশুই হোক। একই অবস্থা হয়েছে বয়স্কদেরও। উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বয়স্করা। উনারাও খুবই বিপদে আছেন এই প্যানিক বাইয়ের ফলে। উপায়ন্তর না দেখে দোকানগুলোতে এলডারলি শপিং আওয়ার চালু করেছে, কিন্তু সেটা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। আবার জনপ্রতি জিনিসপত্রের লিমিট করে দেয়াতে উনারা বেশি কিনতেও পারছেন না। একটা নিউজে দেখলাম এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা বলছেন, আমি আমার বৃদ্ধা মাকে এই সাতসকালে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি, কারণ জনপ্রতি লিমিট করে দেয়া হয়েছে। এখন যদি এখানে কোন কিছু না পাই তবে আবারও আমাকে অন্য শপিংমলে ছুটতে হবে যেটা আমার মায়ের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির।

অস্ট্রেলিয়াতে এখনো স্কুল, কলেজ বা অফিস রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি। তবে অনেক অফিসই তাদের কর্মীদেরকে বাসা থেকে অফিস করার নির্দেশনা জারি করেছেন। আমাদের মেয়েটা গত কয়েকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে কবে স্কুল ছুটি দিবে, আবার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের কারণে বাতিল হয়ে যাওয়া অ্যাথলেটিক কার্নিভালের জন্য পস্তাচ্ছে। স্কুলগুলো এখনও করোনাভাইরাসের প্রভাবমুক্ত রয়েছে, তবে দিনে দিনে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। বাসে ট্রেনে কেউ হাঁচি বা কাশি দিলে সবাই আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে।

ঋতু পরিবর্তনের ধারায় অস্ট্রেলিয়াতে শীতকালের আগমন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তাই ভোরবেলায় চারদিক কুয়াশায় ঢেকে থাকে। সামান্য হাঁচি কাশি এসময় খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু করোনার প্রভাবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় ভীতির কারণ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে আপনি ট্রেনে বসে যদি একটা হাঁচি বা জোরে কাশি দেন তাহলে আগে যেখানে পাশের মানুষটা ‘ব্লেস ইউ’ বলতো এখন সেখানে সবাই সেই বগি ছেড়ে চলে যায়।

অস্ট্রেলিয়াতে লেভেল ৩ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যার মানে হচ্ছে একেবারে প্রয়োজনীয় কিছু সুযোগ সুবিধা ছাড়া মোটামুটি সবকিছুই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর যেসব সুবিধাগুলো খোলা রাখা হয়েছে সেখানেও সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। শপিং সেন্টারগুলোতে মার্ক করে দেয়া হয়েছে একজন ক্রেতা সামনে দাঁড়ালে তার পিছনে ঠিক কোন জায়গায় অন্যজন দাঁড়াতে পারবেন। বেচাকেনাতেও কিছু নিয়ম আরোপ করা হয়েছে, যেমন একজন ক্রেতা একটাই মাত্র টয়লেট টিস্যুর বাক্স কিনতে পারবেন।

ঠিক একই রকম নিয়ম আরোপ করা হয়েছে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রেও যাতে করে কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়। বেশির ভাগ অফিসই তাদের কর্মীদেরকে বাসা থেকে অফিস করার পরামর্শ দিয়ে দিয়েছে। আর যেগুলো খোলা আছে সেখানে সামাজিক দূরত্ব এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।

সরকারিভাবে এখনও স্কুলগুলো বন্ধ করা হয়নি, তবে বাচ্চাদেরকে স্কুলে না পাঠানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। স্কুলগুলো মূলত খোলা রাখা হয়েছে যাতে করে এই দুর্যোগের সময়েও যারা কাজ করছে তাঁদের বাচ্চাগুলো যেন একটা শেল্টার পায়। সব স্কুলই তাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বাড়ির কাজ বা অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেছে। বাচ্চারা সারাদিন বাসায় সময় কাটাচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যেই অনেকে সমুদ্র সৈকতে গিয়ে আনন্দ ফুর্তি করেছিলো। পরবর্তীতে সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈচৈ হবার পর সরকার এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে গেছে।

গতকাল অস্ট্রেলিয়ার একটা রাজ্যে একজন প্রতিবেশী অন্য একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে আলাপ করাতে তাদেরকে জরিমানা করেছে। রাস্তাঘাটগুলোতে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন বা কোথা থেকে আসছেন। উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারলে সেখানেও ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে জরিমানার টিকেট।

সিডনিতে সারা বছর জুড়েই বিভিন্ন রকমের মেলা বা অনুষ্ঠান চলে। এবারের সমস্ত অনুষ্ঠানাদি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া শীতকালে নগরকে ব্যস্ত রাখার জন্য যেসব বাড়তি আয়োজন করা হয় সেগুলোও একে একে বাতিল করা হচ্ছে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সিডনি নগরী এখন অনেকটাই ভুতুড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে পুরো শহরই যেন কোয়ারেন্টাইনে আছে। ‘ডিপার্টমেন্ট অব হেলথের’ আপডেট অনুযায়ী আজকে পর্যন্ত (৩১ মার্চ ২০২০) অস্ট্রেলিয়াতে ২ লাখ ৩০ হাজার জনকে পরীক্ষা করে ৪ হাজার ৩৫৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে যার মধ্যে মোট ১৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।

অস্ট্রেলিয়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে যাতে করে তারা কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিমানুষেরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক রেঁস্তোরা খাবার রান্না করে একেবারে বিনামূল্যে বাড়িবাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে বিশেষ করে বয়স্কদের। বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস এবং তার স্ত্রী রিটা উইলসন অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিলেন একটা চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের কাজে। পরবর্তীতে উনাদের দুজনেরই করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পরে গত ১১ মার্চে। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর উনাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। উনারা নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেই অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।

করোনার এই প্রাদুর্ভাবেও কিছু ভালো খবর মানবসভ্যতাকে ভাবিত করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী বেশকিছু ভালো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন প্রকৃতি যেন এই সুযোগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে প্রথমবারের মতো গাঙ্গেয় শুশুক (এক শ্রেণির ডলফিন) দেখা গেছে। পরিবেশবিদদের ধারণা মানুষের কোলাহল কমে যাওয়াতেই শুশুকেরা ফিরে এসেছে। ঠিক একইরকম খবর পাওয়া যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার অনেক সমুদ্র সৈকতের ক্ষেত্রেও। মানুষের কম চলাচলের ফলে বায়ুদূষণের মাত্রাও রাতারাতি অনেক কমে গেছে।

এমন আরো বেশকিছু ভালো পরিবর্তন মানুষকে ভাবাচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে যথেচ্ছা ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। জানি না করোনাভাইরাসের কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষাটা মানুষ কতদিন ধরে রাখতে পারবে। তবে মানব সভ্যতার এই ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাপী এখনও সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা যার মধ্যে আছেন চিকিৎসক, নার্স ও আরো অনেকে। তারা তাদের নিজের, পরিবারের, সমাজের বা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

অনেকেই আবার এই রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজের দেহে রোগের সংক্রমণের ফলে মৃত্যুবরণও করেছেন। ভয়াবহ এ দুর্যোগের সময়ে এক শ্রেণির মানুষ যেমন ঘরে গাদাগাদা খাবার মজুদ করে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করছেন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন ঠিক তেমনি অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর্মীরা আবারও আমাদেরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবতার ঝান্ডা উড়িয়ে। দিনশেষে মানবতায় জয়ী হবে,  কারণ ইতিহাস সেটাই সাক্ষ্য দেয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবও মানুষ একসময় কাটিয়ে উঠবে, তবে রেখে যাবে কিছু ক্ষত।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!