বিদেশ ভালো: গাঁজার নৌকা আমস্টারডামতলী যায়

নাহ এমনটা নয় যে আমি কখনো ফুঁকিনি ফুঁকেছি। তবে গিলিনি। তাই গেলার উদ্দেশ্যেই…

রিনভি তুষার, লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2020, 01:43 PM
Updated : 24 March 2020, 01:44 PM

ফিরে আসা আনন্দের ছিল। এখন আতঙ্কের। বিদেশ ভালো ছিল… আর এখন বিদেশ ভালোর পর প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসছে।

পিতা-মাতা তাদের ঘরের ছেলে এবং মেয়েকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, স্বামী তার স্ত্রীকে, পুরুষ তার নারীকে আর নারী তার পুরুষকে চাইছে না ফেরত। শহীদ কাদরী বলেছেন -

"প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই

কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…”

কভিড-১৯ এর দিনে এখন মনে হচ্ছে- প্রেমিক আসিতে চাইবে প্রেমিকার কাছে ঠিকই, কিন্তু প্রেমিকা দুই মিটারের বেশি কাছে ঘেষিবে না,ঘেষিবে না।

তবু আমি ফিরলাম। করোনাভাইরাসের দিনে। ঘরে শুয়ে বসে যাতে আপনারা পৃথিবীকে কচি-কাচার মেলায় ভরিয়ে তুলতে না পারেন, আপনার রোগের ভয়ে গৃহবন্দির জীবনটা যাতে আরো একটু বিরক্তিতে ভরে উঠে, আপনার যাতে মনে হয় আমার লেখা পড়ার চাইতে করোনাভাইরাস পোষা ভালো… এসবের জন্যই  বিশ সেকেন্ড ধরে দুই হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে এই লেখা নিয়ে আমাকে ফিরতে হলো।

কথায় আছে পুণ্যবান যায় স্বর্গে, সমাজবিজ্ঞানী যায় আমস্টারডাম।

ছবি:  রিনভি তুষার

করোনাভাইরাস ঠিকঠাক তখনো চুমেনি ইউরোপের হৃদয়। মানে এই চুমে কিংবা চুমিবে এমন অবস্থা। তেমনই এক শুভদিনে আমি গেলাম বাপন বাবুর বাড়ি। বাপন সদ্য ফুলের দড়িতে ঝুলে পড়ে নিহত হওয়া কিঞ্চিত জীবিত যুবক তখনো। বাপন বাবু রাঁধেন ভালো। সে রাতে রেঁধেছিলেন রুই মাছের গন্ধওয়ালা সরপুটি।(লন্ডনে পাওয়া যায় এমন সব ফ্রোজেন মাছের গন্ধ একই রকম। আমার ধারণা মাছের গায়ে আলাদা করে গন্ধ জুড়ে দেয়া হয়। হয়তো এখানে রুই মাছের গন্ধ সব থেকে সস্তা।) তো বাপন বাবুর তো সদ্য নিহত হৃদয়। উনি পারবেন না কিন্তু কলেজকালের বন্ধু বাবু চাইলেন ( নাম নেয়া বারন)। আমি তখনো মাছের কাঁটায় আটকে আছি। এই চাওয়াতেই ঠিক হলো আমরা আমস্টারডামে গিয়ে মহাকাশ দর্শন করবো। আমস্টারডাম যাত্রা অনেকটা গন্ধম গেলার মতো। সবাই খেতে চায়। যেতে চায়। যায়। কিন্তু অনেকেই স্বীকার করে না। যেমন আমার সঙ্গীদ্বয়। সামাজিক কোয়ারেন্টিনের ভয়ে তাদের নাম প্রকাশ করা পুরোপুরি নিষেধ। তবে যেহেতু আমি সমাজবিজ্ঞানের পক্ষের লোক তাই পৃথিবীর তাবত পতিত স্থানে গমন আমার জন হালাল।

‘একের চেয়ে দুই ভালো, দুইয়ের চেয়ে ভালো তিন…’ আমার খুব কাছের এক সবজান্তা ছোটভাই থাকেন বার্লিনে। উনার সর্বজ্ঞানের জন্য উনাকে আমি ডাকি ‘মহাজন'। যদিও মহাজনের আমার ভাসুর হবার কোন সুযোগ নাই তবুও আমি উনার নাম মুখে বা আঙুলের আগায় আনতে পারবো না।

‘মহাজন’-এর অনেক গুণের এক গুণ ‘উনি বরাবরই দেখান মুরগি, খাওয়ান ডাইল'। তো উনি বার্লিন বসে আমাদের আমস্টারডাম নেবার দায়িত্ব নিলেন। হোটেল বুক করলেন পাঁচ তারকা টাইপ (সেই হোটেল আমস্টারডাম থেকে ম্যালা দূর)। উনি কিন্তু আবার আমাদের সাথে উঠলেন না। উঠলেন শহরের ভেতরের হোটেলে। যেই হোটেলে থাকা ফ্রি কিন্তু পয়সা দিতে হবে থাকার অভিজ্ঞতার জন্য।

বুঝলেন না তো?

ওকে, বোঝাই তাহলে…

ছবি:  রিনভি তুষার

ধরেন আমস্টারডাম শহরে অনেক কিছুই আপনি করতে পারবেন যার জন্য আপনাকে জেল খাটতে হবে না। কিন্তু অনেক অনেক মহানকর্ম সাধনের পর আপনার যদি মনে হয়, এবার একটু স্বেচ্ছায় জেলখাটার অভিজ্ঞতা নেয়া উচিত- তবে আপনাকে ফিরতে হবে ‘মহাজন’ এর হোটেলে। হোটেলের রুমগুলো এক একটা জেলখানার সেলের মতো। শুতে হবে ইলিশ ফাইলে। শুনেছিলাম এইসব দেশে নাকি কয়েদির অভাবে জেলখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হয়তোবা এইসব জেলখানাই আজকাল হোটেল হিসেবে ভাড়া হচ্ছে।

বার্লিন থেকে প্লেনে চড়ার আগেই আমার সাথে দেখা হলো এক নেশারুর। দুনিয়ার তাবত নেশা-ভাঙ করা উনার শ্যাষ। আমাকে বললেন- আমি কী করতে চাই? আমি বললাম, আমি চাই দুনিয়ার সব থেকে মহান নেশা করতে। কী সেটা? আমি এলএসডি উদযাপন করতে চাই। মহান কেন? কার অ্যালেন গিন্সবার্গ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করেছেন। তাই আমিও করতে চাই। তাছাড়া এলএসডি চেখে দেখলে নাকি মায়ের গর্ভে থেকে আমরা দিনে কতোবার লাথি দিয়েছি তাও মনে পড়ে যায়! এতো এতো কীর্তন শুনে নেশারু এক টুকরা মোটা কাগজ থেকে খুঁটে একটা কণা ধরিয়ে দিলেন। যেন দেবতার প্রসাদ। বললেন, পয়সা লাগবে না। আমি তার কতোটা নিলাম আঙুলের আগায়, আর কতটা বাতাসে উড়ে গেল তা জানলো না কেউ। প্রসাদ বার্লিনে রেখেই আমস্টারডাম গেলাম। আমস্টারডাম থেকে ফিরে বার্লিনেই আমস্টারডাম পাবো এই আশায়। (এলএসডি অভিজ্ঞতা নিয়েও লিখবো তবে আজ নয়, কাল অথবা কোন এক…)

আমস্টারডামের প্লেনে চড়লেই বুঝবেন কিভাবে গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায়। পাশের এক যাত্রী বললেন- প্লেনটাকে একটু বাঁকা মনে হচ্ছে।

আরেকজন বললেন, প্লেন ওড়া মানে তো আমিও উড়ছি তাই না?..উড়তে উড়তে তো আমার ডানার মতো হাত দুটো ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।

ছবি:  রিনভি তুষার

একদম ঠিক পাশে বসা এক বয়স্ক তরুণ বললেন- আহা আমার মুখটা যদি হাঁটুতে হতো… তবে নিজেকে কতো আদর করে করে ভাত খাওয়াতে পারতাম… আহা।

একসাথে একঝাঁক দার্শনিক নিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার জন্য হলেও আপনাকে আমস্টারডাম যেতে হবে।

কিঞ্চিত বাঁকা প্লেনে উড়ে উড়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ঠিকঠাক। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ঢুকলাম সাধারণ ক্যাফেতে। সাধারণ এই জন্য যে, এসব ক্যাফেতে গাঁজা ভাজা হয় না। আমস্টারডাম উচ্চ মুল্যের শহর। এমনকি ক্যাফেতে পানিটা পর্যন্ত কিনে পান করতে হবে।

পানা-খানা শেষ করে আমরা কিছুটা দিকভ্রান্তের মতো ঘুরলাম। আমি কখনোই চায়নিজ টুরিস্টদের মতো হাতে একখানা মহা-পরিকল্পনা নিয়ে ঘুরতে পারি না। ঘুরতে ঘুরতে আমার হারিয়ে যেতে ভালো লাগে… তারপর অচেনা কোনও মানবী-মানবের কাছ থেকে ঠিকানা খোঁজার বাহানায় তার জীবনের গল্প হাতিয়ে নিতে ভালো লাগে।

দিকভ্রান্তের অভিনয় শেষ করে আমরা চলে গেলাম আমস্টারডামের অনেক তীর্থের এক তীর্থ- গাঁজার ক্যাফেতে। চোখ বড়বড় করে দেখলাম- গাঁজায় বানানো মাফিন, প্যাস্ট্রি, রেড ভেলভেট কেইক। কি সাধারণ আর নিরীহ দর্শন কেইক! কেইক খাবার আগেই আমাদের কোন কেইকটা খাওয়া উচিত তা নিয়ে মহাধন্ধে পড়ে গেলাম। আমাদের মতো নবিশদের জন্য উনারা পরামর্শ দিলেন নিরীহ মানের কেইক খাবার জন্য। যেমন দশমিক ১ গ্রাম গাঁজা আছে এমন ‘মাফিন’। কিন্তু আমরা তা মানবো কেন? আমরা কি কোনদিন শহরের বুকে নেমে আসা নির্মম এবং বখাটে অন্ধকারের বুক চিড়ে পাহাড়তলী যাইনি? অস্পষ্ট যুবকের কাছ থেকে শুকনো পুঁই শাকের দাম নিয়ে করিনিকো কষাকষি? করেছি।

তাই আমরা ঠিক করলাম, আমরা পারি। পারবো। কিনলাম দশমিক ৩ গ্রামের চতুর্ভুজ টাইপ মাফিন। একটা নয় দুটো। কি বাহারি তার নাম স্পেইস কেইক বা মহাশূন্যের পিঠা। আমরা মহাশূন্যের পিঠা খাই আর আশেপাশে দেখি। আমাদের মগজে, হৃদয়ে মধ্যবিত্তীয় অপরাধবোধ। মধ্যবিত্তের মানসিকতা বড়ই অদ্ভুত। এরা হোটেলের ফ্রি টাওয়ালও চুরি করে।

আশে পাশের সবাই খুব ‘জাস্ট চিল’ মুডে মহাশূন্যের পিঠা নিচ্ছিল। কিন্তু আমরা গো-গ্রাসে গিলছিলাম। কারণ আমাদের কাছে পিঠা মানেই কারো বাড়িতে বেড়াতে যাবার পর প্লেটে সাজিয়ে বাড়িয়ে দেয়া আপ্যায়ন। এই আছে, এই নেই। তাই তাড়াতাড়ি গিলে খাও।

নাহ কিচ্ছু হচ্ছে না এবং হবেও না। এই ভেবে আমরা সন্ধ্যার ছায়ার জন্য অপেক্ষা করলাম। কারণ সন্ধ্যার ছায়া নামতেই পর্দা উঠবে আমস্টারডামের আরেক তীর্থের।

ছবি:  রিনভি তুষার

যেই তীর্থ দর্শনের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আমস্টারডামে আসেন। আমরা ‘কিস্যু হবে না, কিস্যু হয় নাই'মন্ত্র জঁপতে জঁপতে এগিয়ে গেলাম সেই তীর্থের দিকে। তীর্থে গেলে কিছু নিয়ম আপনাকে মানতেই হবে। যেমন এই তীর্থে পয়সার বিনিময়ে পূজাগ্রহণকারীদের ছবি তোলা নিষেধ। আক্ষরিক অর্থেই লাল বাতি পাড়া। কাঁচের দরজা দিয়ে বানানো ডিসপ্লে্ ডিসপ্লে-র সামনে লাল রঙের বাতি। ওই পাড়ে সহাস্য রমণী। অন্ধকারে জ্বলছে অন্তরের আবাস। তাদের চোখে-মুখে ইশ্বরকে দুই পা এবং পায়ের তালু প্রদর্শনের উদাত্ত আহ্বান। দরজার ভেতরে দিকে লাল রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নামানো মানেই শিক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে কিংবা এখন বিরতি। উনাদের দাম তবে অনেক। বাঙালি মধ্যবিত্তের কয়েক মাসের চাল-ডাল জোগাড় হবে সেই পয়সায়। এসব সান্তনায় নিজেকে শান্ত করে, এ বুকের জ্বালা চালে আর ডালে গোপন করে..

এই পাড়ায় খুঁজে পেলাম ‘রেড লাইট সিক্রেট’ নামে এক জাদুঘর। যৌন কর্মীদের সাথে আলাপের খুব একটা সুযোগ হলো না, শুধু প্রতি ঘণ্টার দাম জানা ছাড়া। উনারা ভয়ংকর ব্যস্ত সেই সময়।

ঘোর লাগা সেই সন্ধ্যায় আমরা তখন পুরোপুরি ছেয়ে গেছি আমস্টারডামের রাস্তায়। এতোটাই ছেয়ে গেছি যে, নিজেদের আবিষ্কার, করলাম শহরের উল্টো প্রান্তে। আমাদের কি যেন হয়ে গেছে ততক্ষণে! আমার তখনো পেটে ভয়ংকর ক্ষুধা। আমি মহাজনকে বাইরে রেখে ঢুকলাম কিছু কিনতে। যতোদূর মনে পড়ে… এক দোকান এক আইল চক্করই কেটে যাচ্ছি। কারণ ভালো লাগছে। কী কিনবো ভুলে গেছি। এই ঘোরচক্কর কেটে বাইরে বেরুলাম। দেখি মহাজন নেই। আমাকে মহাশূন্যে ফেলে চলে গেছে। আমি মহাশূন্যের বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটার পর একটা বাস চলে গেল। ঠিক করতে পারলাম না কোন বাসটায় ওঠা উচিত। মাথায় তখনো হারিয়ে যায়নি হোটেলের নাম। অনেক হাতড়ে নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করলাম, সেখান থেকে কোনও বাস বা ট্রেন আমার হোটেলে যায় না। মনে ততক্ষণে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় ঢুকে গেছে। দশমিক ৩ গ্রামে যে নিজেকে এতোটা হারিয়ে ফেলবো তা আগে বুঝিনি।

শেষমেশ মহাশূন্যে ট্যাক্সি পাওয়া গেল। চোখ আসছে বুজে, ঘাড় যাচ্ছে গুঁজে। কিন্তু ঠিকঠাক দামদর করলাম ট্যাক্সিওয়ালার সাথে। যতোই দামদর করিনা কেন ১২ মিনিটের পথ পৌঁছালাম ৩০ মিনিটে। খানিকটা ভেসে ভেসেই কেটে গেল সময়। টার্কিশ ট্যাক্সি ড্রাইভার এই কথা সেই কথা পাড়তে চাইলো। আমি আগ্রহ দেখালাম না। হোটেলের সামনে আসতেই সে জানতে চাইলো, ডু ইউ স্মোক? আমি সজোড়ে মাথা নেড়ে জানালাম- ‘নো, নেভার। বাট আই ইট।’

সিরিয়াস নোট: বিদেশ ভালো-র কিছু নিয়মিত পাঠক আছেন। যারা আমাকে প্রায়ই ই-মেইল করেন। তাদের ই-মেইল এর উত্তর আমি লিখি। কিন্তু অনুরোধ এড়িয়ে যাই। লেখক বা শিল্পী মানুষের কাছে দায়বদ্ধ কিনা- এটা বিতর্কের বিষয়। তবে আমি যাতে আপনাদের জন্য লিখতে পারি এবং আপনারা যাতে আমার লেখা পড়তে পারেন, তাই এ সময়ে কিছু কথা না বললেই নয়।

আমি জানি আপনার জানেন। তবুও বলছি ঘরে থাকেন, ঘরে রাখেন। শুধু বাস, বা ট্রাক থেকে না, মানুষের কাছ থেকেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন। এক কথায়- বাঁচতে হলে ঘরে থাকতে হবে।

বাই দা ওয়ে এই লেখাটাও ঘরে বসে লেখা।

লেখক:

গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন ।

ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!